জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান /পঞ্চদশ পর্ব /দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান
পঞ্চদশ পর্ব
দেবীপ্রসাদ ত্রিপাঠী


পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ

তিন দিন ধরে মধ্য ও উত্তর আন্দামান ঘুরে আমার উপলব্ধি হলো প্রথমদিকে উপনিবেশ করার সময় সরকারি দপ্তরের কর্মচারী, বুশ পুলিশ এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রথমে দক্ষিণ আন্দামান ও মধ্য আন্দামানের দ্বীপগুলির প্রাচীন গভীর জঙ্গল কেটে জমি বের করে প্রত্যেক উদ্বাস্তুকে বসবাসের উপযোগী জমি এবং চাষের জন্য জমি দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। যেখানের ভূমি অনুর্বর বা পাথুরে সেখানে যে সকল উদ্বাস্তুরা থাকতেন তাদের প্রধান জীবিকা ছিল সমুদ্রে মাছ ধরা এবং জঙ্গলে বিভিন্ন বনজদ্রব্য সংগ্রহ করে বিক্রি করা। প্রতিনিয়ত আদিম বনবাসী জারোয়াদের সাথে সংগ্রাম করে তাদের টিকে থাকতে হয়েছে। সবশেষে উত্তর আন্দামানে উদ্বাস্তু উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছে। প্রথমদিকের দিনগুলি অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত যে কষ্টের মধ্যে এই সমস্ত পরিবারগুলিকে দিন কাটাতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়। সেই সময় না ছিল উন্নত যোগাযোগ বা পরিবহনের ব্যবস্থা, বিজলিবাতি, স্বাস্থ্য পরিষেবা। উপরন্তু জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলিতে জারোয়াদের প্রতিনিয়ত আক্রমণ। যে জঙ্গল ছিল জারোয়াদের যুগ যুগ ধরে বিচরণক্ষেত্র সেখানে জঙ্গল কেটে সভ্য মানুষের বসবাসের ব্যবস্থাকে তারা খোলা মনে মেনে নিতে পারেনি। তাদের অস্তিত্বের বিপন্নতা অনুভব করে এই সমস্ত বনচারী আদিম মানুষেরা পুনর্বাসন প্রাপ্ত মানুষদের বসতি গুলি আক্রমণ করে ত্রাসের সঞ্চার করতো। সমস্ত বাধা বিপত্তি তুচ্ছ করে আজ সেই সমস্ত শরণার্থীরা সগর্বে মাথা তুলে বসবাস করছেন দেখে আমাদেরও খুব ভালো লাগলো।
🍂

