জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৪ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৪ / সালেহা খাতুন 

“এক দুই তিন করি শুল বছর যায়” - ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৯ ষোলো বছরের (প্রকৃত পক্ষে পনেরো বছর ছমাস)মণি একটা কাগুজে সার্টিফিকেট তো অর্জন করলো। কিন্তু সে কতটা খুশি হলো? পড়াশোনা করে কি একেবারে মাথা কিনে নিল? ক্লাসে ফার্স্ট সেকেণ্ড হতো বলে এই যে সোচ্চার ঘোষণা এই যে আত্মপ্রচার নিজেকে জাহির করা কেউ বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখলে তার অর্থ ধরতে পারবেন না। আসলে এ আমার আত্মকথা আত্মজীবনী। এখানে আমি সত্য কথা বলতে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

মানুষ হয়ে জন্মেছি ঠিকই কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জনের দীক্ষাও পেয়েছি পরিবারের কাছ থেকে সমাজের কাছ থেকে। বাবা বলতেন তাঁর পেশা শিক্ষকতা নেশা সমাজসেবা। রাজনীতি করেও দেশ সেবা করা যায়। সৎ রাজনীতিবিদ তিনি। অমলকাকু, শ্রীকান্তকাকু,রঘুকাকু এঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এই প্রতিষ্ঠায় আমার বাবার অনেক যত্ন ছিল। তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করতেন। দানধ্যানেও তিনি তুলনারহিত। তাঁর কথা বলে শেষ করা যাবে না। দু একটি উদাহরণ মাত্র দেবো। আমার বন্ধু সাগিরার এবং তাঁর মায়ের কণ্টকাকীর্ণ জীবনযাপন অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন তিনি। স্বামী পরিত্যক্তা সাগিরার মা ছোট্ট সাগিরাকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। আমাদের পাড়ার বিপত্নীক কয়সের চাচার সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়বার বিয়ে দিয়ে তাঁকে সংসারী করে তোলেন। সাগিরার পড়াশোনাসহ সমস্ত দায়ভার নেন কয়সের চাচা। মানুষের জন্য ভাবার শিক্ষা বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।

 কখনো কখনো কিছু দায়িত্ব পালনে আমার অনীহা দেখে আমাকে বলতেন অকৃতজ্ঞ হয়ো না। সত্যিই তো যে জীবন আমি পেয়েছি তা অজস্র মানুষের যত্নে গড়া। সেই অফুরন্ত মানুষের অফুরান ভালোবাসার মালা গাঁথতেই নেমেছি। ছোটোবেলার যে তীব্র শ্বাসকষ্ট ছমাস অন্তর আমাকে কাবু করে ফেলতো তার জন্য অনেক রকম ভাবেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো। বাবা তাঁর প্রিয় ছাত্রী হোমিওপ্যাথি ডাক্তার কল্যাণী ধোলের ওষুধ খাওয়াতেন। ডাক্তার কল্যাণী আমার বন্ধু অরুণাংশুর পিসি। পাড়াতে ক্লাব থেকে দাতব্যচিকিৎসালয় খুলেছিলেন সাহাবুদ্দিন দাদারা। আসতেন ডাক্তার জি পি গুপ্তা। তিনিও আমার যত্ন নিতেন। আর ছিলেন আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার মহাদেব দাস। এখনো মায়ের চিকিৎসা করেন। কয়েকবছর আগে আমাকে যখন ইনহেলার প্রেসক্রাইব করছিলেন আমি বলেছিলাম ডাক্তারবাবু ছোটোবেলায় আমাকে এটা দেননি কেন? তাহলে অতো কষ্ট পেতাম না। বললেন তখন এসব নাগালের মধ্যে ছিল না। বড়ো পিসিমা মেজোপিসিমা রাজহাঁসের গলার হাড়ের ছোটো টুকরো এনে মাকে দিতেন এই রোগ থেকে নিরাময়ের আশায়। অবধারিত অসুস্থতা পেরিয়ে পড়াশোনা তাই ফার্স্ট সেকেণ্ড হওয়াটা আমার কাছে অতোটা সহজলভ্য ছিল না। তাছাড়া বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্প, পৃথিবীর রোমাঞ্চকর শিকারকাহিনির মতো বইগুলো তো পেতে হবে।

