গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত গুপো সন্দেশ: শতাব্দী প্রাচীন এক মিষ্টির সফরনামা
প্রসূন কাঞ্জিলাল
বাঙালি মানেই মিষ্টি। আর বাঙালির মিষ্টি সে তো জগৎ বিখ্যাত। বাঙালির হাতে বানানো মিষ্টি যেমন হয় নরম তুলতুলে তেমনি হয় রসে টইটম্বুর। স্বাদে গন্ধে বাংলার মিষ্টির আলাদাই কদর রয়েছে বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীতে এমন কোন বাঙালি নেই যিনি মিষ্টি পছন্দ করেন না। বাঙালির যে কোনো অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি অন্নপ্রাশন,জন্মদিন, পুজো অর্চনায় মিষ্টি ছাড়া ভাবাই যায় না।
পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টির একটা অন্য বৈচিত্র রয়েছে। স্থান বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টির পৃথক পৃথক স্বাদ লক্ষ্য করা যায়। কোথাও রসগোল্লা বিখ্যাত তো কোথাও ল্যাংচা বা কোথাও জিলিপি। যেমন
কলকাতার রসগোল্লা, বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা আবার জয়নগরের মোয়া আরও অগুনতি সুস্বাদু মিষ্টির ভান্ডার এই বাংলা।
তবে এই আলোচনার বিষয় গুপ্তিপাড়ার 'গুপো সন্দেশ', তার উৎস, নামকরণ ও প্রস্তুতের পদ্ধতি ইত্যাদি।
প্রায় বারশ’ বছরের পুরোনো বাংলা কবিতায় আছে –
‘‘ওগগ্র ভত্তা রম্ভা পত্তা গাইক্ক ঘিত্তা দুগ্ধ সজত্তা ৷
নালি গচ্ছা মুল্লা মচ্ছা দীজ্জই কন্তা খাএ পুণ্যবন্তা৷’’
অর্থাৎ, গরমাগরম ভাত, যা পরিবেশন করা হয়েছে কলার পাতায়, তার সঙ্গে রয়েছে গরম গাওয়া ঘি ও জ্বাল দেওয়া ঘন দুধ, নাল্তে শাক আর রয়েছে মৌরালা মাছ৷ কান্তা দিচ্ছেন, আর পুণ্যবান খাচ্ছেন৷ লক্ষণীয় যে বারশ’ বছরের আগেকার বাঙালীর খাদ্য সম্পর্কে রুচি আজও পাল্টায়নি।
ইতিহাস বলছে গুপো সন্দেশ বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড সন্দেশ নামেও পরিচিত এবং উল্লেখ্য গুপ্তিপাড়ার গুপো সন্দেশের সৃষ্টির কাহিনী সিপাহি বিদ্রোহের থেকেও পুরানো।
হাওড়া থেকে ৭৫ কিলমিটার দূরত্বে হাওড়া-কাটোয়া লাইনে পড়ে গুপ্তিপাড়া স্টেশন। হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে যেতে লাগে প্রায় দু ঘন্টা। সড়ক পথে যেতে হবে কল্যাণী একস্প্রেসওয়ে পেরিয়ে ঈস্বর-গুপ্ত সেতু ছাড়িয়ে অম্বিকা-কালনার রাস্তায়।
হুগলি জেলার এক প্রাচীন জনপদ এই গুপ্তিপাড়া। প্রথম বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্ম এই গুপ্তিপাড়াতেই। ধর্মচর্চার পীঠস্থান গুপ্তিপাড়াকে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' বলা হত। ক্রমে 'গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী', তার থেকে 'গুপ্তপল্লী' এবং পরিশেষে ‘গুপ্তিপাড়া’ নাম হয়। আর কথিত আছে এই গুপ্তিপাড়া নাকি সন্দেশের আঁতুড়ঘর! এখানেই প্রথম তৈরী হয় মাখা সন্দেশ।
🍂
মনে আছে কি আপনাদের,সেই কবিয়াল এণ্টনি ফিরিঙ্গীর সামনে দাঁড়িয়ে গাইছেন আরেক বিখ্যাত কবিয়ালঃ
আমি সে ভোলানাথ নইরে সে ভোলানাথ নই,
আমি ময়রা ভোলা হরুর চেলা বাগবাজারে রই
আমি যদি সে ভোলানাথ হই,
সবাই পূজে ভোলার চরণ
আমার চরণ পূজে কই...
