বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮৪
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং
মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী
উপপর্ব — ১৯
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
কশাড়িয়া মোড় থেকে বিদ্যাপীঠ যাওয়ার পাকা রাস্তার পূর্ব ধারে রয়েছে একটি কারখানা। প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদন ও বিশুদ্ধ পানীয় জল তৈরির কারখানা। এ হেন ইন্ডাস্ট্রির গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্যের মার্কেটিং – যাবতীয় কার্যকলাপের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন প্রৌঢ় পণ্ডিত মানুষটি। তাঁর অদম্য ইচ্ছা শক্তি সম্বল করে কারখানার পথ চলা শুরু হয়েছিল একের দশকে। সময়টা ছিল ২০১৭। কারখানার ভালো-মন্দ, সুখ দুঃখের সমান ভাগীদার তিনি। যদিও উঁচু ইঁটের প্রাচীর ঘেরা বর্তমান কারখানার প্রথম পথচলা এত মসৃন ছিল না। অনেক ঘাত প্রতিঘাত, হোঁচট খেয়ে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছে সেটি। বৃহত্তর সমাজ গড়ার যে-ভাবনা থেকে কারখানা স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন পণ্ডিত, তাঁর সে-উদ্যোগ ও সম্মান এক সময় ধুলোয় মিশে যেতে বসেছিল। তার পরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কারখানাটি। নিজের মেরুদন্ড সোজা রেখে রামচন্দ্র বাবু একা লড়াই চালিয়ে গেছেন সমস্ত অন্যায়-অধর্মের বিরুদ্ধে। আসলে ভীষণ কাজ প্রিয় মানুষ তিনি। যে-কাজে একবার যুক্ত হন, তার শেষ না-দেখে ছাড়েন না। এমনই তাঁর অধ্যবসায়। তাঁর জেদ। প্রতীজ্ঞা। সামাজিক কাজকর্মের মধ্যে তাঁর সর্বক্ষণের বিচরণ। অসম্ভব পছন্দ তরুণ সমাজ ও তারুণ্যের উন্নয়ন। বার্ধক্যের বারানসিতে পৌঁছেও দায়িত্ব নিতে পিছপা হন না বৃদ্ধ, বরং ভালোবাসেন নতুন নতুন কাজে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে। আরও ভালোবাসেন সবসময় সৃষ্টিশীলতার আবহে থাকতে। সুস্থ নিষ্কলুষ সমাজ গড়তে তিনি এক পায়ে খাড়া।
সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, সংক্ষেপে CIPET, প্রতিষ্ঠানটির হেড অফিস রয়েছে হলদিয়ায়। খেজুরীর ছেলেমেয়েরা CIPET ট্রেনিং নিতে হাজির হতো সেখানে। ট্রেনিং কোর্স ছিল মূলত আশ্রমিক। এখান থেকে ছয় মাসের সার্টিফিকেট কোর্স কিংবা তিন বছরের ডিপ্লোমা শেষ করে ভালো প্লেসমেন্টের জন্যে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমায় এলাকার অধিকাংশ তরুণ মেয়ে-ছেলে। অল্প কিছু দিন পর পর তাদের মোহভঙ্গ ঘটে। ভিনরাজ্যে কাজে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন কারণে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয় সবাই। অথচ, দেশে একদম কর্মসংস্থান নেই। তা দেখে পণ্ডিত রামচন্দ্র বাবুর মাথায় তাদের স্বনির্ভরশীল করার চিন্তা ও চেষ্টা অনবরত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এসসি (SC), এসটি (ST), ওবিসি (OBC) সম্প্রদায়ের জেলা সম্পাদক তখন প্রশান্ত মণ্ডল। তাঁর সঙ্গে জোট বাঁধলেন রামচন্দ্র বাবু। আশ্রমিক পরিবেশে CIPET ট্রেনিং প্রাপ্ত গুটিকয়েক স্থানীয় তপশীলী যুবক যুবতীর কর্ম সংস্থানের মহতি উদ্দেশ্য তাঁর একমাত্র চিন্তার বিষয়। বেকার যুবক যুবতীর কর্মসংস্থানের বিকল্প উপায় কী হবে? একমাত্র বিকল্প উপায়, বিজ্ঞানীর মতে, নুতন নুতন কারখানার গোড়াপত্তন করা। শিল্প বিনা বেকারত্ব দূর হওয়ার সম্ভাবনা যেমন ক্ষীণ, কৃষি প্রধান বাংলাদেশে চাই ক্ষুদ্র শিল্প গড়ার তেমনই উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনা। গ্রামবাংলায় বৃহৎ শিল্প না আসুক, নিদেনপক্ষে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি শিল্পের আশু প্রয়োজন। তাই রামচন্দ্র বাবুর বিশেষ উদ্যোগে খেজুরীর বুকে গড়ে উঠেছিল প্লাস্টিকের কারখানা। সেখানেও তীব্র গণ্ডগোল।
