জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৮৭/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

পর্ব ৮৭  

রুটিন মেনে ডায়ালিসিস হচ্ছে। আগের মতই হাঁটাচলা ঠিকমত করতে পারছেন না, ধরতে হচ্ছে।  রাতে উঠে বারবার টয়লেটে নিয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে মুশকিল হচ্ছে। কিন্তু ইনি যাবেনই। ওনার এই অসহায় অবস্থা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। কেমন ছিলেন, আর আজ কেমন হয়ে গেছেন। এত কষ্ট পাচ্ছেন কেন? কেন? কেন? কোন উত্তর কারো কাছে আছে কি?

             ছবি একটা কাজের মেয়ে দিয়ে গেছে, কাজ ভালই করছে্‌। তবে হাত সাফাইয়ের অভ্যাস আছে, এটাই মুশকিল। আজ স্বপ্না এসেছিল ওনাকে দেখতে। ও যে ভরসা দিল, তা সহোদর বোনই দিতে পারে। ওর মত মানুষেরা পাশে আছে, এটাই আমার কাছে অনেকখানি পাওয়া। ঝর্ণা আচার্য ওনাকে দেখতে  এসেছিল সন্ধ্যাবেলা। অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা হল। বুঝলাম ওর পরিবার কট্টর বামপন্থী। মেয়েটা প্রচারের আড়ালে থেকে আদিবাসীদের নিয়ে প্রচুর কাজ করছে।

      আজ চন্দ্রিমা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসেছে। উনি খুব নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। রোজ বলতেন, ভয়ে ঘুম আসে না, যদি শ্বাসকষ্ট শুরু হয়? আমিও কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। এবার অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ হয়েছিল। আগের দু’বার আইসিইউ তে ভর্তি করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু ওরা নিয়ে গেলে আইসিইউতে ভর্তি করবেই। এবার শ্বাসকষ্ট হলে বাড়িতেই অক্সিজেন দিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

     আজ সকালে রাজাবাজার গেছলাম ওনার পছন্দের মাছ কিনতে। চিরকাল মাছ ওঁর ভীষণ প্রিয়। দু’রকম মাছ, সবজি কিনে নিয়ে এসে রান্না করলাম। আবার বের হলাম ওনার ওষুধ  কিনতে। আজ একটা লেখা মেল করলাম ‘আজকাল’এ, জানিনা মনোনীত হবে কি না। শীর্ষর সঙ্গে কথা বলে মনে হল লেখাটা যাবে, তবে দেরি হবে। যত কষ্টই হোক, লিখতে আমাকে হবেই। লেখার ধারাবাহিকতা ছেড়ে দিলে, আর লেখায় ফিরতে পারব না। আনন্দ বাজারেও একটা লেখা পাঠাব ভাবছি।

     মনি পাবদা মাছ দিয়ে গেছে, কাল রান্না করব। সন্ধ্যাবেলা  ঘাটালের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফোন করে ওনাদের স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে জাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালে, আমি সম্মতি দিয়েছি, অনুষ্ঠান অনেক দেরিতে, ৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠান। তখন কী পরিস্থিতি হবে জানি না।

                   আজ সারাদিন বেশ রোদ্দুর ছিল। আজ কালিপুজো, তাই চারিদিকে আলোই আলো।  আমাদের সব অন্ধকার। একটু আগে চন্দ্রিমা খাবার পাঠিয়েছে। খুলে দেখা হয়নি। নানারকম চিন্তা ঘিরে রেখেছে।  নিচের তলাটা ভাড়া দিতে হবে। কিন্তু উনি রাজি নন। ভাড়া দেওয়ার আগে কিছু কাজ করাতে হবে। মিস্ত্রী দেখে গিয়ে এস্টিমেট দিয়েছে ৩৬,৫০০ টাকা, মানে এটা ৫০,০০০ টাকায় দাঁড়াবে।কাঠের মিস্ত্রীও এসেছিল, কাল থেকে কাজ শুরু করবে। এদের কাজ শেষ হলে রঙের মিস্ত্রী লাগাব। টাকার প্রয়োজন আছে ঠিকই, ঘরগুলো ব্যবহার হলে পরিস্কার থাকবে। তাছাড়া প্রয়োজনে পাশে পাওয়া যাবে। এসব করছি বলে উনি বলছেন, আমাকে বাইপাশ করে  কাজ করছ?

