শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৫ / সালেহা খাতুন
“কত তারা খসে যাবে, কত চিঠি জলে ধুয়ে যাবে” – ইলেভেনের ক্লাসের শুরুতেই ঘোষণা করেছিলেন উলুবেড়িয়া কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক শঙ্কর পাণিগ্রাহী মহাশয়। অর্থাৎ মাধ্যমিকে যারা স্টার মার্কস পেয়েছে, লেটার মার্কস পেয়েছে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে বাণী উচ্চারণ করেছিলেন তিনি।
আসলে ১৯৮৯-১৯৯১ এ উচ্চমাধ্যমিক আর মাধ্যমিকে আকাশ পাতাল তফাত ছিল। মাধ্যমিকে দেখেছিলাম একই রকম পরিশ্রম করে আর্টসে সায়েন্সের তুলনায় কম নম্বর পেয়েছিলাম। সেটাই কাল হলো। বাবারও ইচ্ছে ছিল আমাকে বি এইচ এম এস ডাক্তার করবেন। তো ভর্তি হলাম সায়েন্স নিয়ে। সহজেই যেখানে ভর্তি হতে পারতাম বাবার গড়িমসির কারণে সেটাই হয়ে উঠলো দুরূহ ব্যাপার।
নিশ্চয়ই কোনো প্রলোভন ছিল। কোনো বিত্তবান বাবার কন্যাকে পুত্রবধূ করার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। শিক্ষক হলেও তাঁকে ভাবতে বাধ্য করানো হয় বেশি পড়ালে মেয়ের উপযুক্ত পাত্র পাওয়া মুশকিল হবে। আর দ্বিতীয়ত স্কুলে পড়াবেন না কলেজে পড়াবেন সে ডিসিশন নিতে দেরি করা।
আমার স্যার মাজেদ সাহেব ঠিকই বলতেন অদুদবাবুর আঠারো মাসে বছর। খুব কম স্কুলে তখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ানো হতো আর সব কলেজেই ইলেভেন টুয়েলভ ছিল। সবাই বোঝালেন কলেজে সায়েন্স ল্যাব খুব উন্নত স্কুলে অতোটা পরিকাঠামো থাকে না। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো কলেজেই পড়বো। হায় রে! সর্বত্র ভর্তির দিন পেরিয়ে গেছে। উলুবেড়িয়া কলেজে ভর্তি হতে গেলাম কিছুতেই কিছু হলো না। পরিবারের মুশকিল আসান বড়ো মেসো অ্যাডভোকেট ফজলুল হক উলুবেড়িয়া কলেজের প্রিন্সিপাল জয়ন্তবাবুকে বিশেষ অনুরোধ করে আমার ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন।
শুরু হলো পড়াশোনা। স্কুলে হেঁটেই যেতাম। কলেজ যাওয়ায় এর সঙ্গে যুক্ত হলো ট্রেন জার্নি। যাত্রাপথে বন্ধুদের পেলাম। স্কুলের বন্ধুরা কেউ উলুবেড়িয়া কলেজে ভর্তি হয়নি। নতুন নতুন বন্ধু পেলাম। অনুপম, স্বপন, সাহানিয়া,দীপা,সুস্মিতা, দেবমিতা,রুণা,স্বাতী,তুলিকা ও আরো অনেকে। অনুপমকে বন্ধু রূপে পাওয়া আমার কাছে এক অনন্ত সৌভাগ্য। অনুপমকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেছি। আমার ‘নৈঃশব্দ্যের ফুল’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা সেটি। আত্মকথাতেও ‘অনুপম’কবিতাটি থাকুক-
আমি কোনোদিন পুরুষ বিদ্বেষী হতে পারিনি
কারণ আমার একজন অনুপম বন্ধু আছে।
আমি ধর্ম বিদ্বেষীও হতে পারিনি
ঐ একই কারণ আমার অনুপম বন্ধু আছে।
আমি কখনোই মনুষ্যত্ব বিরোধী হতে পারব না
কেননা আমার বন্ধু অনুপম আছে।
অনুপম নামেই আছে যথার্থতার বাণী
যারা সংস্পর্শে এসেছি তারা জানি
অনুপম মানে নারীর মর্যাদা রক্ষাকারী
অনুপম মানে মনুষ্যত্বের ধ্বজাধারী
অনুপম মানে বিদ্বেষ বিষ নাশো
কেন এমন একটি কবিতার জন্ম হলো? অনুপম ছিল আমাদের ক্লাসের সেরা। পড়াশোনা এবং মানসিকতায়। শুধু কলেজেই নয় বিজনবাবুর কাছে অঙ্ক এবং কেমিস্ট্রিও আমরা একসঙ্গে পড়তাম। স্কুলের কমফর্ট জোন ছেড়ে কলেজের সমুদ্রে পড়া। অনুপম সেখানে ছিল ফ্রেন্ড ফিলোজফার এবং গাইডের মতো। আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমান একদম পাশাপাশি আত্মার আত্মীয়ের মতোই থাকে। কিন্তু কখনো কখনো সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। চূড়ান্ত ক্রাইসিস দেখা যায়। কেউ কাউকে চেনে না। জারি হয় একশো চুয়াল্লিশ ধারা। এলাকায় আমার উচ্চমাধ্যমিকের দিনগুলোতে মাঝে মাঝেই এ ঘটনা ঘটেছে। পড়াশোনা থেমে থাকে না। বাস ট্রেন থেমে গেলেও আমরা পড়তে যেতাম। টিউশন সেরে ফিরতে সন্ধে পেরিয়ে রাত হয়ে গেলে স্বপন অনুপম ওদের সাইকেলে করে দায়িত্ব নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিত পুলিশের টহলদারির মাঝেও।
(ক্রমশ)
0 Comments