২০১৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের দায়িত্বপূর্ণ সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে একেবারে ঝাড়া হাত পা তিনি। আকাশ চরে দিকভ্রষ্ট এক মুক্ত বিহঙ্গের মতো স্বাধীন তাঁর বিচরণ। কশাড়িয়া মোড়ের অদূরে পাকা রাস্তার ধারে প্লাস্টিক কারখানা তৈরির আশায় তিনি ও প্রশান্ত বাবু একসঙ্গে রওনা হলেন হলদিয়ায়, CIPET-এর ট্রেনিং অফিসে। CIPET-এর ট্রেনিং অধিকর্তা তখন দিব্যেন্দু ভড়। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সুফল মিলল। মিঃ ভড়-এর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ এসসি (SC), এসটি (ST), ওবিসি (OBC) ফিনান্স এবং ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (WB SC, ST & OBC Finance & Development Corporation)-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুব্রত মান্নার সঙ্গে আলোচনার অভাবনীয় সুযোগ এসে গেল। আলোচনার শেষে তিনি সমবায়ের মাধ্যমে স্বনির্ভরশীল করার উদ্দেশ্যে খেজুরীতে প্লাস্টিক দ্রব্য আর বিশুদ্ধ পানীয় জল উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু নির্দেশে চিড়ে ভেজে না। চাই কারখানার উপযোগী যন্ত্রপাতি, পেল্লাই সাইজের মেশিন। চাই প্রয়োজনীয় অর্থের নিরবচ্ছিন্ন যোগান। উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বন্টন। তারও ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা। যাবতীয় মেশিনারি পার্টস সরকারি ভাবে সরবরাহ করার ব্যবস্থাদি করেছিলেন সুব্রত বাবু। তাঁর সহায়তায় কন্টিজেন্সি বাবদ নগদ অর্থ জোগাড় হয়েছিল ব্যাংকের মাধ্যমে। টেকনিক্যাল সাপোর্ট আর প্রাথমিক ভাবে উৎপন্ন দ্রব্যাদি মার্কেটিংয়ের জন্য হলদিয়ার প্লাস্টিক কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করে যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছিলেন তিনি। সেজন্য CIPET-এর মাধ্যমে মার্কেটিং করার জন্যে কারখানা অঙ্গীকার বদ্ধ। কিন্তু সমস্যা বাঁধল কারখানা তৈরির জমি নিয়ে। কী সমস্যা? কথা হয়েছিল, প্রশান্ত বাবু তাঁর নিজস্ব একুশ ডেসিমেল জলাভূমি কারখানার জন্য দীর্ঘ মেয়াদী সূত্রে দশ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে, রেজিষ্ট্রেশন না করে, লিজ-নামা সই করে দেবেন। সেই লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল বোর্ড অব ডাইরেক্টর। এ হেন কমিটির একগুচ্ছ সদস্যের মধ্যমণি ছিলেন রামচন্দ্র বাবু। বোর্ড অব ডাইরেক্টরের সভায় কারখানার নাম স্থির হয়ে গেল। 'খেজুরী আম্বেদকর প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড'। রামবাবুর পাখির চোখ চেয়েছিল কারখানা গড়তে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। সেই উদ্দেশ্যে সকল প্রস্তুতি যখন সারা, তখনই এসেছিল অপ্রত্যাশিত আঘাত। আরেক প্রস্থ নাটক। ব্যাপারখানা কী?
কারখানার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য সরকারি আশ্বাস পেয়ে রামবাবু যখন কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়েছেন, তখন জলা জমিটি ভরাট করে কারখানা গৃহ নির্মাণের কাজও নিজ দায়িত্বে, সানন্দে আপন স্কন্ধে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে পাহাড় প্রমাণ খরচের বোঝা। আজ পর্যন্ত তিনি একাই প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন কারখানার জন্যে। জমা খরচের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব আজও তাঁর ডায়েরিতে লেখা। তিনি যা ভেবেছিলেন, ঘটেছিল তার উল্টো। তিনি ভেবেছিলেন কারখানা গড়ে উঠার পর সরকারি যা লোন রয়েছে, সব লোন পরিশোধ করে ব্যক্তিগত অর্থ মকুব করা যাবে। কিন্তু কোথায় কী? তাঁর সকল আশায় এক বালতি জল ঢেলে দিল সামাজিক ঔদাসীন্য। লিজ-নামা রেজিস্ট্রিভুক্ত করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন তাঁর মহৎ ভাবনা কিংবা উদ্দেশ্য আজকালকার কুবুদ্ধি ও কুটিল ব্যক্তি বা সমাজের পক্ষে প্রযোজ্য নয়। এ কথা বুঝতে তাঁর অনেক মূল্যবান সময় ব্যয়, টাকা হয়ে গেল। অনেক দেরি হয়ে গেল। কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হওয়া যখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র, ঠিক তখনই লিজ-নামায় অনভিপ্রেত শর্ত আরোপ করা হল। ফলস্বরূপ জমির লিজ-নামা রেজিষ্ট্রেশন খামোখা পিছিয়ে গেল। শুধু তাই নয়, সুচতুর কৌশলে কারখানাস্থিত জমি নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে করায়ত্ত হয়ে গেল। বোর্ড অব ডাইরেক্টরের সদস্যরাও পেছন থেকে ছুরি মারল। সবাই সরে পড়ল কমিটি থেকে। রামবাবুর সঙ্গে কেউ রইল না। কারখানার ভালো মন্দের সঙ্গে বৃদ্ধ পণ্ডিত মানুষটি কেবল একা লড়াই করলেন। সেজন্য রামচন্দ্র বাবুর আক্ষেপ –
'প্লাস্টিক কারখানা গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও কমিটির সদস্যদের আড়ালে সরে যাওয়াটা এক নিষ্ঠুর পরিহাস!'
সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে শেষমেশ কারখানার প্রস্তুতি পর্ব যখন সমাপ্ত, সেটা ২০১৭ সাল। কারখানার রেজিষ্ট্রেশনও ইতিপূর্বে সারা। রেজিষ্ট্রেশনে নথিভুক্ত নম্বর ১৩/২০১৭।
বিস্তর ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে কারখানায় উৎপাদন শুরু হল। হলদিয়ার সঙ্গে যোগসাজশে উৎপাদিত প্লাস্টিক দ্রব্যের রপ্তানি মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল। হঠাৎ সমস্যা তৈরি হল পুনরায়। বাধার উৎস হলদিয়ায় CIPET কোম্পানি। টেকনিক্যাল সব দিক থেকে এবং হলদিয়ার কারখানার সঙ্গে যোগসূত্র সরিয়ে নিল সি.আই.পি.ই.টি. (CIPET)। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি খুব ভালো হল না। মার্কেটিংয়ের দিক গেল আটকে। CIPET-এর তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেও খেজুরীর কারখানায় উৎপন্ন প্লাস্টিক দ্রব্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর জন্য যে ট্রান্সপোর্ট দরকার, তার অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও কশাড়িয়ার প্লাস্টিক কারখানায় তা পাঠালো না। মালপত্র বহন করার গাড়ি না পেয়ে কারখানার ট্রান্সপোর্ট খরচ আকাশ ছুঁল। কারখানায় যে সব প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপন্ন হতে শুরু করল, নিজেদের খরচে সেগুলো হলদিয়ায় পৌঁছাতে গিয়ে কারখানার নাভিশ্বাস দশা। ইতিমধ্যে কারখানার শেয়ার হোল্ডাররা কাজ না পেয়ে কারখানা ছেড়ে একপ্রকার চলে গেল। খেজুরী আম্বেদকর প্লাস্টিক কো-অপারেটিভ সোসাইটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার জোগাড়। প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে, বছর দুয়েক আগে, বিশুদ্ধ পানীয় জল তৈরির অনুমোদনও পেয়েছে কারখানা। সেখানেও হাজার একটা সমস্যা। এত সব সমস্যা নিয়ে এখনও খেজুরী আম্বেদকর প্লাস্টিক কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড দণ্ডায়মান রয়েছে ঠিকই, তবে আগের সে-গরিমা আর নেই। রামচন্দ্র বাবুর সাজানো বাগান এখন পরিচর্যার অভাবে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে বসেছে।
(২)
অখণ্ড মেদিনীপুর জেলায় মেদিনীপুর সম্মিলনী গড়ে উঠেছিল ২০১১ সালের ২০ আগস্ট। সভাপতির আসনে জ্বলজ্বল করছিল একটি নাম – স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীমতী আভা মাইতি। সম্মিলনী গড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল সুদূর মেদিনীপুর বাসী জনগণের কলকাতায় শিক্ষা-স্বাস্থ্য রক্ষা সমেত যাবতীয় কাজের সুবিধার্থে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য একটি 'মেদিনীপুর ভবন' গড়ে তোলা। এখান থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা প্রতিযোগিতা মূলক বিভিন্ন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে। রোগী কলকাতায় নিয়ে গিয়ে মেদিনীপুর ভবনের সঙ্গে যুক্ত ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। মেদিনীপুর জেলার উল্লেখযোগ্য চারজন মনীষী – পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, বীর শহীদ ক্ষুদিরাম বসু ও মাতঙ্গিনী হাজরা'র জীবন কাহিনী আলোচনা ও স্মরণসভা সংঘটিত হবে। ইত্যাদি।
উপরের সবগুলি কর্মকাণ্ডের প্রচেষ্টা শুরু হয় ড. বিধানচন্দ্র রায়-এর জন্মদিনে, ২০১০ সালের ২০ আগস্ট তারিখে। এ হেন প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছিল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ত্রিখণ্ডিত হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলায় ভাগ হয়ে যাওয়ার পর। সেজন্য 'মেদিনীপুর সম্মিলনী'র নামকরণ পাল্টে করা হয় 'মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থা'। নির্মিত হল মেদিনীপুর ভবন। ভবন নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে গুটি কয়েক শাখা সংগঠন গড়ে তোলা হয় জেলা জুড়ে। সবার আগে গড়ে ওঠে 'কাঁথি-এগরা ইউনিট'। খেজুরী ২নং ব্লকে সুমন নারায়ণ বাকরা'র একান্ত প্রচেষ্টায় মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার খেজুরী শাখা সংগঠন গড়ে উঠেছিল