     কলকাতা দূরদর্শন থেকে আজ ফোন এসেছিল। আগামি বৃহস্পতি বার একটি লাইভ প্রোগ্রামে ফোনে আমাকে ধরবেন। এদিকে নেহেরু যুবকেন্দ্র থেকে একটি ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য ফোন করেছিল। আমি অসুবিধার কথা জানিয়ে না করে দিলাম। আমি সবরকম ভাবে ওনাকে একটু আরামে রাখার, খুশি রাখার চেষ্টা করে চলেছি। আজ কালেক্টরি মোড় থেকে কিছু ফুলের চারা, সার ও মাটি কিনে নিয়ে এলাম। কিন্তু মাটি তৈরি নেই।নাসিমাকে বলেছি মাটি চেলে, শুকিয়ে, সার মিশিয়ে রেডি করতে । সন্ধ্যাবেলা সুদীপ ও সুভাষ এসেছিল বিজয়ার প্রণাম করতে, আর কুইজ কার্নিভ্যাল এর নিমন্ত্রণ পত্র দিতে। অনুষ্ঠান হবে শনিবার মেচেদাতে। মেদিনীপুরের বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়, তাছাড়া শনিবার  ওনার  ডায়ালিসিস আছে। ওরা যাওয়ার পর  সৌনক ছোট ছোট কিছু গিফট আর মিষ্টি নিয়ে বিজয়ার প্রণাম করতে  এসেছিল। আনন্দবাজারে আজ আমার লেখাটি দিয়েছে।
🍂

    ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশন থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক  নান্টু  রায় কলকাতা এসেছেন।  রাত ১২ টা ৩০শে ফোন করে জানালেন,  পত্রিকা আনতে পারেননি, স্পিডপোস্টে চেক পাঠাবান। পত্রিকা পেলাম না, ৪০০০ টাকার চেক পেয়ে গেলাম। যিনি এই পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে দিয়েছিলেন, তিনি দুই বাংলার পরিচিত কবি মলয় মুখারজি এখন বাংলাদেশে আছেন।উনি পত্রিকা নিয়ে আসবেন বলেছেন। আজ দুপুরে ‘দিনকাল’ পত্রিকার সম্পাদক ঋতব্রত ফোন করে লেখা চাইলেন।

     সৌনক আজ ফোন করেছিল, আমি কুইজ কার্নিভ্যালে যাইনি বলে অনেকে নাকি খোঁজ করছিলেন। এদিকে স্বপ্নাও যায়নি। ও যায়নি অন্য কারণে। সে যাইহোক, হইহুল্লোড় করার মত বয়স আর মানসিকতা,  কোনটাই আর আমার নেই। যে যা খুশি করুক, আমাকে আমার কাজ করে যেতে হবে। যা আমাকে জীবনীশক্তি যোগায়, দুঃখ ভোলায়। হ্যাঁ, তা হল আমার লেখইয়, আমার কাজ। সকালে রান্না শেষ করে প্রথমে UBI ব্যাঙ্কে গেলাম, কোন  কাজ হল না। খান সাহেবকে আসতে হবে লাইফ সার্টিফিকেটের জন্য। এখান থেকেই SBI ব্যাঙ্কে গেলাম, কিন্তু দীপের চেকটা নিয়ে যেতে ভুলে গেছি। এখান থেকে BGVB ব্যাঙ্কে গিয়ে আনন্দবাজারের চেকটা জমা দিলাম। পাশবুক আপডেট করলাম। ওখান থেকে লাইফ সার্টিফিকেটের ফর্ম নিয়ে হেঁটেই কালেক্টরি মোড়  এলাম। ফুলচারা কিনে টোটো ধরে বাড়ি ফিরে ওই টোটোতেই দীপের চেকটা নিয়ে SBI গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে জমা দিয়ে এলাম, কাজ হবে কিনা জানি না।

