জ্বলদর্চি

সিদ্ধার্থ সাঁতরার 'এই আবর্ত সংজ্ঞাহীন'-এ ব্যঞ্জিত জীবনের কথা/শুভশ্রী রায়

সিদ্ধার্থ সাঁতরার 'এই আবর্ত সংজ্ঞাহীন'-এ ব্যঞ্জিত জীবনের কথা

শুভশ্রী রায়
  
বিপন্নতা, অস্থিরতা, প্রকৃতির কাছে স্বস্তি খোঁজা....সিদ্ধার্থ সাঁতরার এই আবর্ত সংজ্ঞাহীন বইটির কবিতাগুলো পড়তে পড়তে এমন কথাই মনে হ'ল। 
     খোঁজ কবিতাটি সুন্দর। পেনশনের কাগজ খোঁজা থেকে যে কবিতার সূচনা তার শেষে কবির উচ্চারণ - "হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি মৃত্যুর পরও" থেকে যায়। যে উপলব্ধি থেকে এই উচ্চারণ তা স্বস্তিদায়ক এমন নয়। বরঞ্চ আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে লেগে থাকা এক বিপন্নতা, নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র থেকে শুরু করে পরিচিতিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলার আশঙ্কার সঙ্গে এই উপলব্ধি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু কবি এক পেলব ভঙ্গীতে মানব জীবনের এই বিপন্নতার কথা বর্ণনা করে গিয়েছেন। ফলে তাঁর খোঁজ কাব্যিক হয়ে উঠেছে।
    দূরত্ব আর দিনগুলি পড়তে পড়তে পাঠক এক অনিবার্য ভালোলাগায় আক্রান্ত হয়েছেন। দিনগুলিতে কবি বলছেন- দেখো, ক্লান্ত সকালের গায়ে লেগে আছে কত কাল এক নদী।
পংক্তিটি অপূর্ব। আবার এই কবিতাতেই এক জায়গায় কবি বলছেন- তেঁতুলবন শেষে অস্পষ্ট সেই নির্জনে তুমি / অনায়াসে ছুঁয়ে থাকো মেঘেদের ঘরবাড়ী। এই পংক্তি কবির আত্মমগ্ন স্বভাবের স্বাক্ষর। নির্জনতাপিয়াসী ও রোমান্টিক কবি নিজের মতো করে কোলাহলমুক্ত এক দুনিয়া গড়ে নিয়েছেন। চমৎকার সব শব্দ আর পংক্তি দিয়ে সেই দুনিয়াকে গড়েছেন তিনি। আমরা কবিতাগুলো পড়তে পড়তে সেই জগতের সন্ধান পাচ্ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। 
   
     তারপরেও রোদ উঠুক, ঝড় হোক কবিতাটি প্রত্যাশায় ভরা। কবির জীবন কষ্টকর, যেটুকু খুচরো পয়সা ছিল হাতে স্বপ্নের মতো জুঁইফুল হয়ে ঝরে গেছে। তারপরেও অতৃপ্ত অথচ ইতিবাচক সম্ভাবনায় বিশ্বাসী কবি লিখছেন- রোদ উঠুক, ঝড় হোক। তারপরেও কবি সমুদ্র উপকূল বরাবর ছায়াপথ খুঁজে চলেছেন। মুগ্ধ পাঠকও চাইছেন কবির এই অন্বেষণ অব্যাহত থাকুক, তিনি আরো আরো গভীর ও রোমান্টিক পংক্তি আমাদের উপহার দিতে থাকুন। 
     কবি দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। নানা রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। জীবন কবিতায় তিনি বলছেন- জীবন কিছুটা রাস্তার মতো / ক্ষয়ে যাওয়া ভেতরে প্রতিহত লাবণ্য কত...জীবনের পাড়ে বসে রোজ মাপি রাস্তার / বড় একা আমি অনেকের মতো। সহজসরল এই উপলব্ধি কিন্তু কাব্যিক ভঙ্গীতে প্রকাশিত।
বিনত রোদের ছুঁয়ে যাওয়া কবিতাটি প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে জীবনকে ভালোবাসার কবিতা। প্রকৃতিই ক্ষতি করে, প্লাবন ডেকে আনে আবার সেই প্লাবনেই সমস্ত দুঃখ ভেসে যায়। চিরকালীন এই সত্য কবি উপলব্ধি করেছেন এবং কাব্যিক ভঙ্গীমায় প্রকাশও করেছেন - নদীমাতৃক সভ্যতার বিচরণভূমি / যত দূর চোখ যায় এই অকাল ভাদ্রে / জলময় ভেসে যায় দুঃখকথা। এমন সমস্ত পংক্তি পড়ে মুগ্ধ হতেই হয়। 
     বৃষ্টি কিংবা বিষাদ কবিতাটি একটি মাস্টারপিস। এখানে কবি বলেছেন- ভালোবাসা, মিছে কথা চেয়ে তারপরও ভাসিয়েছে সকাল এক লাজুক নদীর মতো / দিনযাপনের কোথাও এই অধিবাস্তবতা / প্রেম হয়ে রয়ে গেছে আজও। একদম মানবিক। সবাই জানি, জীবনের অনেক স্তর। জীবনকে আমরা যেভাবে যাপন করি, আপাত দৃষ্টিতে নিতান্ত গদ্যময় ভঙ্গীতে তাকে বর্ণনা করাই যায়। কিন্তু এই জীবনের তলায় আরেকটা জীবনও থাকে যা একটু অন্যরকম। কবিতা সেটার খোঁজ এনে দেয়। কবি অত্যন্ত দক্ষ কলমে দৃশ্যমান জীবনের তলায় থাকা আরেক জীবনকে বর্ণনা করেছেন।