হেঁড়িয়া'য়, ২০১৮ সালের পয়লা জুলাই। সেদিন কলকাতা থেকে মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার পক্ষ থেকে প্রণবেশ জানা, রতিকান্ত মালাকার, বিমল জানা প্রমুখ ব্যক্তিত্ব এবং কাঁথি-এগরা ইউনিটের সম্পাদক মন্মথ নাথ দাস উপস্থিত ছিলেন। খেজুরী শাখার সভাপতি পদে নির্বাচিত হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. রামচন্দ্র মণ্ডল আর সম্পাদকের ভূমিকায় সুমন নারায়ণ বাকরা। আরও কয়েকজন গুণীব্যক্তি সদস্য পদে মনোনীত হন। পরে খেজুরী ব্লক-২ ও ব্লক-১-এর আগ্রহী কয়েকজন গুণী মানুষকে সদস্য হিসেবে যুক্ত করে একটি বৃহত্তর ইউনিট গঠন করা হয়। এর ফলে সংগঠনের কাজে গতি আসে। পূর্বে উল্লেখিত চারজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিশিষ্ট গুণী ব্যক্তির জন্মদিন ও প্রয়াণ দিবস উদযাপন করা হয়। সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্বর্থনা জ্ঞাপন করা হয়। এভাবে মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার খেজুরী শাখার সভাপতি ও সম্পাদকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং মূল সংগঠনের সক্রিয় সহযোগিতায় শাখা সংগঠনগুলির মধ্যে খেজুরী ইউনিট উল্লেখযোগ্য অবদান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর কাজের পরিধি আরও প্রশস্ত ছিল। একগুচ্ছ সৃষ্টিশীল কাজে তিনি সদা নিযুক্ত। সময়টা ২০১৪ সাল। তাঁর একটি বড় কাজ ছিল 'খেজুরী সাহিত্য সম্মিলনী' সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ। পত্রিকার সভাপতি সুমন নারায়ণ বাকরা। সম্পাদক ড. বিষ্ণুপদ জানা। ড. রামচন্দ্র মণ্ডল সোৎসাহে পত্রিকার একজন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়াও 'খেজুরী সৈকতে' পত্রিকার পরিবেশ ও ভাষা সাহিত্যের অনলাইন সংস্করণের শারদীয় সংখ্যা প্রণয়নে ড. মণ্ডল রয়েছেন উপদেষ্টার ভূমিকায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তিনি খেজুরীর সার্বিক উন্নয়নে এবং বিভিন্ন কাজের বাস্তব রূপায়ণ ও পর্যটনকারীদের মাধ্যমে খেজুরীকে ভারতের একটি বিশেষ স্থানে পৌঁছে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। খেজুরীর ইতিহাস সংরক্ষণ সমিতির প্রধান উপদেষ্টারপদ অলংকৃত করছেন তিনি।
(৩)
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ হল খেজুরী। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে হুগলি নদীর মোহনার পশ্চিম পাশে পলি মাটি জমে প্রথমে হিজলি এবং পরে খেজুরী নামে দুটি দ্বীপ জেগে উঠেছিল। তারপর বেশ কয়েক দশক পরের ঘটনা। হুগলি নদী দিয়ে ইতিমধ্যে অনেক জল বয়ে গেছে। সময়টাও বেশ কাকতালীয়। বাংলাদেশে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব কাল। ১৭৬৫ সালে গড়ে উঠেছিল খেজুরী বন্দর। বন্দরের গোড়াপত্তন করে ইংরেজরা। ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর এই খেজুরী বন্দর থেকে ইংল্যান্ড যাত্রা করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮৪২ ও ১৮৪৫ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও খেজুরী বন্দর দিয়েই বিদেশ ভ্রমন করেন। বিদেশি নাবিকরা সেসময় খেজুরীকে 'কেডগিরি' নামে সম্বোধন করত। জাহাজে করে বিদেশ থেকে চিঠিপত্র খেজুরীতে আসত বলে পূর্ব ভারতের প্রথম পোস্টঅফিস গড়ে উঠেছিল এখানে। সেটা ১৮০০ সালের কথা। তিনতলা ডাকঘরে, ১৮৫১–৫২ সালে, প্রথম চালু হয়েছিল ভারতবর্ষের টেলিগ্রাফ লাইন। সেজন্য ডাকঘরের নাম ছিল কেডগিরি পোস্ট অফিস। ডাকঘরের ঠিক সমুখে রয়েছে 'বাউটা' মঞ্চ। সমুদ্রে যত জাহাজ আসে, এ হেন বাউটা মঞ্চ থেকে প্রায় তেইশ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত অর্ধবৃত্তাকার আলো সমুদ্রে ফেলে জাহাজগুলোকে সিগন্যাল দেখিয়ে পথ দেখানো হত। কিন্তু অল্প দিনের ব্যবধানে, ১৮৬৪ সালে, এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় খেজুরী বন্দর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় প্রাচীন ডাকঘর। আড়াইশো বছরের বেশি সময় ধরে খেজুরী বন্দরে অতীতের স্মৃতি মাখা ডাকঘরের ঐতিহ্যের সাক্ষী বিলুপ্ত পোস্ট অফিসের ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি ঘর এবং বাউটা মঞ্চ আজও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। খেজুরী জুড়ে এমন অনেক পুরাতত্ত্ব নিদর্শনের ছড়াছড়ি। লোকচক্ষুর আড়ালে, উপযুক্ত প্রচারের অভাবে ঢাকা পড়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি।