     আপ্রাণ চেষ্টা করি যদি নিজের লোক বা অন্য কারো কষ্ট সামান্য হলেও লাঘব করতে পারি। তবে সেটা স্বামী-সংসারকে অবহেলা করে নয়। এই মুহূর্তে সংসার থেকে ফুরসৎ মিলছে না। তাই বাড়িতে থেকেই যতটুকু পারা যায় করছি। আমার কলমকে থামতে দিইনি। মেজদিটা বড় অসহায়। ওর সমস্যাগুলো যতটা পারি আমি আর বাবলি দেখি। কর্তব্যের খাতিরে নয়, ভালবেসে। ডায়ালিসিস করিয়ে ফিরে নিউরোলজিস্ট ডাঃ কুণ্ডুর খোঁজ নিতে কল্পতরু গেলাম। মেজদির ছোটছেলে খোকার ব্রেন টিউমার অপারেশন হয়েছে চেন্নাই এ, বাড়ি ফিরে এসেছে।     ডাক্তার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাকের পাইপটা খুলে ফেলে দিয়ে নতুন লাগাতে  বলেছেন। খোকন(ENT)ওঁকেই দেখাতে বলেছে। আমি নিজে ওকে ফোন করলাম। ও আমাকে বলল, কোন নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিতে, ওখানেই পাইপ খুলে নতুন  পাইপ লাগিয়ে দেবে। সেইমত স্পন্দনে কথা বলে দেখলাম, এখানে ভরতি করা অনেক ঝামেলা। মেদিনীপুর নার্সিংহোমে দেবল বাবুর সঙ্গে কথা বলতে উনি ENT ডঃ রবি হেম্রমের নাম্বার দিয়ে ফোন করতে বললেন। আর বললেন, উনি এখানে আসেন।  উনি কাজটা করে দেবেন। পেসেন্টকে ভর্তি করে জেনে নিন উনি কখন আসবেন। আমি ফোন না করে ওনার চেম্বারে চলে গেলাম। পরিচয় দিতে চিনলেন। সব শুনে  বললেন, নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হবে না।  শনিবার আউটডরে নিয়ে আসতে বলবেন, আমি ভর্তি করে নিয়ে রাতে পাইপ খুলে সকালে রিলিজ করে দেব। কথাটা মেজদির বৌমাকে জানিয়ে দিলাম।

    রোজ শুনচ্ছি ঘূর্ণিঝড় আসবে।আজ সামান্য সময় লিখতে বসে ছিলাম। রাতে অধ্যাপক ইয়াসিন নতুন কবিতা সংকলন দিতে এসেছিল, নাম কংসাবতী,২৪ নভেম্বরের অনুষ্ঠানে বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন হবে। এটা ছাড়াও  ‘কাঁসাই বাঘুই’ নামে আর আকটি কবিতার বই আত্মপ্রকাশ করবে। উপদেষ্টা মণ্ডলিতে আমার নাম রাখতে চান।

    আজ মনে হচ্ছে সত্যিই ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলার সব স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঋতব্রতর লেখাটা ১২ নভেম্বরের মধ্যে পাঠাতে হবে। বাংলাদেশের ভারত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক যে চেক পাঠিয়ে ছিলেন, আজ তা পেলাম। খামের মধ্যে ৪০০০ টাকার চেক ছিল।এত টাকা পাব ভাবতেই পারিনি!আমাদের এখানে একটা লেখার জন্য                                                          এই অঙ্কের টাকা কেউ দেয় না।যা দেয় তা ও অনিয়মিত। আজকে বের হয়ে  ব্যাঙ্কের কাজগুলো সারলাম। ওনার শরীরটার ধিরে ধিরে অবনতি হচ্ছে, হাঁটাচলা করতেই পারছেন না। আমি অসহায়ের মত দেখছি, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না,আগামিকাল ডায়ালিসিস আছে, তার ওপর রানীর জন্মদিন। রাতেই ওর জন্য একটুখানি পায়েস বানিয়ে রাখলাম। বাকিটা কাল চন্দ্রিমা করবে। ওরই বেশি উৎসাহ। ওই তো আমাদের দম বন্ধ করা জীবনে একটুখানি খুশির হাওয়া বয়ে আনে।

