জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান -১৬ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান                                  
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      

ষোড়শ পর্ব    

পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ   

পরের দিন আমরা সকাল সাড়ে আটটায় হোটেল থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম ওয়ান্ডুরের পথে পনেরো কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সিপ্পিঘাট কৃষি ফার্মে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। ৮০ একর পরিমিত জায়গার উপরে বিভিন্ন মসলা, ঔষধি এবং কফির চারা প্রস্তুত করে, বড় গাছগুলির পরিচর্যা করে ফুল, ফল ও বীজের থেকে বিভিন্ন ঔষধের উপকরণ, মসলা ও কফি ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করা হয় এবং ভারতের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। সকাল ন'টায় কৃষি ফার্ম খোলা হয়। এখানে আমরা লবঙ্গ এবং এলাচের চারা কিনলাম। আগামীকাল আমাদের ফিরে যাওয়া হবে, সেইজন্য চারাগুলি কিনলাম যাতে আমাদের ওখানের আবহাওয়াতে চারাগুলি বাঁচিয়ে রাখতে পারি। কৃষি ফার্মের আরেকটি আকর্ষণ বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি, যেগুলি এসেছে হিমালয়ের ওপারের সুদূর সাইবেরিয়া বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে। এখানে এক ঘন্টা কাটিয়ে আমরা জংলিঘাট পেরিয়ে চললাম এশিয়ার বৃহত্তম ও প্রাচীন কাঠ চেরাই কল চাথাম 'স' মিল দেখতে। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশদের হাতে গড়া এই কাঠ চেরাই কলটি। সমুদ্রের বুকে চাথাম সেতু পেরিয়ে চাথামে পৌঁছে প্রথম দর্শনে দেখতে পেলাম বিরাট বিরাট কাঠের গুঁড়িগুলিকে যেখানে বিভিন্ন আয়তনে চেরাই করা হচ্ছে। প্রথমে আন্দামানের জঙ্গল থেকে বিরাট আকারের যে গুঁড়িগুলি সমুদ্রপথে আনা হয় সেগুলিকে জাহাজ থেকে নামিয়ে গুদামজাত করা হয়। সেখান থেকে গুঁড়িগুলি যন্ত্রের সাহায্যে কাঠ চেরাই কলে নিয়ে এসে বিভিন্ন আয়তনে চেরাই করা হচ্ছে। এই চেরাই করা বড় গুঁড়িগুলি পুনরায় অন্য একটি যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন মাপে চেরাই করার পরে কারখানার অন্য একটি অংশে পাঠিয়ে বিভিন্ন শিল্পজাত দ্রব্য ও মডেল তৈরি করে বিক্রয়ের জন্য এখানের বিক্রয় কেন্দ্রে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী কাঠগুলিকে চেরাই করে পুনরায় সমুদ্রপথে বাজারজাত করা হয়। এখান থেকে দূরে হাড্ডো জেটিতে দেখতে পাচ্ছি একটি বিরাট আয়তনের জাহাজকে। কাঠ চেরাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা বনবিভাগের মিউজিয়াম প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্রে গেলাম ২০০৬ সালে এই মিউজিয়ামটি বনদপ্তর থেকে স্থাপন করা হয়েছে। বিরাট আয়তনের একটি ঘরে কাঠের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি, চেয়ার-টেবিল, সোফা সেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস সাজানো আছে এবং প্রত্যেক দ্রব্যের দাম লেখা আছে সম্ভাব্য ক্রেতার সুবিধার্থে। এই জিনিসগুলি আন্দামানের জঙ্গলের চন্দন, পাদুক, গর্জন প্রভৃতি মূল্যবান কাঠ দিয়ে তৈরি। আমরা একটি গণেশ মূর্তি 'শোপিস' আন্দামানের স্মারক হিসেবে কিনলাম। এছাড়াও মিউজিয়ামের দেওয়ালে বিভিন্ন ফটোর সাহায্যে আন্দামানের ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি, জঙ্গল থেকে হাতির সাহায্যে কিভাবে বিরাট আকারের কাঠের গুঁড়ি গুলি সমুদ্রের ধারে আনা হয় এবং সেখান থেকে জলযানের সাহায্যে কাঠ চেরাই কলে আনা হয় সেগুলি দেখে আমাদের একটি সম্যক ধারণা উপলব্ধি হলো। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে ব্রিটিশ শাসনাধীনে আন্দামানের মহামূল্যবান পাদুক কাঠ দিয়ে ইংল্যান্ডেশ্বরীর বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের আভ্যন্তরীণ দেয়ালের উপরে কাঠের অলংকরণ করা হয়েছিল। জাপানীদের হাত থেকে আন্দামান পুনরুদ্ধারের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এখানে ব্রিটিশ বাহিনীর বোমা নিক্ষেপের ফলে যে বিরাট গর্ত তৈরি হয়েছিল সেটি বর্তমানে জল দিয়ে ভর্তি করা আছে। সেটি দেখার সুযোগ হলো। এর পাশেই জাপানিদের নির্মিত বাঙ্কারটি দেখারও সুযোগ হলো। 
🍂