এ হেন সমস্ত হেরিটেজ সম্পদ চিহ্নিত করে খেজুরীকে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে তুলে ধরার অদম্য প্রয়াস খেজুরীর প্রাক্তন বিধায়ক ও কৃষি বিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর। সালটা ছিল ২০১৬। রামবাবুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৈরি হয় 'খেজুরী হেরিটেজ সুরক্ষা কমিটি'। তিনি কমিটির সম্পাদক। এই হেরিটেজ সুরক্ষা কমিটির প্রথম কাজ হল – খেজুরীকে পর্যটন মানচিত্রে যুক্ত করে তার প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থানগুলি সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সেই মর্মে রামবাবুর প্রস্তাবে খেজুরী থেকে ১৮৩০-এ রাজা রামমোহন রায় এবং ১৮৪২-৪৫ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের খেজুরী বন্দর হয়ে বিলেত যাত্রার স্মৃতি রক্ষার্থে দুই মণীষীর পূর্ণাবয়ব মূর্তি প্রতিষ্ঠার ভাবনা গৃহীত হয়। হেরিটেজ সুরক্ষা কমিটির কর্মকর্তা ছাড়াও এলাকার একগুচ্ছ গুণীজন এই মহৎ কাজে এগিয়ে এলেন ও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু অষ্টাশি বৎসর বয়সে চিরতারুন্যে ভরপুর পণ্ডিত মানুষটি উপরের কর্মযজ্ঞকে সফল করার লক্ষ্যে কাণ্ডারীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন মাত্র।
রামচন্দ্র বাবু পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা শাসক তথা জেলা হেরিটেজ কমিশন, অফিস-ইন-চার্জ ট্যুরিজম থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরেও বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানায়। মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিষয়টির উপর খোঁজ খবর নেওয়ার নির্দেশ পৌঁছয় জেলাশাসক ও মহকুমাশাসকের দপ্তরে। রামবাবুর যোগাযোগের ফলে অতিরিক্ত মহকুমাশাসক, খেজুরী-১ ও খেজুরী-২ বিডিও খেজুরী পরিদর্শন করেন। খেজুরী-২ ব্লকের দর্শণীয় স্থানগুলিকে যুক্ত করে তৈরি হয় রিপোর্ট। সেই রিপোর্টের উপর দাঁড়িয়ে জেলাশাসকের পর্যটন মানচিত্রে স্থান পায় খেজুরী। এদিকে, সহসম্পাদক সুমন নারায়ণ বাকরা'কে সঙ্গে নিয়ে রামবাবু কাঁথিতে সেচ দফতরের আধিকারিকের সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনা করে মূর্তি দুটি বসানোর স্থান ও জায়গার পরিমাণ চিহ্নিত করেন। খেজুরী হেরিটেজ সুরক্ষা কমিটির সদস্য স্বপন মণ্ডল আর গঙ্গাধর দাস দুজনে মিলে মূর্তি দুটি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়। দুজনের প্রত্যেকে গড়ে প্রায় এক লক্ষ টাকা করে দান করেছিলেন। অর্থের যোগান কম হওয়ায় রামচন্দ্র বাবু অতিরিক্ত পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। সে-যাত্রায় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল মূর্তি বসানোর কাজ। মূর্তি দুটি তৈরির কারিগর শিল্পী মনোরঞ্জন কর-এর কারুকার্য অভূতপূর্ব আকর্ষণ।
পূর্ব ভারতের প্রথম ডাকঘর হিসাবে খেজুরীর ভগ্নপ্রায় প্রথম ডাকঘরকে কেন্দ্র করে একটি পোস্টাল মিউজিয়াম তৈরি, ডাকঘর সংলগ্ন স্থানে একটি ইকোপার্ক গড়ে তোলা, খেজুরী ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য কাছেপিঠে একখানা বিশ্রামাগার তৈরি করা, কোস্টাল হাইওয়েটিকে সংস্কার করা প্রভৃতি কাজগুলিকে বরাবর প্রাধান্য দিয়ে খেজুরীর উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রামবাবু। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক মানচিত্রে খেজুরী বন্দরকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র রূপে গড়ে তোলা ছিল তাঁর অদম্য জেদের ফসল।
খেজুরী হেরিটেজ সুরক্ষা কমিটির আরও একগুচ্ছ কাজের মধ্যে মুখ্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিশিষ্ট গুণীজনদের শ্রদ্ধা নিবেদন। উদাহরণ হিসেবে কিছু কাজের নমুনা নিচে তুলে ধরা হল।