     আজ জন্মদিনে রানী বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে কেক কেটেছে। বিকেলে  চন্দ্রিমা আর ওর মেয়ে ডল কেক মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। কেক কাটা হল। আমার ছেলে মেয়ের জন্মদিনে এসব সাহেবি খানা পছন্দ ছিল না।ওদের জন্য আমাকে লুচি, পায়েস, আলুরদম বানাতে হত। সে সব দিন সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে। চাইলেও আর ফিরে পাব না।

   এবারের ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে দেখছি ক্রিয়েটিনিন অনেকটাই কমেছে। সেইসঙ্গে হিমোগ্লোবিনও কমে গেছে। খুবই দুর্বল, এঁরা বলছেন আইরন ইঞ্জেক্সন নিতে।আজ অনেকটা সুস্থ আছেন। গতকাল অ্যাসিড হয়ে গেছল বলেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। সন্ধ্যাবেলা বাবলি ফোন করতে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা ফেব্রুয়ারি মাসে আসবে কি না। জানালো ও একা আসবে ১০ দিনের জন্য। বললাম জারাকেও নিয়ে আসিস, তোর বাপি খুশি হবেন। দীপের সঙ্গে আলোচনা করে জানাবে বলেছে। সামনের রবিবার বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৪ টে পর্যন্ত একটি প্রোগ্রাম আছে ।তারপর কুইজ কেন্দ্রের মানবিক দেওয়াল আছে। অন্যদের থেকে পুরনো কিন্তু ছেঁড়া বা অপরিস্কার নয় এমন জামাকাপড় সংগ্রহ করে শহরের এক এক জায়গায় বসে, যাদের প্রয়োজন তাদের বিতরণ করা হয়।আমি কোনটাতেই যোগ দিতে পারব বলে মনে হয় না। সন্ধ্যাবেলা শীর্ষ মেসেজ করে জানিয়েছেন আগামিকাল শনিবার আজকাল এ আমার লেখাটি থাকবে।                                                          

     রাতে ঘুমতে পারছেন না, রোজই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তখন অক্সিজেন দিলে শান্ত হচ্ছেন।কী যে করি, আর কত কষ্ট দেখতে হবে জানিনা। এবারে শরীরটা যেন একটু বেশিই খারাপ হয়েছে। হিমগ্লোবিন ৬পয়েন্টের সামান্য বেশি। ভাবছি সপ্তাহে ১ ইউনিট করে ব্লাড দিলে কেমন হয়? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ওদিকে মায়ের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছেন না, সব ভুলে  যাচ্ছেন। বার বার টয়লেট যাচ্ছেন। আমি যে একবার দেখতে যাব, তাও পারছি না।

       আজ ২৫ নভেম্বর এই সৌভাগ্যবতীর(?)জন্মদিন। এসব কোনদিনই পালন করা হত না। একটা সময় জীবনানন্দ সভাঘরে কিছু সাহিত্যসাথী পালন করতেন। কিন্তু ধিরে ধিরে কলকাতা যাওয়া কমে গেল। সব সময় যাওয়া সম্ভবও ছিল না। এখন পাগলি চন্দ্রিমা কী সব আয়োজন করে। এবারে চন্দ্রিম শিবানীদি ও ডল এসেছিল কেক ও আরও অনেককিছু নিয়ে। সৌনকও কেক নিয়ে এসে ছিল।সুদীপ এসে ছিল। রাতে সাহবাজ এসেছিল। আগামিকাল (২৬ নভেম্বর) আমাদের একমাত্র মেয়ে বাবলির (সাহিন) শুভ জন্মদিন।

      মেয়ের জন্মদিনে এতদূর থেকে কী করব? সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। আর যা সম্ভব, সেটাই করেছি। ওনাকে নিয়ে পেনশন অফিসে  গেছলাম, কাজটা হয়েছে। গত রাতে সৌনকের দিদিমা মারা গেছেন, একাধিক ছেলে থাকা স্বত্বেও মেয়ের কাছে থাকতেন। তবুও মানুষের পুত্র সন্তানের বাসনা কেন বুঝি না। আমার কপালে কী আছে কে জানে?                        ক্রমশ

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো এগোচ্ছে

    ReplyDelete