মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬৬
ক্ষুদিরাম বসু (শহীদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, মোহবনি)
ভাস্করব্রত পতি
"একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার ধারে মা গো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম
আর এক ইংল্যান্ড বাসী।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
শনিবার বেলা দশটার পরে
জর্জকোর্টে তে লোক না ধরে মা গো,
হলো অভিরামের দ্বীপজ্বালান মা
ক্ষুদিরামের ফাঁসি।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি
রইল মা তোর বেটা বেটি মা গো,
তাদের নিয়ে ঘর করিস মা
বৌদের করিস দাসী।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
দশ মাস দশ দিন পরে
জন্ম নিব মাসীর ঘরে মা গো,
তখন যদিনা চিনতে পারিস
দেখবি গলায় ফাঁসি।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী।
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। ---"
তারিখটা ২৭ শে শ্রাবণ ১৩১৫। ১৯০৮ এর ১১ ই আগস্ট। বিহারের মুজফ্ফরপুর জেল। ভোর ৩.৫৫। ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। এবার বিদায় দিতে হবে। জল্লাদ এসে ঢেকে দিল মাথা। গলায় পরিয়ে দিল দড়ি। নির্লিপ্ত ক্ষুদিরামের প্রশ্ন, 'ফাঁসির রজ্জুতে মোম দেওয়া হয় কেন?' তাঁর শেষ জিজ্ঞাসার কোনও উত্তর অবশ্য মেলেনি। কেবল হিমশীতল মৃত্যু স্পর্শ করে গিয়েছিল মেদিনীপুরের দামাল ক্ষুদিরাম বসুকে। আজও সেই ফাসির মঞ্চ রক্ষিত রয়েছে বিহারের মুজফফরপুরে জেলের মধ্যে। এখানকার শাস্তিপ্রাপ্ত আবাসিকদের কাছে এই ফাঁসিস্থল আজ তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত। একসময় যেখানে মেদিনীপুরের বীর সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
সারা ভারতের কত ধরনের অপরাধী এখানে সাজা খাটছে। কিন্তু একশো বছরের বেশি সময় আগে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে তৎকালীন ব্রিটিশদের চোখে 'সন্ত্রাসবাদী' আখ্যা পাওয়া বিপ্লবীকে এইসব অপরাধীরা 'মসীহা'ই ভাবেন। দেবতার আসনে বসিয়েছেন মুজফ্ফরপুর জেলের আসামীরা। ঠিক যে স্থানে ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা তাঁরা ফুল, ধুপ দেন! ফাঁসিস্থলের দেওয়ালে লেখা - "অমর শহীদ ক্ষুদিরাম বোস ফাঁসিস্থল।" তার নিচে চুন দিয়ে লেখা "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী" প্রতি বছর ১১ই আগস্ট ভোরে উৎসুক জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয় মজফ্ফরপুর জেলের মূল দরজা। প্রচুর মানুষ সেদিন যান ফাঁসিস্থলে। ক্ষুদিরামের স্মৃতিধন্য ফাঁসিস্থল এবং ক্ষুদিরামকে সম্মান জানানো হয় এই একটি বিশেষ দিনে।
ফাঁসিস্থলের বাম দিকে একটা নিম ও বেল গাছ রয়েছে। সামনে প্রশস্ত জায়গা। নিরাপত্তার কারণে ফাঁসিস্থলের পাটাতনের ওপর টিন দিয়ে ঢাকা। যে কাঠে দড়ি ঝোলানো হতো, সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। জল্লাদের ‘লিভার’টিও ভাঙা। মোটামুটি ৭-৮ ফুট উঁচু। ফাঁসিস্থলের বাঁদিকে জেলের গুদামঘর। আর ডানদিকে মহিলা আসামীদের জন্য সেল ‘লক্ষ্মীবাঈ খণ্ড’। জেলের পূর্ব দিকে ক্ষুদিরামের সেই সেল এখনও আছে। মোট ৬ টি সেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। সেগুলি তালাবন্ধ থাকে। ছাদ চুঁইয়ে বর্ষার জল জমে আছে ক্ষুদিরামের ঐতিহাসিক সেলে। সারানোর উদ্যোগ নেই।
ক্ষুদিরামের পর এখানে আর কোনো 'আসামী'কে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। সেদিন ফাঁসির ঠিক আগে জেল কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি ছবি তুলে রেখেছিল ক্ষুদিরামের। সেই ছবিই আজ আমরা দেখি। কিন্তু কে তুলেছিল সেই ছবি? তৎকালীন 'ওরিয়েন্টাল স্টুডিও'র শৈলেন মুখার্জির নাম কারও জানা নেই আজ।