গতকাল রাত্রিতে ভালো ঘুম হয়েছে। আজ সকালে আমরা আটটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম পোর্টব্লেয়ার থেকে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে দক্ষিণ আন্দামানের পশ্চিমে ওয়ান্ডুর। গাড়ী এখানে ড্রাইভার পার্কিং লটে রেখে দিল। আমরা ওয়ান্ডুর জেটিতে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় উদ্যান দর্শনের উদ্দেশ্যে লঞ্চে যাওয়ার জন্য টিকিট কেটে লঞ্চে যেয়ে উঠলাম। পনেরোটি দ্বীপ নিয়ে গড়া মহাত্মা গান্ধী জাতীয় উদ্যান। সবগুলি দ্বীপই জনমানবহীন। পর্যটকদের দেখার জন্য দু'টি দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় - জলিবয় এবং রেডস্কিন দ্বীপে। জলিবয় দ্বীপ খোলা থাকে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। বর্ষার সময়ে জলিবয় দ্বীপ জলে ডুবে যায়। সেই সময়ে রেডস্কিন দ্বীপে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয়। নীল সমুদ্রের বুকে পনেরটি দ্বীপ গোলকধাঁধার মত। লঞ্চ আমাদের নিয়ে গেল জলি বয় দ্বীপে। স্থলভূমির মানুষের কাছে আশ্চর্য হলেও সত্য যে জলিবয় দ্বীপ সম্পূর্ণ প্লাস্টিক বর্জিত এক ইকো ফ্রেন্ডলি দ্বীপ। এখানে কাঁচ দিয়ে ঘেরা বোটে চেপে সমুদ্রের স্বচ্ছ জলের সামুদ্রিক প্রবাল এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী দেখা এক বিশেষ আকর্ষণ যদিও আমরা ইতিপূর্বে নর্থ বে আইল্যান্ডে যাবার পথে জলতলের সমুদ্রের প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, তথাপি এখানেও পুনরায় এই গ্লাস বোটে আমরা জলের তলার জগৎকে পুনরায় দেখার জন্য গেলাম। জলিবয়ের সমুদ্রতটে সাদা রংয়ের বালি। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাল দ্বীপ এই জলিবয়। জলের নিচে প্রবালের বিভিন্ন প্রকারের সমারোহ - বোল্ডার প্রবাল, ফিঙ্গার প্রবাল, কলিফ্লাওয়ার প্রবাল; কত না বাহারী নাম, বোটের মাঝিরা বলে দিতে জানলাম। বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, যেমন জেব্রা, প্যারট, ক্লাউন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও গাছের মতো দেখতে সমুদ্র লিলি এবং সি কিউ-কাম্বার জাতীয় বিশেষ ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী এখানে দেখা গেল। এই দ্বীপে যেতে গেলে পানীয় জল সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয় কারণ দ্বীপের মধ্যে কোথাও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। শুকনো খাবার নিয়ে গেলে খাবারের প্লাস্টিকের প্যাকেট গুলি ব্যাগের মধ্যে করে পুনরায় পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে আসতে হবে। সমুদ্র তীরে কোন প্লাস্টিক ফেললে জরিমানা দিতে হয়। জলিবয় দ্বীপ থেকে দুপুর সাড়ে বারোটায় বেরিয়ে আসার পথে অনেকগুলি চিরসবুজ বনাঞ্চল সমৃদ্ধ দ্বীপের পাশ দিয়ে নীল সমুদ্রে ভেসে ওয়ান্ডুর জেটিতে এসে পৌছালাম দুপুর দেড়টায়। এখানেই হোটেলে লাঞ্চ করে আমরা মুন্ডা পাহাড় বীচে এলাম দুপুর তিনটেয়। বিস্তীর্ণ সমুদ্রতীরে ভালোভাবে বেড়ানো যায় এবং সমুদ্রে স্নান করাও যায়, কিন্তু জলে বেশী দূর যেয়ে সাঁতার কাটা বিপজ্জনক কারণ জলের তলায় বড় বড় পাথর ছড়িয়ে আছে। সমুদ্রের তীরে মুণ্ডা পাহাড়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দু'কিলোমিটার ট্রেক করে পাহাড়ে ওঠা যায়। এখান থেকে আমরা এলাম চিড়িয়াতাপু বীচে। পাখিদের স্বর্গরাজ্য এই বীচটি। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি দেখতে পেলাম। অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে ভরা বলেই মনে হয় নাম হয়েছে চিড়িয়াতাপু। হিন্দিতে পাখীকে চিড়িয়া বলে। বেলাভূমিতে শুকনো ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য গাছের ডালগুলিকে আকার দিয়ে বসার জায়গা করা আছে। এছাড়াও শুকনো গাছের ডালগুলিকে আকার দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমার পাখি বা অন্যান্য মূর্তিগুলি পর্যটকদের যথেষ্ট আনন্দ দেয়। সমুদ্রের জলে প্রবাল ও রঙবেরঙের মাছ এবং সামুদ্রিক প্রাণীর স্বর্গরাজ্য। ছুটির দিনে বহু লোক পোর্ট ব্লেয়ার থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে এসে সমুদ্রে স্নান করে পাখিদের গান শুনতে শুনতে খাবার খেয়ে  এখানকার অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখে বাড়ি ফিরে যান। এখান থেকে আমরা সানসেট পয়েন্ট এলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। সূর্যদেবতা তার উজ্জ্বল জ্বলন্ত তেজ থেকে ধীরে ধীরে ডিমের কুসুম বর্ণ ধারণ করে সিঁদুরে রঞ্জিত হয়ে এক সময় সমুদ্রের জলে ডুব দিয়ে চারিদিক অন্ধকার করে দিলেন। অবশ্য কিছুক্ষণ পরে শুক্লপক্ষে চাঁদের উদয় হলো। এখানের পথিপার্শ্বস্থ দোকানের চা বিস্কুট খেয়ে আমরাও ফিরে চললাম আমাদের হোটেলে। একটানা কয়েকদিন ঘোরার পরে বয়স জনিত কারণে আমাদের খুব ক্লান্ত লাগছে। আগামীকাল আমাদের যাওয়া নির্ধারিত আছে চাথাম 'স' মিল, সিপ্পিঘাটের ঔষধি বাগান, সামুদ্রিকা, নৃতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়াম এবং করবাইনস্ কোভ বীচ দেখতে যাওয়ার। 
                                                  পরবর্তী অংশ ষোড়শ পর্বে

Post a Comment

0 Comments