আন্দামানের  পোর্ট ব্লেয়ারের সমস্ত দর্শনীয় স্থান দেখার ফাঁকে চাথাম 'স' মিলে যেয়ে দেখলাম একটি দরজায় নেম প্লেট লাগানো আছে ডাক্তার রতন চন্দ্র কর, ডেপুটি ডাইরেক্টর, ট্রাইব্যাল হেলথ ডিপার্টমেন্ট। নামটি দেখে খুব কৌতুহল হলো কারণ ডাক্তার রতন চন্দ্র কর ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় তেইশ বৎসর জারোয়া অধ্যুষিত দক্ষিন ও মধ্য আন্দামান অঞ্চলে বিশেষতঃ কদমতলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থেকে তাদের চিকিৎসা পরিসেবা দিয়েছেন এবং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশে যেয়ে তাদের প্রায় প্রতিটি কুটিরে গেছেন এবং তাদের সমাজ ব্যবস্থা নিজের চোখে দেখেছেন এবং সে সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এছাড়াও ওঁর লেখা 'আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া' বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। দরজা ঠেলে ভিতরে যেয়ে ওনার সাথে আলাপ করে আমার পরিচয় দিয়ে আমি জানতে চাইলাম জারোয়াদের সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছেন সেটা যদি বলেন। মেদিনীপুরে বাড়ী শুনে উনি বললেন 'আপনিতো আমার জেলারই মানুষ এবং আমারই প্রায় সমবয়স্ক'। উনি আমাকে বিস্তারিতভাবে জারোয়াদের সম্বন্ধে যা জেনেছেন বা ওনার অভিজ্ঞতা বলবেন বলে পরেরদিন সকালে যেতে বললেন। 
চাথাম স মিল থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্থল হাড্ডো রোডের আন্দামান টিল হাউসের নিকটে সাবমেরিন মিউজিয়াম কিন্তু তার পূর্বে দুপুরের লাঞ্চ করলাম এখানে একটি হোটেলে। ভারতীয় নৌবাহিনীর দ্বারা স্থাপিত এই মিউজিয়ামে আন্দামানের সামুদ্রিক প্রাণী জগৎ পরিবেশ রক্ষা জীবজন্তু গাছপালা আদিম অধিবাসীদের জীবনযাত্রার বিস্তৃত বর্ণনা লেখা ও মডেলের সাহায্যে রাখা আছে। এছাড়াও নিকোবরের সমুদ্রতীরে ভেসে আসা একটি বিরাট আকার নীল তিমির শরীরের কাঠামো বাইরে একটি শোকেসে সযত্নে রাখা আছে। পাঁচটি গ্যালারিতে সমগ্র মিউজিয়ামটি - অতীত ইতিহাস, ভূবৈচিত্র, সামুদ্রিক জীবনযাত্রা, সামুদ্রিক প্রাণী জগৎ এবং আদিম অধিবাসীদের সম্পর্কিত। বিভিন্ন প্রজাতির প্রবালও এখানে দেখা গেল। সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে সর্বসাধারণের জন্য। এখান থেকে পরের গন্তব্য স্থল মহাত্মা গান্ধী রোড এনথ্রপলজিক্যাল মিউজিয়াম। আন্দামানের অতীতের জীবনযাত্রার প্রদর্শনী, আন্দামানের আদিম আদিবাসী - জারোয়া, গ্রেট আন্দামানিজ, ওঙ্গি, শম্পেন, নিকোবরীজ এবং সেন্টিনেলিজদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য অর্থাৎ তাদের পারিবারিক জীবনযাত্রা, শিকার প্রণালী, বাসস্থান, অস্ত্রশস্ত্র এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, শরীরের উর্ধ্বাঙ্গ নিম্নাঙ্গের পাতার তৈরি আবরণে তাদের তৈরি শিল্প কর্ম এবং সাজসজ্জার দ্রব্যাদির লিখিত বিবরণ এবং ফটো ও মডেলের আকারে দেখানো হয়েছে। এক কথায় বলা যেতে পারে আন্দামানে আগত পর্যটককে আন্দামানের আদিম জনজাতি সম্বন্ধে সরকারি নৃতত্ত্ব বিভাগের এটি একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র বা জানানোর সার্থক প্রয়াস। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মিউজিয়ামটি। এটি সকাল ন'টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে অবশ্য দুপুর একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চের জন্য এবং প্রতি সোমবার বন্ধ থাকে। নৃতত্ত্ব বিভাগের মিউজিয়াম দেখে সেলুলার জেলকে বাঁ দিকে রেখে রাজীব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স, মেরিনা পার্ক,ও রামকৃষ্ণ মিশনের পাশ দিয়ে সোজা রাস্তা ধরে আমরা যেয়ে আমাদের শেষ গন্তব্য স্থল কারবাইনস্ কোভ বীচে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে বিকেল পাঁচটা। সৈকতের একদিকে নীলসমুদ্র এবং অপরদিকে নারকেল গাছের সবুজ বনানী। সৈকতে যাওয়ার পথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীদের তৈরি বাঙ্কার দেখে সর্প উদ্যানে গেলাম এবং সেখানে বিষাক্ত সব সাপেদের দেখার সুযোগ পেলাম। সৈকতে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে সূর্যাস্ত দেখে আমরা ফিরে চললাম। এখানেও বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক খেলা যেমন স্কুবা ডাইভিং, জেট স্কিয়িং প্রভৃতির সুযোগ আছে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই সামুদ্রিক খেলাগুলি বন্ধ থাকে। এছাড়াও সমুদ্রসৈকতে বিভিন্ন হোটেল ও রেষ্টুরেন্টের আধিক্য। 
                                                     পরবর্তী অংশ সপ্তদশ পর্বে

Post a Comment

0 Comments