ক্ষুদিরামের মৃতদেহ এল জেলের বাইরে। খাটিয়ায় শায়িত। পাশে তখন ক্ষুদিরামের হয়ে আইনী যুদ্ধের শরিক কালীদাস বসু। অন্তিমের বন্ধু। দেহ চলছে গণ্ডক নদীর পাড়ে চান্দোয়াড়া ঘাটের দিকে। দাহ করা হল সেখানে। সারা পথ জুড়ে তখন মুজফ্ফরপুরের মানুষের ভিড়। জ্বলে উঠল বীর সেনানীর দেহ।
আজ থেকে শতবর্ষের অধিক সময় আগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী যে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সুদূর বিহারের মুজফ্ফরপুরে, তা আজ সবারই জানা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দুই ১৮ - ১৯ বছরের অকুতোভয় বাঙালী যুবক ক্ষুদিরাম বসু ওরফে দুর্গাদাস সেন এবং প্রফুল্ল চাকী ওরফে দীনেশচন্দ্র রায়ের আত্মবলিদান আজও আমাদের রোমাঞ্চিত করে। গর্বিত হয়ে উঠি। শ্রদ্ধায় মাথা নত করি। সেদিনের সেই অকুতোভয় ঘটনার প্রেক্ষাপট আরো পূর্বের।
১৮৮৯ এর ৩ রা ডিসেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের হবিবপুরে (মতান্তরে মোহবনি) জন্মগ্রহণ করেন ক্ষুদিরাম। বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু এবং মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী। তিন দিদি অপরূপা, সরোজিনী এবং ননীবালা। অপরূপা দেবী ছোট্ট ক্ষুদিরামকে তিন মুঠো খুদের বিনিময়ে কিনেছিলেন বলেই নাম হয় 'ক্ষুদিরাম'। সাত বছর বয়সে জামাইবাবু অমৃতলাল রায় তাঁকে ঘাটালের হাটগেছ্যার গিরীশ মুখার্জির পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। এরপর ১৯০১ সালে তমলুক হ্যামিল্টন হাইস্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। এখানে ছিলেন ১৯০৪ পর্যন্ত। কিন্তু অমৃতলাল বাবু তমলুক থেকে মেদিনীপুরে বদলি হয়ে যেতেই ক্ষুদিরাম চলে গেলেন মেদিনীপুর। ভর্তি হলেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে। এখানে তিনি সংস্পর্শ পান হেমচন্দ্র কানুনগো এবং জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে। তাঁদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হন দেশপ্রেমের মন্ত্রে। বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে লাঠি খেলা, ছুরি খেলা, মুষ্টিযুদ্ধ, গুলি ছোঁড়াতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তমলুকের রক্ষিত বাটী কিংবা মুগবেড়িয়ার নন্দ পরিবারে ছিল নিয়মিত যাতায়াত। যুবসমাজকে বৈপ্লবিক মন্ত্রে দীক্ষিত করতেই অকুতোভয় ক্ষুদিরামের কর্মসূচি জানলে বিস্মিত হতে হয়।
১৯০৬ এর ১৬ ই মে ক্ষুদিরাম গ্রেপ্তার হন রাজদ্রোহের অপরাধে। এটিই সম্ভবত ভারতের প্রথম রাজদ্রোহের মামলা ছিল। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯০৭ এ হাটগেছ্যায় মেলব্যাগ লুন্ঠনে অংশগ্রহণ করেন। এর সাথে মেদিনীপুরের বিভিন্ন প্রান্তে তমলুক, মুগবেড়িয়া, বায়েন্দা, ফুলকুসুমা, হেঁড়িয়া, আসনান, ভগবানপুর, ইত্যাদি স্থানে গিয়ে বিপ্লবীদের গোপন আখড়ায় শুরু করলেন নানাবিধ কর্মসূচি। ১৯০৮ এ কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব পেলেন ক্ষুদিরাম। কিন্তু তাঁকে বাঁচাতে কিংসফোর্ডকে বদলি করা হয় মুজফফরপুরে। অগত্যা ক্ষুদিরাম বসুও ১৯০৮ এর ১৮ ই এপ্রিল মেদিনীপুর থেকে রওনা দিলেন মুজফফরপুর। সঙ্গী প্রফুল্ল চাকী। সেখানে গিয়ে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী উঠেছিলেন মতিঝিলে কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মশালায়। সেই ম্যানেজারের বাড়ি আজ আর নেই। লোকে বলে 'পুরাণী ধর্মশালা'। এখন নাম 'মেহেতা ওয়ার্ড এস্টেট'।
