জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৮ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৮ 
 সালেহা খাতুন 

পড়া পড়া পড়া আর পড়া, এছাড়া জীবনে কি আর কিছুই ছিল না? আসলে শিক্ষার্থীদের মূল কাজই তো পড়াশোনা। তাই বড়ো হওয়া মানে পড়াশোনাও বাড়তে থাকা। কিন্তু আমার অভিভাবকদ্বয়ের সমাজের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। সমাজসেবার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। তাঁরা কন্যাকে একটি ইয়ুথ ক্যাম্পে পাঠালেন সমাজকে চেনা জানা এবং সামাজিক কাজকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য। একটি এন জি ও তে সপ্তাহব্যাপী এই ক্যাম্পে রাতদিন এক করে আমাদের মতো যুব শক্তিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার বিভিন্ন পাঠ দেওয়া হলো। গ্রামবিকাশের কাজে যুক্ত বিশেষ করে নারী ও শিশুকল্যাণের কাজ করে সংস্থাটি। সংস্থার পরিচালক তথা প্রধান মাননীয় মইনুদ্দিন সাহেব বলেছিলেন লক্ষ্য স্থির রেখো। অনেক বাধাবিপত্তি আসবে। বিচলিত হলে চলবে না। একটি প্রবাদ উচ্চারণ করেছিলেন -

“হাতি চলে বাজার কুত্তা ডাকে হাজার”।

ঐ ক্যাম্পে বেশ কিছু মানুষের সংস্পর্শে এলাম। আমি আজীবন একটি ব্রত মনে মনে নিয়েছি সেটি হলো মানুষ জমানো মানুষ সঞ্চয় করে যাওয়া। তখন ক্লাস ইলেভেন। ক্যাম্পে পেলাম রেণুদিকে(রহিমা খাতুন)। ক্যাম্পে ট্রেনিং দিতে দিতে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখে তিনি বললেন বয়সে তুমি ছোটো হলেও আজ থেকে আমি তোমার ফ্যান। রেণুদি বর্তমানে নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের সম্পাদিকা। রেণুদির বোন মহিমা হাকিমা এছাড়া এলাকার আরো অনেককে ঐ ক্যাম্পে পেলাম। লেকচার শোনা, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দেওয়া, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতায় অংশ নেওয়া, সম্প্রীতি বজায় রাখার শিক্ষা, গ্রুপ স্টাডি, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া, অনুষ্ঠান পরিচালনা করা কী নেই সেখানে। মহিমার সঙ্গে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কী মিষ্টি মেয়ে।
🍂

ক্যাম্পে প্রাপ্ত শিক্ষা নিজের গ্রামে কাজে লাগাবার চেষ্টা করলাম। বালোয়াদি বিদ্যালয়-নন ফরম্যাল স্কুলে স্কুলছুট বাচ্চাদের ফিরিয়ে আনা, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা, তাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, ছেলে মেয়েদের নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর জন্য মায়েদের অনুরোধ করা ইত্যাদি। নিজে নেতৃত্ব দিইনি ঠিকই কিন্তু বড়োদের এইসব কাজে প্রাণপণ সাহায্য করেছি। একবার সব বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তাদের ঠিকঠাক দেখভাল করা, প্রত্যেককে যথাযথ যত্ন নেওয়া ভীষণ দায়িত্বের কাজ। তাদের সযতনে প্রকৃতির পাঠ দিলাম। বিভিন্ন গাছ চেনালাম। কেননা তখন বোটানিতে হাতে খড়ি আমার হয়ে গেছে। চিড়িয়াখানাতেও নিয়ে যাওয়া হলে, পশুপ্রাণী চেনানোর কাজ করলাম পূর্ণোদ্যমে।  গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্প হলে বেনিফিশিয়ারিদের সাথে সাথে অর্গানাইজারদের যত্নআত্তিও আমাদের মতো স্বেচ্ছাসেবীদেরই করতে হতো।
ঐ ক্যাম্প আমাকে যে শিক্ষা দিয়েছে তাতে আমার মনে হয়েছে অভিভাবকদের উচিত এমন একটা ক্যাম্পে তাদের ছেলে মেয়েদের অন্তত একবার হলেও পাঠানো। তাতে জীবনের প্রকৃত অর্থ তারা বুঝবে। ভবিষ্যতে যুঝতে গেলে টিকে থাকতে গেলে শুধু আমি আমি করলে চলবে না। নিজের অহংকেও বিসর্জন দিতে হবে। থাকতে হবে মাটির কাছাকাছি। পরবর্তী কালে কর্মক্ষেত্রে অনেক ক্যাম্প যখন আয়োজন করেছি কৈশোরের এই অভিজ্ঞতা আমাকে কুশলী করে তুলেছে। আমার শিক্ষার্থীরা তৈরি হয়েছে। মানুষের জন্য ভাবতে শিখেছে। জীবনের অন্য মানে তারা খুঁজে পেয়েছে। ফলে শুধু নিজে সমাজসেবা করছি আর আত্মতৃপ্তি লাভ করছি এর থেকে বড়ো মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা। তাদের হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়া। উন্নত মানসিকতা গড়ে দেওয়া।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments