আমার জীবনের ঘটনা : ‘ভেন্ন’ করার পারিবারিক সভা
মলয় রায়চৌধুরী
হাংরি মামলার সময়ে পিসতুতো দাদা অজয় হালদার (সেন্টুদা ) একদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে এসে জানালো যে পিসেমশায় একটা পারিবারিক সভা ডেকেছেন তাতে আত্মীয়দের উপস্হিত থাকতে হবে। আমার সেসময়ে কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না বলে আমার খোঁজে আদালতে আসতে হয়েছিল ওনাকে । সেসময়ে রাতের বেলায় সুবিমল বসাকের জেঠার বৈঠকখানা পাড়ায় স্যাকরার দোকানঘরে শুতুম বা শরদ দেওড়া নামের মারোয়াড়ি সাহিত্যিকের গদিতে। উত্তরপাড়ার আদিবাড়ির খণ্ডহরে অনেক সময়ে থাকতুম যখন দুটো ডেটের মাঝে সপ্তাহের বেশি সময় থাকতো ।
সেন্টুদাদের আহিরিটোলায় কেবল একটাই শোবার ঘর ছিল, তাই সেখানে রাতে শোবার মতন জায়গা কুলোতো না। সেন্টুদারা নিজেরাই গরমকালে ছাদে উঠে শুতো আর শীতকালে ঘরে গাদাগাদি করে। খাটটার তলায় চার ভাই শোবার দরুন মেঝে একেবারে চকচকে থাকতো । খাটে শুতেন পিসিমা আর পিসেমশায়।
—তোমাদের ঘরে তো জায়গা নেই, সভা হবে কোথায়? জিগ্যেস করলুম।
—তুই সকাল দশটায় আমাদের বাড়ি চলে আসিস, তোর দাদাকেও বলেছি, যেখানে সভা বসবে, নিয়ে যাবো।
দাদার অবস্হা আরও খারাপ ছিল কলকাতায় । বন্ধুরা দাদার নানা পোস্টিঙের জায়গায় দলবেঁধে বা সপরিবারে যেতো, সেসব নিয়ে উপন্যাস-গল্প লিখেছে, কিন্তু কেউই দাদাকে তাদের বাড়িতে থাকতে দেয়নি মামলার সময়ে । পরে দাদা যখন বাঁশদ্রোণীতে বাড়ি করল তখনও অনেকে গিয়ে সেই বাড়িতে থেকেছে, বিনা ভাড়ায়।
দাদার সস্তা হোটেল জানা ছিল সেখানেই উঠেছিল হাংরি মামলার সময়ে।
গেলুম পিসেমশায়ের বাড়ি । সবাই বেশ গম্ভীর । ব্যাপারটা কেউ বলল না । আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে সেন্টুদা বিবেকানন্দ রোডের একটা বাড়ির উদ্দেশে চলল । পিসিমা আর পিসেমশায় গেলেন না আমাদের সঙ্গে।
—ব্যাপারটা কী ? দাদা জানতে চাইল।
—তোরা ওখানে গিয়ে একটা ফয়সালা করবি, তাই ডাকা হয়েছে, ওখানে তোরা আমাদের প্রতিনিধি হয়ে যাচ্ছেস। বললেন পিসিমা।
একটা বাড়িতে ঢুকলুম । পুরোনো আমলের দোতলা বাড়ি।
যেতে-যেতে সেন্টুদা বলল, এই বাড়ির ছেলের সঙ্গে গীতুর বিয়ে হয়েছে। গীতাশ্রী বা গীতু পিসেমশায়ের বড়ো মেয়ে। গীতুর বিয়ের সময়ে আমি আর দাদা পাটনায় থাকতুম । জেঠা-বাবা-কাকারা কেউ গীতুর বিয়েতে পাটনা থেকে যাননি। ওনারা পশ্চিমবাংলায় কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেতেন না, ট্রেনের তৃতীয় শ্রেনির ঝকমারির ভয়ে। চিঠি আর টাকা পাঠিয়ে কাজ সেরে ফেলতেন।
সভা আরম্ভ হয়ে গেয়েছিল । সবাই মেঝেয় বসে । সবাই গম্ভীর । প্রায় কুড়ি-পঁচিশজন। ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখক স্বপনকুমারও ছিলেন ; উনি গীতুর শশুরবাড়ির কেউ হন, শুনেছিলুম ।
সভায় গীতুর শশুরবাড়ির লোকজনই বেশি । সেন্টুদা আর আমরা দুজন গীতুর বাপের বাড়ির লোক হিসেবে কোরাম পুরো করলুম।
সেন্টুদা আর আমরা পৌঁছোবার পর গীতুর শশুর জানালেন যে পারিবারিক সভা ডাকা হয়েছে গীতু আর ওর বরের সম্পর্ক নির্ণয় নেবার জন্য ।
ভড়কে গেলুম শুনে । সম্পর্ক নির্ণয় আবার কী !
গীতুর বরকে দেখলুম, প্রথমবার, গায়ের রঙ বেশ ময়লা, রোগা, ঢ্যাঙা, দাঁত বেরিয়ে আছে। বুঝলুম যে পিসেমশায় যৌতুক দেবার অবস্হায় ছিলেন না বলে এরকম এক পাত্রের সঙ্গে গীতুর বিয়ে দিয়েছেন। গীতু তো দেখতে ভালোই, বেশ ফর্সা, বড়ো-বড়ো চোখ, চুলও পিঠে ছড়ানো কোমর পর্যন্ত। আরও খোঁজখবর করলে এর চেয়ে ভালো পাত্র পেতেন।
বরের বাড়ির কেউ একজন, পরে জেনেছিলুম বরের মামা, বেতের মোড়ায় বসেছিলেন, জানালেন যে, গীতু ওর বরকে পছন্দ করতে পারেনি। এমনকি বাসরঘরে রাগ দেখিয়েছিল। যখন-তখন বরের সঙ্গে ঝগড়া করে। একই ঘরে শুতে চায় না ।
মামাবাবু তারপর কিছুক্ষণ থেমে, কেশে নিয়ে বললে, গীতু ওর বরের ভাগ্নের সঙ্গে ইলোপ করেছিল । কয়েকদিন আগে সেই ভাগ্নে, তার নাম কিংকর, আর গীতু এসে জানিয়ে গিয়েছিল যে ওরা কালীঘাটে বিয়ে করে নিয়েছে। গীতু বলেছে ও কিংকরের সঙ্গে সংসার করছে, বরকে ছেড়ে দেবে। যাদবপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সংসারের জন্য সব জিনিসপত্র কিনে ফেলেছে।
—চুটিয়ে সংসার করছে ! কম বয়সী এক বউ বললেন হাসিমুখে । ওনার ইশারা বুঝে অনেকেই ফিকফিকে হাসলেন।
–ছেড়ে দেবে ? অচেনা এক মহিলা জিগ্যেস করলেন।
–হ্যাঁ, গীতুকে ওর বর ভেন্ন করে দেবে, তাহলে কিংকরের সঙ্গে গীতু সংসার করতে পারবে।কেউ একজন বলল।
—ভেন্ন ? সেটা কী ? আমি জানতে চাইলুম ।
–হ্যাঁ, সবাই মিলে ডিসাইড করতে হবে ।
—আগেকার কালে বউ পছন্দ না হলে বর তাকে ভেন্ন করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিত ; তখনকার দিনে চার-পাঁচটা বউ থাকতো বলে ওসব করতে পারতো, কিন্তু বউই বরকে ভেন্ন করে দিতে চাইছে, এমন কথা তো শুনিনি। বেশ ভারিক্কি টাইপের এক প্রৌঢ়া বললেন।
–না, বর ভেন্ন করে দেবে, তাহলে ল্যাটা চুকে যাবে, লোকের মুখে অকথা-কুকথা শুনতে হবে না । বললেন মামাবাবু।
কিংকর ছেলেটার সঙ্গে গীতু মাসখানেক ছিল। কিংকর ছেলেটাকে দেখে আমার ভালোই লাগল, স্মার্ট। দাদা জিগ্যেস করল, আমাদের কোনও ভূমিকা আছে?
সেন্টুদা বলল, পরিবারের লোকেরা অনুমোদন করলে গীতাকে ওর বর ভেন্ন করে দেবে।
যাঁরা উপস্হিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ ভেন্ন করার পক্ষে মত দিলেন। কয়েকজন নিরপেক্ষ রইলেন। কয়েকজন বিরোধ করেও বললেন, অমন মেয়েকে ঘরে তোলা যাবে না।
গীতুর বর মুণ্ডু ঝুলিয়ে বসেছিল । বেচারা ।
আমি ভেন্ন করার পক্ষে ছিলুম । দাদা ছিল নিরপেক্ষ ।
‘ভেন্ন’ হবার প্রক্রিয়া শেষ হলো ।
আমার প্রথম গল্প সংকলনের নাম রেখেছিলুম ‘ভেন্নগল্প’, আফিফ ফুয়াদের দিবারাত্রির কাব্য থেকে বেরিয়েছিল;
উদয়ন ঘোষ ওনার আলোচনায় তারিফ করেছিলেন বইটার, বিশেষ করে একটা গল্পের।
বাংলা সাহিত্যজগতকে ‘ভেন্ন’ করে দিয়েছিলুম ।
গীতু আর কিংকর দুই ছেলে আর এক মেয়ে রেখে মর্ত্য থেকে বিদায় নিয়েছে।
এইসব পারিবারিক ব্যাপার ফাঁস করার জন্য আমি এখনও টিকে আছি।
0 Comments