প্রথমত, হিজলি বন্দর থেকে প্রথম ভারতীয় প্রতিনিধি মীর্জা শেখ ইতিশাবুদ্দীনের বিলেত যাত্রা (২৮ জানুয়ারি, ১৭৬৫; বাংলায় ১৩ই মাঘ, ১১৩১ বঙ্গাব্দ) দিবস উৎযাপন করা হয় ২৭ জানুয়ারি ২০২১ (১৩ই মাঘ, ১৪২৭) হিজলির মসজিদ ও মাজার সংলগ্ন স্থানে। দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে খেজুরী হেরিটেজ সুরক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে তিনটি স্মারক ফলক স্থাপন করা হয়।
🍂দ্বিতীয়ত, খেজুরী বন্দর থেকে সমাজ সংস্কারক, নারী মুক্তির দিশারী ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের বিলেত যাত্রা (২০ নভেম্বর ১৮৩০) দিবস উদযাপন করা হয় ২০ নভেম্বর ২০১৭ সালে। সেদিন তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। হেরিটেজ সুরক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। স্মরণিকার প্রতিবেদনে রামচন্দ্র মণ্ডল-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাড়াও 'কে এই রামমোহন' প্রবন্ধখানি প্রকাশিত হয়।
খেজুরী বন্দর হয়ে বিলাত যাত্রা (১৮৪২ ও ১৮৪৫) করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রাজা রামমোহন রায়ের মূর্তির পাশে তাঁর একটি পূর্ণাক্ষ মূর্তি স্থাপন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় ২০শে নভেম্বর ২০১৭ সালে।
তৃতীয়ত, ইতিহাসকার মহেন্দ্রনাথ করণ (জন্ম ১৯.১১.১৮৮৬ & মৃত্যু ১৭.০৭.১৯২৮)-এর জন্মদিন ও মৃত্যু দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্মরণ করা হয়। ১৭ই জুলাই ২০২২ 'ইতিহাসকার মহেন্দ্রনাথ করণ' পুস্তকখানি সম্পাদনা করেন ইতিহাস সংরক্ষণ সমিতির কোষাধ্যক্ষ স্বপনকুমার মণ্ডল। ড. রামচন্দ্র মণ্ডল রচিত একখানা প্রবন্ধ 'বহুবরেণ্য মণীষী মহেন্দ্রনাথ করণ' উপরের গ্রন্থে সংযোজন করা হয়েছে।
চতুর্থত, কশাড়িয়া মোড় সংলগ্ন নিজগ্রাম এলাকায় সমাজ সংস্কারক সাহিত্য সেবী, বঙ্গীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা, আর্য পৌন্ড্রক বৃত্তি বিচার ইত্যাদি পুস্তিকার প্রণেতা মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল (১৮৮০ – ১৯৪৩)-এর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় ২৬শে নভেম্বর ২০১৭ সালে। মণীন্দ্রনাথ স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতির পক্ষে সভাপতি ড. রামচন্দ্র মণ্ডল এবং সম্পাদক কুন্তল কান্তি মণ্ডল ভারতবর্ষে দলিত আন্দোলনের প্রথম জাতীয় নেতা খেজুরীর মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল – স্মরণিকা ২০১৭ প্রকাশ করেন।স্মরণিকায় প্রকাশিত হয় "মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল-এর স্মৃতি বিজড়িত কশাড়িয়া ও তাঁর জীবন কাহিনী। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ড. রামচন্দ্র মণ্ডল।
পঞ্চমত, কাঁথির প্রথম সাংসদ বসন্ত কুমার দাস-এর আদি নিবাস রামচকে পথের ধারে একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় 'প্রবাসী খেজুরী' সংগঠনের প্রচেষ্টায়। ড. রামচন্দ্র মণ্ডল ওই সংগঠনের একজন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ড. মণ্ডল একটি প্রবন্ধ লেখেন 'চির বসন্ত বসন্ত কুমার-এর স্মৃতিচারণ'।
ষষ্ঠত, ড. বি আর আম্বেদকর-এর একটি আবক্ষ মূর্তি বিদ্যাপীঠ মোড়ে ছাতিম গাছের তলায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূর্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সভাপতি ড. রামচন্দ্র মণ্ডল। তিনি মূর্তি উদ্বোধন উপলক্ষে একখানা পুস্তিকা প্রকাশ করেন "বঞ্চিত জনতার মুক্তিদাতা ও ভারতীয় সংবিধান রচয়িতা – ড. বি. আর. আম্বেদকর"।
সপ্তম, মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার খেজুরী শাখার সদস্যগণের উদ্যোগে ঠাকুরনগরের মেলা কমিটির সহযোগিতায় এবং ড. বিষ্ণুপদ জানা'র সক্রিয় ভূমিকায় 'ক্ষুদিরামের' খেজুরী থানায় ঠাকুরনগরে দোলপূর্ণিমায় আগমনকে স্মরণ করে নির্ভীক শহীদ ক্ষুদিরামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় ঠাকুরনগর মেলা প্রাঙ্গণে, ২০২৩ সালে। মেলা কমিটির স্মরণিকা ২০২৩-এ ক্ষুদিরাম সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ "অগ্নিযুগের অনন্ত বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম' লিখেছেন ড. রামচন্দ্র মণ্ডল।