হ্যাঁ, এখানেই জন্মেছিলেন বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা। গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারের কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে ভোলা ময়রার দোকান ও ভিটে।
কিন্তু মজার বিষয়, ভোলা ময়রার কোনও মিষ্টির দোকান ছিলই না। ভোলা ময়রার বাবা ছিলেন মিষ্টির ব্যবসায়ী। ভোলার কোনওদিনই মিষ্টির প্রতি নজর ছিল না। যত নজর ছিল ওই কবিগানেই। তরুণ বয়সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান! তারপর বাড়ির লোকেরা আর তাঁকে স্বীকার করেননি। বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন বাগবাজারেই। গুপ্তিপাড়ায় তাঁর আদিবাড়ি যেখানে ছিল, সেই জমিটা বিক্রি হয়ে গেছিল। এখন ওখানে ব্রাহ্মণরা থাকেন। নতুন করে বাড়িঘরও হয়েছে। ভোলা ময়রার আর কোনও স্মৃতিই নেই গুপ্তিপাড়ায়।
ভোলা ময়রার কোনও চিহ্ন গুপ্তিপাড়া ধরে রাখতে না পারলেও, এখনও ধরে রেখেছে এখানকার একটি জনপ্রিয় ঐতিহ্য! গুপ্তিপাড়ার গুপো সন্দেশ।
গুপ্তিপাড়ার বাসিন্দাদের দাবি প্রথম মাখা সন্দেশের আবিষ্কার হয়েছিল এখানেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে এই মাখা সন্দেশকে বিশেষ আকার দিয়েই তৈরি হয় গুপো বা গুঁফো সন্দেশ। মিষ্টির এই ধরনের নামকরণের পিছনে অনেক মত আছে। অনেকে বলেন, গুপ্তিপাড়ার নাম থেকেই এই সন্দেশের নাম হয় গুপো সন্দেশ। লোকমুখে উচ্চারণের বিকৃতির জন্য গুপো সন্দেশ পরিচিতি পায় গুঁফো সন্দেশ হিসেবে। আবার এমনও শোনা যায় যে সন্দেশটি খাবার সময় গোঁফে লেগে যায় বলে এর নাম গুঁফো সন্দেশ।
কলকাতা যখন পুরোপুরি তৈরি হয়নি, ছিল না রেলপথও, তখন থেকেই গুপ্তিপাড়া থেকে নৌকা করে সন্দেশ যেত বিভিন্ন জায়গায়। গুপো সন্দেশের পাশাপাশি এখানে বানানো হত মুড়কি, বাতাসা, মাখা সন্দেশ, বাটা সন্দেশ ইত্যাদি।
কিন্তু মানুষের কাছে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে এই গুপো সন্দেশ। নানা উৎসবে অনুষ্ঠানে কলকাতা মহানগরীর অভিজাত মানুষের চাহিদা পূরণ করত গুপ্তিপাড়ার এই মিষ্টি। তাই গুপো সন্দেশকে বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড মিষ্টি বলেও মনে করা হয়। বা বলা যেতে পারে প্রথম সিগনেচার ডিশ।
এখনও যে কলকাতায় গুপো সন্দেশ যায় না, তেমনটা নয়! কিন্তু চাহিদা কমে এসেছে। বংশ পরম্পরায় কিছু বাঁধা খদ্দের এখনো রয়েছেন, যাঁরা এখনো কোনও অনুষ্ঠানে বা উতসবে এখান থেকেই গুপো সন্দেশ নিয়ে যান কলকাতায়।
এই সন্দেশ পাক করা ছানা থেকে প্রস্তুত করা হয়। দু'টি মন্ডকে হাত দিয়ে পাশাপাশি চেপে লাগানো হয়। দেখে মনে হয় এক জোড়া গোলাকৃতি সন্দেশ। তাই এই সন্দেশের আরেক নাম জোড়া সন্দেশ। গুপো সন্দেশের বৈশিষ্ট্য হল যে এটি শুধুমাত্র গরুর দুধের ছানা থেকেই তৈরী হয়।
কীভাবে বানানো হয় এই সন্দেশ? বিশাল কড়াইয়ে ছানা পাক দিয়ে, সেই ছানা কাপড়ে ভরে কাঠ দিয়ে পিটিয়ে বাড়তি জল বের করে দেওয়া হয়। সেই পেটানো ছানা হাতে পাক দিয়ে জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় গুপো সন্দেশ। শীতকালে ছানায় মেশানো হয় গুড়, অন্যসময় চিনি।
এখন গুপ্তিপাড়ায় কয়েকটা মাত্র দোকানই রয়েছে, যারা এখনও গুপো সন্দেশ বানায়।
গুপো সন্দেশের মূল উপাদান হলঃ গরুর দুধের ছানা
চিনি বা খেজুর গুড়।গুপো সন্দেশ বানাতে সাধারণত খেজুর গুড় ব্যবহার করা হয়। তাই সন্দেশ প্রস্তুতকারকরা শীতকালে সারা বছরের জন্য খেজুর গুড় মজুত করে রাখেন। গুড়ের পরিবর্তে চিনিও ব্যবহার করা হয়। আদিতে মাখা সন্দেশ থেকে গুপো সন্দেশ তৈরী হলেও, বর্তমানে মাখা সন্দেশের থেকে গুপো সন্দেশের পাক অনেকটাই আলাদা।
গুপো সন্দেশের সৃষ্টিকর্তা কে ছিলেন বা এর ঠিকঠিক জন্মসাল কি তা জানা যায় না। তবে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে গুপো সন্দেশ প্রস্তুত হত, এমন তথ্য আছে।
আসলে গুপ্তিপাড়াতেও এখন নানা ধরণের সন্দেশের রমরমা। তার ফলে কমছে গুপোর চাহিদা। এই সন্দেশের সাবেকি ঐতিহ্য বজায় রাখা এখন প্রায় বিশ বাঁও জলে। কারণ পরবর্তী প্রজন্মের এই সন্দেশের ব্যবসার প্রতি আগ্রহের অভাব।
তাই এই মিষ্টি প্রচারের আলোক থেকে অনেক ক্রোশ দূরে। তবে অনলাইনে এই মিষ্টি বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হয়েছে বেশ কিছু সংস্থা। কিন্তু সময় মতো সেই চাহিদার যোগান কতটা সম্ভব তার উপর নির্ভর করছে এর ব্যবসায়িক সাফল্য ও ভবিষ্যৎ।
যাইহোক, টিঁকে থাকার লড়াই তো সব ক্ষেত্রেই আছে, এখানেও ব্যতিক্রম নয় - তবে তার মধ্যেও স্বাদের সন্ধানে খোদ গুপ্তিপাড়ায় পাড়ি দেওয়া যেতেই পারে।।
তথ্যসূত্র ------
১।"The Secrets of Guptipara"। কলকাতা অন হুইল্স্। তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৬।
২। "Metamorphosis of the Bengali taste"। BangaliNET । তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৬।
৩। "গুপ্তিপাড়ার পুজো"। প্রকৃতি পর্যটন। পর্যটন দপ্তর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৬।
৪। "Next weekend you can be at ... Guptipara"। দ্য টেলিগ্রাফ (ইংরেজি)। রঙ্গন দত্ত। অবিপি গ্রুপ। তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
৫। "গুপ্তিপাড়ার গুপ্ত কথা"। পলাশ মুখোপাধ্যায়।আবেক্ষণ। তারিখ ৯ অক্টোবর ২০১৮।
৬। "ভোলা ময়রার জন্মভিটার সন্ধানে"। সুজয় চক্রবর্তী। সকালের বার্তা। তারিখ ২৩ অক্টোবর ২০১৬।
৭। "মন্দির নগরীতে অষ্টাদশ টোটোআরোহী"। দীপক দাস।যথা ইচ্ছা তথা যা। তারিখ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
৮। "ধুঁকছে গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্যময় গুপো সন্দেশ, বাংলার প্রথম ব্র্যান্ডেড সন্দেশ"। রুক্মিণী মজুমদার। নিউজ 18 বাংলা। তারিখ ২১ এপ্রিল ২০১৮।
৯। ব্যক্তিগত ভ্রমণ ও স্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে কথপোকথন।
১০। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য
1 Comments
পানিহাটির গুপো সন্দেশও বিখ্যাত ছিল এক সময়। এখন কেউ কেউ করবার চেষ্টা করলেও সেই স্বাদ আর নেই।
ReplyDelete