এরপর কয়েক দিন সেখানে নানা ভাবে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন ইউরোপীয়ান ক্লাব থেকে কিংসফোর্ড আসবেন তাঁর বাংলোতে। সেই সময় তাঁকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়। দিনটা ছিল ১৯০৮ এর ৩০ শে এপ্রিল, রাত ৮ টার একটু পরেই। একটা গাছের আড়াল থেকে ফিটন গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়লেন দুজন। দুর্ভাগ্য যে ঐ গাড়িতে ছিলেননা কিংসফোর্ড। ছিলেন দুই নিরপরাধ মহিলা। মারা গেলেন ব্যারিস্টার প্রিঙ্গলে কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা। ছিটকে পড়লেন ফিটনের কোনোওয়ান কালীরাম এবং সহকারী সঙ্গতরাম। পরবর্তীতে অনেক মানুষ সেই গাছটায় প্রণাম করতেন এবং শ্রদ্ধা জানাতেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে সেই গাছ কেটে কোনো এক প্রশাসনিক আধিকারিকের বাড়ির ফার্নিচার তৈরি হয়েছে।
যাইহোক, ঘটনার পরের দিন ১ লা মে ওয়াইনি থেকে গ্রেফতার হন ক্ষুদিরাম। আর ২ রা মে মোকামাঘাট স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই নিজের বন্দুক থেকে গুলি ছুঁড়ে আত্মহত্যা করেন প্রফুল্ল চাকী (জন্ম - ১৮৮৮ র ১০ ই ডিসেম্বর)। তিন মাস বিচার চলার পর ১৯০৮ এর ১১ ই আগস্ট ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ নং ধারা অনুযায়ী মুজফফরপুর জেলের মধ্যেই ফাঁসি হয়ে যায় মেদিনীপুরের বীর সন্তান ক্ষুদিরাম বসুর।
এখনও সেই ওয়াইনিতে পুশা রোড চক এ রয়েছে সেদিনের অশোক এবং বটগাছটা। আম গাছটা নেই। ক্ষুদিরামের ধরা পড়া সেই স্থানে একটা মূর্তি শুধু বসানো আছে তাঁর। গত ২০০৩ সালে ১৯ শে অক্টোবর নীতীশ কুমার সেই স্টেশনের নামকরণ করেন 'ক্ষুদিরাম বসু পুশা'। আর মোকামাঘাট স্টেশনে এখনও কোনো স্মারক নেই প্রফুল্ল চাকীর। অথচ এই মোকামা স্টেশনে ক্ষুদিরামের সহযোগী প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন। সেই স্টেশনের নাম বদল করা হয়নি আজও। মুজফ্ফরপুর স্টেশনের নাম বদলে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর নামে করার দাবি ‘ক্ষুদিরাম বসু স্মারক সমিতি'র। সেটিও হয়নি এখনও। তবে মুজফফরপুর কারাগারের নাম হয়েছে ক্ষুদিরাম বসুর নামে।
ক্ষুদিরাম বসু নামটিই আজ বাংলার যুবসমাজের কাছে অনুপ্রেরণার অন্য নাম। যে নাম মনের গভীরে এনে দেয় উত্তেজনা। যে কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার অমোঘ খিদে। সেসময় ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির ঘটনা সারা ভারত জুড়ে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর মনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে দিয়েছিল বলা যায়। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর "ক্ষুদিরামের ফাঁসি" কবিতায় লিখেছেন --
"সে এক অদ্ভুত রাত্রি! থমথমে রক্তমাখা মুখগুলি জ্বরে
অকথ্য প্রলাপ বলে, দীপ-নেভা অন্ধকার বিছানায়, ঝড়ে
বুকগুলি তোলপাড় । জানালায় জল্লাদের হাতের মতন
কালো হাওয়া নড়ে চড়ে, হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে । নেকড়ের গর্জন
নগরেও শোনা যায় ; কুয়াশায় ঝাঁপ দেয় সারিবদ্ধ বাঘ—
সে এক অদ্ভুত রাত্রি ; ক্লান্তির শিয়রে ক্রান্তি লেখে পূর্বরাগ!
সেই রাত্রে ফিস্ ফিস্ রুগী আর নার্সের অস্ফুট গলায়
ভয়, শুধু ভয় কাঁপে, তারপর ধীরে ধীরে কেটে যায় ভয়—
কে যেন নির্ভীক হাসে। ভীষণ কঠিন হাসি প্রত্যেক দরজায়
বিবর্ণ রাত্রির চোখে চোখ রাখে, কথা বলে, ছড়ায় বিস্ময়।
অন্ধকারে সেই হাসি আলো যেন, জ্বেলে দিল সমস্ত বন্দর ;
ঘরে ঘরে যুবতীরা খিল তোলে, যুবকের ছেড়ে যায় জ্বর।
ধীরে রাত্রি স’রে যায় । শুদ্ধ ভোরে স্নান সেরে বাইরে এলাম…
ফাঁসির মঞ্চে কাল হেসে গেছ, গেয়ে গেছ, তুমি ক্ষুদিরাম!"
0 Comments