মানুদার কাছে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরতে রাত হলে কোনো কোনোদিন বাবা না গেলে মানুদা এগিয়ে দিতেন। সেটা কিন্তু মানুষের ভয়ে নয়। রাস্তায় সাপের ভয়ে। মানুদাকে মাইনেও দেওয়া যেতো না। অনেকবার চেষ্টা করেছি। ফিরিয়ে দিতেন। কুদ্দুসবাবুও মাধ্যমিকের সময় কয়েকমাস মাইনে নেননি। টাকাগুলো হাতে গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন ফল কিনে খেয়ে নিবি। সামনে পরীক্ষা। শরীর ভালো রাখতে হবে। 
🍂

আর জয়নাল সাহেবের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কোনো অভিধায় বেঁধে দিতে আজও পারিনি। দুজনে দুজনের সুহৃদ। কলিগ হলেও একটা মধুর সম্পর্ক ছিল। তিনি ক্লাসের বাইরে আমাকে চার বছর যত্ন করে ইংরেজি পড়িয়েছেন। কোনোদিন এক পয়সা বেতন নেননি। স্কুল থেকে হেঁটে ফিরতে প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগতো। ফেরার পথে বন্ধুরা যেদিন থাকতো না স্যার তাঁর সাইকেলে করে ঘরে পৌঁছে দিতেন। স্যারের ক্লাসে একদিন আমার বন্ধুরা—অরুণ,রফিকুল,সন্দীপ,আসলাম আরো সবাই বই দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল। সেটা ছিল ক্লাস টেনের একটা দিন। স্যার ছিলেন ক্লাস টিচার। প্রথম ক্লাসটাই স্যারের। বললেন তোদের হলো কি? মুখ খোল। জোর করে সবার মুখ থেকে বই সরিয়ে দেখেন ছেলেগুলো সব বড়ো বড়ো লাল টিপ কপালে পরে আছে। প্রচণ্ড  বকুনি দিলেন। হাসি চেপে বললেন সব গোরু চোর সেজেছে। আমাদের ক্লাসে মেহেবুব আর মসিয়ার দুই ভাই একসাথে পড়তো। স্যার আমাদের গিভ আপ পুট আপ বিভিন্ন ফ্রেজ দিয়ে যখন বাক্য রচনা করতে দিতেন তখন ছোটো ভাই মসিয়ার লিখতো “মেহেবুব গিভ আপ হিজ ওয়াইফ,মেহেবুব পুট আপ হিজ ওয়াইফ” ইত্যাদি । এতো দুষ্টু ছিল বন্ধুরা যে শ্যামবাবু যখন অঙ্ক করাতেন তখন বোর্ডের নীচে জমা হওয়া চকের গুঁড়ো নিয়ে বিভিন্ন রকম কারসাজি করতো। বর্ষার দিনে ক্লাসরুমে প্রেয়ার হতো। আর প্রেয়ার শেষে বেঞ্চে বসতে গেলে পেছন থেকে বেঞ্চ সরিয়ে নিতো। ফলে সবাই হুড়মুড়িয়ে পড়তো। গোকুলবাবু কী হয়েছে বলে ছুটে এলে বলতো স্যার ভূমিকম্প হয়েছে।ওদের কীর্তি বলে শেষ করা যাবে না সলিলবাবু তখন নতুন জয়েন করেছেন। স্পোর্টস এর জন্য সলিলবাবুর কাছে নাম জমা দিতে হবে। ওরা সব নিজেদের নতুন নতুন নাম দিয়ে স্যারের কাছে জমা দিল। একটা নাম মনে আছে কুতুব নিজের নাম দিয়েছিল রতু মাল। মাঠে নাম ঘোষণার সময় সব ধরা পড়ে গেল। একবার স্কুলে ম্যাজিক শো হয়। সেদিন ম্যাজিশিয়ান আমার বন্ধু এবাদুরকে দিয়ে ডিম পাড়িয়ে ছিল তো এবাদুরের নাম হয়ে গেল ডিম। রানিহাটি বাজারে বাবাকে বন্ধুদের কেউ বরবটি কিনতে দেখেছিল, সেখান থেকে ওরা আমার নাম দিল বরবটি। এই যে আনন্দ হুল্লোড়ের দিন স্কুল জীবনে পেয়েছি সেগুলি কি অমূল্য নয় ?
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments