ভোলগা নদীর খোঁজে – ১২
বিজন সাহা
কালিয়াজিন
বেলি গোরাদককে পাশ কাটিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল কালিয়াজিনের দিকে। কালিয়াজিন আমি এর আগেও দুই বার গেছি। আর অনেক আগে থেকেই সেখানে যাবার আগ্রহ মনে জেগেছে কালিয়াজিনের বিখ্যাত টাওয়ার দেখে যা বর্তমানে ভোলগার জলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অনেক বন্ধুরা সেখানে গেছে ছবি তুলতে। এক্সিবিশনে সেসব ছবি প্রদর্শন করেছে। তাই ২০১৪ সালের আগস্টের ৩০ তারিখে যখন ইন্টেল ট্যুর সেখানে এক্সারশনের আয়োজন করল চলে গেলাম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল যখন আমরা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সেই টাওয়ারের কাছে এলাম তখন ঝুপ করে বৃষ্টি এলো। ফলে ঐ বৃষ্টির মধ্যেই কয়েকটা ছবি তুললাম। খুব মন খারাপ হয়েছিল সেই আইকনিক ছবি তুলতে না পারার জন্য। পরে বৃষ্টির কারণেই এই ছবিটা হয়ে উঠল সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয়।
রূপকথা বলে যে কালিয়াজিন নামের উৎপত্তি ইভান কোলিয়াগা নামে এক অবস্থাপন্ন জমিদারের নাম থেকে যিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ত্রইস্কি মাকারেভ মনাস্তিরে আশ্রয় নেন এবং নিজের সমস্ত সম্পদ মনাস্তিরে দান করেন। অন্য এক ভার্সন অনুযায়ী কালিয়াজিনের নামের উৎপত্তি ফিন্নো-উগরস্কি শব্দ «কোলা» বা মাছ থেকে।
দ্বাদশ শতকে বর্তমান কালিয়াজিনের ওখানে নিকোলি না ঝাবনে মনাস্তিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৩৩৯ সালের লেখায় এখানে সভ্যাতোস্লাভ পোলে নামে এক দুর্গের উল্লেখ পাওয়া যায় যা ছিল তভের রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত। পনের শতকে কালিয়াজিনস্কো-ত্রইস্কি (মাকারেভস্কি) মনাস্তির স্থাপনের পরে ভোলগা তীরে অনেক দূর পর্যন্ত এই জনপদের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৪৬৮ সালের দিকে আফানাসি নিকিতিন এখানে আসেন তাঁর খঝদেনিয়ে যা ত্রি মারিয়া বা তিন সাগরের পারে বইয়ে যার উল্লেখ আছে। ১৬০৯ সালে কালিয়াজিন এলাকায় মিখাইল স্কপিনো-শুইস্কির নেতৃত্বে বিদ্রহী দল গড়ে ওঠে যারা পোলিশ ও লিথুনিয়ান শত্রুদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে।
সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে যুবক পিতের পেরভি যিনি পরবর্তীতে পিটার দ্য গ্রেট নামে সমধিক পরিচিত হবেন এখানে বেড়াতে আসেন। সেই সময় কালিয়াজিন মনাস্তিরের আশেপাশের অঞ্চল, নিকোলস্কায়া বসতি এবং পিরোগভ নামের সেলো বা গ্রাম নিয়ে কালিয়াজিন জনপদ গড়ে তোলা হয়। ১৭৭৫ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার আদেশে কালিয়াজিন মফস্বল শহরের স্ট্যাটাস পায়। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে কালিয়াজিন গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। সেখানে বছরে দুইবার করে বানিজ্য মেলার আয়োজন করা হত। উনবিংশ শতকের শেষ এখানে জাহাজ নির্মাণ কারখানা, কামারশালা বা লৌহ শিল্প, কাপড়ের উপর পশম দিয়ে ছবি আঁকার বিশেষ শিল্প ও কুশি কাঁটা দিয়ে সেলাই শিল্প গড়ে ওঠে। উগলিচ ও কাশিনের কাছাকাছি হবার ফলে কালিয়াজিন এক সময় বানিজ্য কেন্দ্র থেকে ধর্মীয় কেন্দ্রেও পরিণত হয়। সেখানে ভোলগার দুই ধারে গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল উপাসনালয়। ১৯১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর কালিয়াজিনে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯-৪০ সালে উগলিচ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সময় প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক ও আর্কিটেকচারাল মনুমেন্ট সহ শহরের এক বিরাট অংশ ডুবিয়ে দেয়া হয়। 🍂
বর্তমানে কালিয়াজিন মেশিন টুল কারখানা, বেকারি, বিশেষ ধরণের জুতা বা ভালিঙ্কির কারখানা, সেলাই ও লিনেন কারখানা কাজ করে। এ ছাড়াও এখানে আছে ৬৪ মিটার ব্যাসের রিফ্লেক্টর সমৃদ্ধ শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ আরটি-৬৪ কালিয়াজিন রেডিও আস্ট্রনমিক্যাল অব্জারভেটরি। ভোলগার বা দিকে আছে ১৭৮১ সালে তৈরি বোগোইয়াভলেনস্কায়া গির্জা। এই গির্জা বিখ্যাত তার ঘন্টার জন্য যাদের একটা প্রস্তুত করে বিখ্যাত মাস্টার সিমিওন গারশকভ। বিপ্লবের পরে গির্জা বন্ধ করে দেয়া হয় আর সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় স্থানীয় ইতিহাসের মিউজিয়াম।
ভজনিসেনস্কায়া গির্জা তৈরি করা হয় অষ্টাদশ শতকে। বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এটা ছিল কালিয়াজিনবাসীর সবচেয়ে প্রিয় গির্জা। সোভিয়েত আমলে সেটাকে স্পোর্টস ক্লাবে পরিণত করা হয়। বর্তমানে পুরাদমে তার পুনর্নির্মাণ কাজ চলছে। তার দেয়ালে নতুন নতুন ফ্রেস্কি তৈরি হচ্ছে। এখানে বিপ্লবের আগে সেন্ট মাকারের দেহাবশেষ সংরক্ষিত ছিল। সোভিয়েত আমলে সেটা সরিয়ে ফেলা হয়। তবে বর্তমানে সেটা আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। ভভেদেনিয়া প্রেসভ্যাতই বোগোরদিৎসি গির্জা আয়তনে বড় না হলেও তার সৌন্দর্য পরিব্রাজকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাকার কালিয়াজিনস্কির স্ট্যাচু যে পথ দিয়ে কালিয়াজিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গায় যেতে হয় সেই পথের শুরুতে। ২০০৮ সালে তৈরি এই মনুমেন্টের পাদদেশ থেকেই শুরু হয় কালিয়াজিন ভ্রমণ।
তবে কালিয়াজিনের প্রতীক হচ্ছে নিকোলস্কি গির্জার টাওয়ার বেল। এটাকে কালিয়াজিনের মুখ বললে অত্যুক্তি হবে না। উগলিচ রিজারভয়ারের মাঝে কৃত্রিম দ্বীপে অবস্থিত এই টাওয়ারের অনেকটাই জলের নীচে আর এটাই হয়তো বেশি আকর্ষণ করে পর্যটকদের। তীর থেকে শিলা পাথরের তৈরি ৭০ মিটার দীর্ঘ পথ ধরে সেখানে যাওয়া যায়। এটা যেন নর বানরের তৈরি লঙ্কায় যাবার সেই বাঁধ। আর এই রাস্তার নাম «রোড টু নোহয়ার» বা «লক্ষ্যহীন পথ»। এটা যেসব কৃষকেরা টাওয়ার বেল তৈরি করে তাদের তৈরি। ১৯৩৫ সালে উগলিচ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ফলে শহরের ঐতিহাসিক এলাকা পুরোটাই জলের নীচে চলে যায়। শুধু ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে ভোলগা তীব্র বাঁক নেবার কারণে টাওয়ার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। তখন থেকে এটা জাহাজের নাবিকদের জন্য অনেকটা আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। বলা হয়ে থাকে যে দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার আগে টাওয়ারের ঘন্টার শব্দ এমনকি জলের গভীরেও শোনা যায়। ১৯৪১ সালে যুদ্ধের আগেও নাকি এমনটা ঘটেছিল। এরপর থেকে অনেকেই নৌকা করে সেখানে আসে নিজেদের ভাগ্য জানার জন্য। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে স্থানীয় প্রশাসন মাটি দিয়ে টাওয়ারের নীচের অংশ ঢেকে দেয়। এভাবে ঘন্টার শব্দ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেয়া হয়।
আমি প্রথম কালিয়াজিন যাই ২০১৪ সালে ৩০ আগস্ট ইন্টেল ট্যুরের সাথে এক এক্সারশনে। সেবার গিয়েছিলাম বাসে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল বোগোইয়াভলেনস্কায়া গির্জা বা স্থানীয় ইতিহাসের মিউজিয়াম। সেখানে মিউজিয়াম দেখে লঞ্চে করে আমরা যাই এক ঘন্টার ভোলগা ট্রিপে। বিভিন্ন দিক থেকে ঘুরে দেখি নিকোলস্কি গির্জার টাওয়ার বেল। এরপর আমরা আসি ভজনিসেনস্কায়া গির্জায়। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরে যাই টাওয়ার দেখতে। ঠিক তখনই বৃষ্টি নামে। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় বাজারে। বাজারের সেই স্থান বিপ্লবের আগে তৈরি। কিমরির ঐতিহাসিক বাজার বা তরগোভই রিয়াদ ধ্বংস হয়ে গেলেও কালিয়াজিনের বাজার এখনও কাজ করছে।
২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট আমাদের ইনস্টিটিউট এক এক্সারশনের আয়োজন করে। সেটা ছিল জাহাজে করে যাওয়া। যদিও অনেক আগে ১৯৮৮ সালে এই পথে গিয়েছিলাম, তবে সেসব আর মনে নেই। এবার দেখলাম ভোলগার বিশালতা। মস্কো সাগরে ভোলগা হারিয়ে গেছে বলে সেটাকে কখনই ভোলগা মনে হয় না, তবে এখানেও উগলিচ রিজারভয়ারের কারণে ভোলগা ফুলে ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করছে। এখানে সেখানে দ্বীপ। সব মিলিয়ে দুবনা থেকে কালিয়াজিন যাবার এই জলপথ একেবারেই ভিন্ন। সেবার আমরা গেছিলাম মূলত স্থানীয় ইতিহাসের মিউজিয়ামে। সেখানেই মূল সময় কাটানো। এরপর জাহাজে করে টাওয়ারের কাছে যাওয়া। অন্য তীরে আর যাওয়া হয়নি। তবে সেই জার্নিও ছিল উপভোগ করার মত। সেবার অবশ্য আমার স্ত্রী গুলিয়া সাথে ছিল। কাকতালীয় ভাবে ২০২১ সালে দিলীপের সাথে আমার কালিয়াজিন ভ্রমণ আগস্ট মাসে – ২৬ তারিখে। সময় ও ইচ্ছের অভাবে আমরা তেমন একটা ঘোরাফেরা এখানে করতে পারিনি। মূলত টাওয়ারের ওখানে কিছু সময় কাটানো আর এ পারেই আরেকটু উপরের দিকে ভোলগা তীরে শান বাঁধানো ঘাঁটে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা। আবহাওয়া অবশ্য প্রতিকূল ছিল। তাই আমরা খুব বেশি দেরি না করে আবার পথে নামলাম। যাব উগলিচ। কালিয়াজিন হবে তভের রেজিওনে আমাদের শেষ স্টপেজ। উগলিচ থেকে আমরা শুরু করব আমাদের ভ্রমণের ইয়ারোস্লাভল পর্ব।
কালিয়াজিনের কিছু ছবি পাওয়া যাবে এখানে
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=131
আর ভিডিও এখানে
0 Comments