বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ড. অতুল সুর
নির্মল বর্মন
ড. অতুল সুর বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ, নৃতাত্ত্বিক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ছিলেন। অতুল সুর অর্থনীতিবিদ হলেও সমাজবিজ্ঞান ,সংখ্যাতত্ত্ব, ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। অতুল সুর ওরফে অতুলকৃষ্ণ সুর দশ হাজারের বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন।১৯০৪ সালের ৫ই আগস্ট শ্যামবাজার ই জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার বিদ্যাসাগর স্কুল থেকে ১৯২১ শে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এই পরীক্ষায় ইতিহাসে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯৯ পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করতে পেরেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক। ১৯২৮ এ নৃতত্ত্ব বিষয়ে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে স্বর্ণপদক পান। অতুল চন্দ্র সুরে গবেষণালব্ধ প্রথম প্রবন্ধ
" ম্যান ইন ইন্ডিয়া" । প্রাবন্ধিক অতুল সুর অর্থনীতিতে পি.এইচ.ডি করেন জুরিখ থেকে ।
ড. অতুল সুর প্রত্নতত্ত্ব বিশারদ অধিকর্তা স্যার মার্শালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহেঞ্জোদারো গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে ভারতীয় সভ্যতার নানাবিধ তথ্য তালাশ আবিষ্কার করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্টে এ টানা ১০ বছর ফলিত অর্থনীতির সুযশ অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এ গেস্ট লেকচারার ছিলেন। "কমার্শিয়াল" গ্যাজেট পত্রিকা সহযোগী সম্পাদক হিসাবে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। ড. সুর "বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড" ও "হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড" পত্রিকার বিজনেস এডিটর হিসাবে গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রাবন্ধিক অতুল সুর 'রয়্যাল ইকোনমিক সোসাইটি ও 'রয়্যাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল' সোসাইটি'র ফেলো নির্বাচিত হয়ে জনগণের পাঠকের "নয়নমণি"হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু কালের অমখ বিধানে বিস্মৃয়প্রায় সাহিত্যিক। প্রাবন্ধিক অতুল সুর ১৯৯৯ সালের ২ রা জানুয়ারি ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ড. অতুলকৃষ্ণ সুর মহোদয়ের গবেষণাধর্মী বইগুলি---
"ক্যামব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া" ; " হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার অফ বেঙ্গল"; "ডাইন্যাস্টিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া" দেশ বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
ড.সুর বাহাদুরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল--
"প্রমীলা প্রসঙ্গ"১৯৩৯ ; কালের কড়চা (চন্দ্রাবতী ছদ্ম নামে); "দেব লোকের যৌন জীবন" ; "ফোক এলিমেন্ট ইন বেঙ্গলি" ; " চ্যালেঞ্জ অফ রুরাল প্রভাটি" ; "ভারতের মূলধনের বাজার" ; " বাংলা মুদ্রণের ২০০ বছর" ; " *বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়"; " ভারতের বিবাহের ইতিহাস" ; " সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ ও অবদান" ; " বাংলা ও বাঙালি" ; " বাংলার সামাজিক ইতিহাস" ; " স্বাধীনতার 50 বছরে আমরা কেমন আছি"; । 'যম' 'চন্দ্রাবতী' ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন।
১৯৭৬ সালে "বাংলার সামাজিক ইতিহাস" গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে বাঙালি সমাজের উদ্ভব, জীবন চর্যা ,ধর্ম ও শিক্ষাদীক্ষা বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।ড. সুরের বাঙালির আবাসভূমি প্রবন্ধে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আবাস স্থান সম্পর্কে স্বয়ং সুর সাহেব জানিয়েছেন যে --" পরবর্তীকালে যেটা বাঙালীর আবাসভূমি 'বঙ্গদেশ' নামে অভিহিত হত , সেটা প্রাচীনকালে বহুজাতির আবাস স্থান হয়ে বহু জনপদে বিভক্ত ছিল। অন্তর্বর্তীকালে এদের অনেক নাম ছিল, যথা -- গৌড় , বঙ্গ , সমতট,হরিকেল চন্দ্রদ্বীপ বঙ্গাল , পুন্ডু ,বরেন্দ্র, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত, বরাক, কঙ্কগ্রাম, বর্ধমান , কজঙ্গল , দন্ডভুক্তি , খাড়ি নাব্য ইত্যাদি"।
ড.অতুল সুর' র "বাংলার ভূতাত্ত্বিক গঠন ও ভৌগোলিক রূপরেখা"প্রবন্ধে বাংলার নদীমাতৃকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-----
"নদীই বাংলার ইতিহাসের স্রষ্টা । নদীই বাঙালীর চরিত্র কে গঠন করেছে। নদীই বাংলার ভাগ্যবিধাতা। নদীবহুল দেশে বাস করে বাঙালি মেয়েরা শাঁখা, পরে মাছ খায়। উত্তর ভারতের লোক মাছ খায় না। নদীই বাংলাকে শস্য শ্যামলা করে তুলেছে। আবার নদী বাংলার বুকে ডেকে এনেছিল বিদেশি বণিককে। যে বণিক তার মুখের গ্ৰাস কেড়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করেছিল। নদী যেমন একদিকে রাজনৈতিক ঐশ্বর্যশালী করেছিল আবার অপরদিকে তাকে দীনহীন করেও ছেড়ে দিয়েছিল।"
প্রাবন্ধিক অধ্যাপক অতুল সুর "প্রাচীন বাংলার ধর্ম সাধনা" প্রবন্ধে প্রাগ - আর্য ধর্ম ও আর্য ধর্মের মিশ্রণের রূপ আলোচনা করেছে।। প্রাগ আর্য ধর্মের বহু সংস্কার আর্য ধর্ম তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মে জায়গা করে নিয়েছিল যেমন দুর্গা পূজার সঙ্গে নবপত্রিকা পূজা , নবান্ন, পৌষ পার্বণ; চড়ক, গাজন এবং বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক কর্ম।
অধ্যাপক অতুল সুরের "বাংলায় নবজাগৃতি" প্রবন্ধের রাজা রামমোহন রায়ের মাধ্যমে বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তা ব্যক্ত করেছেন। ফলতঃ এই নবজাগরণের ক্ষেত্রে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা ছাপাখানা।
১৯৭৭ সালে অতুল সুরের "মূলধনের বাজারের স্বরূপ" প্রবন্ধে অর্থনীতি বিষয়ে সুগভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। মূলধন বাজার সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন--
"যে বাজারের সহায়তায় শিল্পপতিরা তাঁদের উদ্যোগ সমূহ কে সাফল্যমণ্ডিত করবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করেন"!
ড.অতুল সুর প্রাবন্ধিক হিসাবে সুবিশাল তথ্যের প্রতি নিষ্ঠা, যুক্তির প্রতি আস্থা, উদাহরণ চয়নের ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা ভাষা ব্যবহারের সহজ সরল সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন। তাই ড. সুরের প্রবন্ধ গুলি শুধু তথ্যের ইতিহাস হয়ে যায়নি তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে মননশীলতার ছোঁয়া ও ভাষা শৈলীর নান্দনিক প্রেক্ষিত বিরাজমান।
0 Comments