(৪)
খেজুরীর গর্ব ব্রিটিশ আমলে তৈরি পূর্ব ভারতের প্রথম ডাকঘর। পোস্টঅফিসের ঘরগুলো কবেই ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে! শুধু ডাকঘর সংলগ্ন সিঁড়ি ঘরখানা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে গৌরবময় অতীত ইতিহাস মনে করিয়ে। ডাকঘরের ঠিক সমুখে পূর্ব দিকে লাইট হাউস 'বাউটা মঞ্চ'-এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। লাইট হাউসের কিছুটা দূর দিয়ে উত্তর দক্ষিণে বয়ে চলা হুগলি নদী তার স্বাক্ষী। ইংরেজ আমলে হুগলি নদীতে যখন বড় বড় জাহাজ ও লঞ্চ সার্ভিস চালু ছিল, বঙ্গোপসাগর থেকে নদী পথে জাহাজ পৌঁছে যেত কলকাতা, হলদিয়া; তখন নদীতে জাহাজকে রাস্তা দেখাতে আলোর মজবুত সিগন্যাল ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায় মনে। অপরিসীম কৌতুহল নিয়ে একদিন হাজির হয়েছিলাম অতীতের জীর্ণ ডাকঘরে। ছুঁয়ে দেখলাম চুন সুরকির দেওয়াল, ইঁটের স্তুপ, বালি মাটি। বর্তমানে ডাকঘর ও লাইট হাউস দুটোরই ভগ্ন দশা। ডাকঘরের শরীর থেকে অল্প অল্প খসে পড়ছে চুন সুরকির অলংকার। কোথাও কোথাও ক্ষয়ে গেছে ইঁটের দেওয়াল। বেরিয়ে পড়েছে বুকের কঙ্কাল, হাড়-পাঁজরা। তবুও মেরুদন্ড সোজা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতীতের স্মৃতিমাখা পোস্ট অফিসের সিঁড়ি ঘর। ওদিকে, বাউটা মঞ্চের গোটা শরীর জুড়ে সবুজ শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। লতা পাতা জড়িয়ে ধরেছে পরম মমতায়। হালে দুটোর ভাগ্যেই জুটেছে হেরিটেজ সম্মাননা, বৈজ্ঞানিক রামচন্দ্র মণ্ডল ও খেজুরী পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ কমিটির অক্লান্ত পরিশ্রম ও একটানা লড়াইয়ের ফলে। এখন ডাকঘর ও লাইট হাউসের চারপাশে লোহার রেলিং ঘেরা চারকোনা বেড়া। বেড়াজালের বাঁ পাশে উত্তরে ছিমছাম বিনোদন পার্ক। পরতে পরতে আধুনিকতার ছোঁয়া। পার্কের ঘাসগুলো আগাগোড়া মেশিন কিংবা দক্ষ হাতে ছাঁটাই করা। কংক্রিটের ঝাঁ চকচকে প্লাস্টার করা রাস্তা।
পার্কের ভিতর একদল কচিকাঁচা খেলাধুলায় মত্ত। অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দা। গুটি কয়েক অল্প বয়সী লোক যারা বাইরে থেকে এসে ভিড় জমিয়েছে পার্কে, তাদের নজর পার্কে নয়; ভগ্নপ্রায় পোস্ট অফিস ও বাউটা মঞ্চের উপর ক্ষীপ্র কৌতুহলী দৃষ্টি সবার। মোবাইলে সেলফি তোলার হিড়িক। ডাকঘরের গায়ে আঁচড় কেটে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে কেউ কেউ। অদৃশ্য রক্ত ঝরে। অব্যক্ত কান্নায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে পোস্ট অফিস। আড়াইশো বছর ধরে। থমকে দাঁড়ায় সময়।
বর্তমানে পোস্ট অফিসের সিঁড়ি ঘর আর বাউটা মঞ্চের মদ্যিখানে তৈরি হয়েছে আধুনিক সেলফি-জোন। নিজের সুন্দর চকচকে মুখের ব্যাকগ্রাউন্ডে ভগ্নস্তুপ ডাকঘরকে মোবাইলে ধরার অদম্য প্রয়াসে তৈরি সেলফি স্ট্যান্ড আদতে প্রাচীন ডাকঘরটিকে পর্যটকদের সরাসরি অত্যাচার থেকে রক্ষা করার দারুণ উদ্যোগ।
পোস্ট মাস্টার কিংবা ইংরেজ অফিসারদের বসবাসের জন্য ডাকঘরের অনতিদূরে রয়েছে একখানা দ্বিতল ডাক বাংলো। এখন আদতে পোড়ো বাড়ি। একসময় এলাকায় খুব নামডাক ছিল। বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত। দোদর্ণ্ডপ্রতাপ বাড়িটির এখন অবশ্য না আছে কৌলিন্য, না আছে ঐতিহ্য। বর্তমানে শুধুই অতীতের ধ্বংসস্তূপ। ভগ্নপ্রায় ডাকবাংলো বাড়িতে গুটি কয়েক ইঁদুর কিংবা সাপ খোপের বাস। দুই দিকে জঙ্গল। ঝোপঝাড়। গা ছমছম ঐতিহাসিক ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার। লৌকিক গুজবে কান ভারি হয়। পূর্ব দিকে সামান্য ক'ছটাক ফাঁকা জায়গা। সেই খালি জায়গায় ফুটবল খেলছে একদল কিশোর। ঠিক মতো দাড়ি গোঁফ গজায়নি। এক মনে খেলায় মেতে রয়েছে সকলে। চেঁচামেচি। হইহুল্লোড়। যেন প্রাণ খুঁজে পায় নিঃসঙ্গ ভূত বাড়ি।