রক্তদান কবিতার শুরুতে কবি বলছেন- একটা সকালের গায়ে গ্রীষ্মের যত তাপ এসে পড়ে, তাতে কিছু ভালোবাসা, কিছু প্রতিশ্রুতি, মানুষের কথা, গঠনের দিন লেগে থাকে। গ্রীষ্ম কালে রক্তের সংকট চরমে পৌঁছয়। সেই ঋতুতে রক্তদান বিষয়টিকে কবি ঘোমটা পরানো ভাষাতেই বলেছেন। চমৎকার! 
       স্বপ্নের খোঁজে কবি বলছেন- যে সময়ে আছি তার চারপাশ জুড়ে অনিশ্চয়তা / এই বুঝি ঝরে পড়বে লুব্ধক তারা / বৃষ্টির মুখ ঘোমটায় ঢাকা / শেষ বিকেলে ভেসে যায় টলমল যারা। সময় কতটা অস্থির এবং সংশয়াপন্ন তা চমৎকার ভঙ্গীতে বোঝাতে গিয়ে কবি বলেছেন- এই বুঝি ঝরে পড়বে লুব্ধক তারা। তুমুল কবিতা!
  যাও ছবি রং মাখো স্বপ্ন ছুঁয়ে আছে যেথা,    যাকে প্রাপ্তি বলে ভাবতাম সে আসলে অপেক্ষাই ছিল, আজকাল ঘুমের ভেতর নির্মাণ, ঘুমের ভেতর ঘুম, চোখের মধ্যে সূর্য ওঠে..., মুঠো মুঠো অন্ধকার, মেঘলা দিন সেও জানে / অনেক জমানো স্বপ্ন পর্ণমোচী বৃক্ষের নিচে / খুব একঘেয়ে আজ জলের নির্মাণ জোয়ারের টানে।... একা থাকুক উন্মাদ ঝোড়ো হাওয়া বিষাদের দিনে, গদারের মতো দেখতে মানুষটির সঙ্গে আচমকা দেখা হয়েছিল কলকাতার এক পলিক্লিনিকে....এমনই সব সুন্দর, রহস্যময় অথচ মনে হয় হাত বাড়ালেই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, এমন সব বহুমাত্রিক পংক্তি বইটার ভেতরে জ্বলজ্বল করছে।
    রাতের আত্মকথা কবিতায় কবি আমাদের এক অন্য জায়গায় নিয়ে যান- স্বপ্নের ভেতর যে সিনেমাটি শুরু হয় / তার টিকিটঘর/ লাইনেই দাঁড়িয়ে আছি, খুব ভীড় সেখানে যেমন হয় আর কী/ রাতের আত্মকথা / জানি না টিকিট পাব নাকি/
বাবা কবিতার শেষে কত অর্থবহ কথাই না বলেছেন- এ জীবন এ দেশ এই প্রৌঢ়তা মায়াময় বড় / অসহায় বাবা ঠিক তার ছেলের মতন। কবিতাটি মায়ায় ভরা।
     পরিশেষে বলি, কবিতাগুলোয় কমা বা সেমিকোলনের ব্যবহার কম। কবিতা অনুভব করার সময় পাঠকের ওপরে কবি হয়তো যতিচিহ্নের ভার বসাতে চাননি। সেই জন্যই অল্প কমা ও সেমিকোলন ব্যবহার করেছেন।

এই আবর্ত সংজ্ঞাহীন / সিদ্ধার্থ সাঁতরা/ কবিতিকা/ প্রচ্ছদ -কমলেশ নন্দ
🍂


Post a Comment

1 Comments