চৌঠা ডিসেম্বর ২০২২। রবিবার। ছুটির দিন। রামচন্দ্র বাবুর বাড়ি থেকে ভাতৃপ্রতিম বাপ্পার বাইকে চেপে যখন অতীতের ডাকঘরে পৌঁছেছিলাম, ঘড়িতে তখন বিকেল পৌনে চারটা বাজে। শেষ বিকেলের রাঙা আলোয় রঙিন হয়ে উঠেছিল ডাকঘরটি। পোস্ট অফিসের পাশে পার্কে স্থানীয় কচিকাঁচার কলরবে মুখরিত হয়েছিল বাতাস। আকাশ জুড়ে রঙ-বেরঙের আলোর মেলায় উৎফুল্ল হয়েছিল উতলা মন। পোস্ট অফিসের আগে রাস্তার ধারে রাজা রামমোহন রায় এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রাণহীন পাথরের অস্তিত্ব। নির্বাক। অবাক করেছিল ইতিহাস।
অতীতের ডাকঘর দেখে ফিরে এলাম আর এক ঐতিহাসিক নিদর্শনে। নীলকুঠি। নীলকর সাহেবদের অপরিমিত অত্যাচারের স্মৃতি এই কুঠি। জায়গাটি মূল পাকা রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। সরু আঁকাবাঁকা ঢালাই রাস্তার ধারে। কয়েকশো মিটার হাঁটা পথ। ঘিঞ্জি রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু মুসলিম পরিবারের বাস। মূল জায়গা ঠাহর হয় না। সন্ধ্যা নামার মুখে জটলা দেখে বাইক থামায় বাপ্পা। জিজ্ঞেস করি, নীলকুঠির অবস্থান। একজন মুসলিম যুবক এগিয়ে আসে। নীলকুঠির পথ দেখায় অচেনা মুসলিম যুবকটি। যে-রাস্তা বরাবর অচেনা গন্তব্যে এগিয়ে গিয়েছিলাম, সে-রাস্তায় পেছন দিকে ফিরে আসি আমরা তিনজন। কখন যে কুঠি পেরিয়ে গেছি, খেয়াল নেই! শেষমেশ যখন গন্তব্যে পৌঁছই, সন্ধ্যা হব হব করছে। কিন্তু এ কী অবস্থা! অনাদর-অবহেলায় নীলকুঠির ভাঙা চৌচির দশা। বাঁশের ঝোপে এমন ঢাকা পড়ে গেছে পুরো চত্বর যে কুঠি খুঁজে পাওয়া বেজায় দুস্কর। সন্ধান মিললেও কুঠির ভেতরে যেতে ভয় করে। এত আবর্জনা! এত অপরিস্কার! বাঁশের পাতায় ভরে গেছে মাটি। ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়ে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের ভেতর দিক। সন্ধ্যার মুখে আলো আঁধারির সংমিশ্রণে গা ছমছম করে কাছে যেতে। কুঠির একটিও ঘর আস্ত নেই। হয় ভেঙে পড়েছে, নয় তো এবড়ো খেবড়ো মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর। ভাঙা দেওয়ালগুলো অর্ধেক হেলে রয়েছে। প্রাচীরের গায়ে বড় সড় ফাটল। কাছে গেলে হৃৎপিণ্ড ছ্যাঁৎ করে ওঠে। অজানা, অচেনা আতঙ্কে শিউরে উঠে হৃদয়। কুঠির পাশে ঢালাই রাস্তার ধারে রয়েছে নীল-পুকুর। নাহ! এখন পুকুরের জল নীল বর্ণ নয়। নীলকর সাহেবদের আমল থেকে পুকুরের নামকরণে এমন উদ্ভট জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে এলাকায়। সেই পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কয়েকজন মুসলিম তরুণের সঙ্গে। একসময় কথা প্রসঙ্গে রামবাবুর প্রসঙ্গ ওঠে। একজন মুসলিম যুবক, বয়েস পঁচিশ বা তার বেশি, হঠাৎ বলতে শুরু করে —
'রামবাবুর মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুর্লভ। কেবলমাত্র উনার জন্যই এই কুঠি, ডাকঘর, লাইট হাউস সংরক্ষণের আওতায় এসেছে। অন্যথায়, কবেই এতসব প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।'
'খেজুরীতে আরও তো অনেক মানুষ আছেন। রামবাবুর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাঁরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন' — কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি। মুসলিম যুবকের ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর —
'যাদের নামগুলো বললেন, তাদের সব লোক দেখানো ব্যাপার স্যাপার। একমাত্র রামবাবুই ছিলেন গরীবের প্রতি সংবেদনশীল। সহানুভূতিশীল। খেজুরীর উন্নয়নের একমাত্র কাণ্ডারী। স্বার্থশূন্য পরোপকারী একজন পণ্ডিত মানুষ। উন্নত খেজুরী গড়ার লক্ষ্যে তাঁর প্রয়াস, সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং মাটির কাছাকাছি থাকার বাসনা বাকি সকলের চেয়ে ভিন্ন।'
উপরের ঘটনায় একথা প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত জাতপাত ধর্ম বর্ণ'র উর্ধ্বে বৈজ্ঞানিক রামচন্দ্র মণ্ডল ছিলেন সর্ব ধর্মের সমন্বয় সাধক। তাঁর স্বার্থহীন উদ্যমের কথা সামান্য একজন মুসলিম যুবকও বিস্মৃত নয়। এখানেই তাঁর মহত্ব। এজন্য তিনি মহান। (সমাপ্ত)
তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক
ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব
মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি
0 Comments