পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৮৮
গমহা পূর্ণিমা
ভাস্করব্রত পতি
একে 'গমহা পূর্ণিমা' ছাড়াও বলে 'গমহা পুনি', 'গমহা পুনেই', 'গোয়াল পূজা', 'গোয়াল চণ্ডী', 'গরু পূজা', 'গমা পূর্ণিমা' ইত্যাদি। এককথায় ভাদ্রের রাখী পূর্ণিমাতে গরুর পূজার্চনা করা। যদিও অনেকের মনে খটকা আসতে পারে যে কার্তিক মাসে দীপাবলীর পরে গোয়াল পূজা বা গরু পূজা হয়। একে বাঁধনা পরবও বলে। তবে এখন এটা কি ধরনের গরু পূজা? এটিতেও অবশ্য গো মাতাকেই পূজা করা হয়। তবে এক্ষেত্রে পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার রামনগর, বালিসাই এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোপীবল্লভপুর অঞ্চলে রাখী পূর্ণিমার দিন পালিত হয় এই গমহা পূর্ণিমা। এককথায় সূবর্ণরৈখিক এলাকায় দেখা যায় এই লৌকিক উৎসব। ওড়িয়া সংস্কৃতির অঙ্গ। মূলতঃ মেদিনীপুরের যেসব অংশ ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের অধীনে ছিল একসময়, কেবলমাত্র সেখানেই দেখা যায় এই উৎসব। অন্য কোথাও দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেই হিসেবে একে ওড়িয়া সংস্কৃতির একটি অঙ্গ বলা চলে।
সূবর্ণরৈখিক ভাষা সমৃদ্ধ অঞ্চলের গবেষক, শিক্ষক সুদীপ কুমার খাঁড়ার মতে, সম্ভবত 'গো মাতা' শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে 'গমহা' শব্দের। উচ্চারণের ভেদে 'গোমাতা পূর্ণিমা' থেকে 'গমহা পূর্ণিমা' হয়েছে।
গোমাতা > গমহা
আর 'পূর্ণিমা' থেকে এসেছে 'পুনি' বা 'পুনেই' বা 'পুনাই' শব্দগুলি। তবে 'পুনাই' কিন্তু আলাদা এক দেবতার নাম। পূর্ব বাংলায় মাঘী পূর্ণিমার দিন মহিলারা 'পুনাই' নামের এক ব্রতের দেবীকে পূজা করেন। রাতের বেলা উঠোনের একপাশে ছোট চৌকা গর্ত তৈরি করা হয়। সেখানে নানা ধরনের পিঠের নৈবেদ্য দেওয়া হয় দেবীর উদ্দেশ্যে। মানুষের বিশ্বাস যে, এর ফলে গৃহস্থের এবং পরিবারের সকলের সুখ সমৃদ্ধি ও শ্রীলাভ ঘটে।
পূর্ণিমা > পুনেই / পুনি / পুনাই
এদিন ‘এঁড়ে’ গরু ও ‘বকনা’ গরুর সিঙেতে তেল, সিঁদুর ও হলুদ মাখিয়ে পূজো করা হয়। তবে এঁড়ে গরুর সিঙে পৈতে পরানো হয়। আর মাদী গরুর সিঙে রাখী অথবা থুপনা পরানো হয়। এই থুপনা হল সরু সূতো দিয়ে বাঁধা আলতা মাখা তুলোর মণ্ড।
বাড়ির পুরোহিত বা ব্রাম্ভণ ঠাকুর এদিন গরু ও ঘরের লোকজনদের সবার জন্যে একটি করে পৈতে দিয়ে যান। ঐ পৈতে গরুর গলাতেও পরিয়ে দেওয়া হয়। সেইসাথে গরুর বিয়ে দেওয়া হয়। সাদা ফুল এই পূজোতে বেশি করে প্রয়োজন। সাদা ফুল হিসেবে শালুক ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, গমহা পূর্ণিমার পূজায় ওলোটচণ্ডাল বা অগ্নিশিখা ফুল এবং শনপাট গাছের ফুল অবশ্যই লাগে। রামায়ণ অনুসারে বৈদ্য সুষেনের নির্দেশে হনুমানকে যেসব ঔষধি গাছ সমূহ আনতে বলা হয়েছিল, তার মধ্যে ওলোটচণ্ডাল একটি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Gloriosa superba। এটি Colchicaceae পরিবারভুক্ত। জিম্বাবোয়ের জাতীয় ফুল এটি। ১৯৪৭ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তাঁর ২১ তম জন্মদিনে রোডেশিয়া (এখনকার জিম্বাবোয়ে) ভ্রমনকালে এই ফুলের আকারে একটি হিরে উপহার দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজ্য ফুলের তকমা দেওয়া হয়েছে একে। তামিল ভাষায় একে কিঝাঙ্গু, সেঙ্গানথাল এবং কানভালি নামেও চেনে। ইংরেজিতে Flame Lily, Climbing Lily, Tiger Claw, Fire Lily, Glory Lily এবং Creeping Lily ও বলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ফুলের নামকরণ করে রাখেন 'অগ্নিশিখা'! আর শনপাট গাছের চাষ এখন প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে। একে বলে ব্রাউন হেম্প, ম্যাড্রাস হেম্প, সান হেম্প বা ইণ্ডিয়ান হেম্প। ফ্যাবেসি (Fabaceae) পরিবারভুক্ত শনপাট গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Crotalaria juncea। এটি একটি ভেষজ গাছ। এর বাকল থেকে তন্তু পাওয়া যায়। গেরস্থের জ্বালানীর কাজেও লাগে। শন গাছকে পচিয়ে যে তন্তু বা ছাল বা আঁশ বের হত, তা 'কোস্তা' নামে পরিচিত। সেই কোস্তাকে ঢেরায় পাকিয়ে বাটিয়া দড়ি বানানো হয়।
সন্ধ্যার মুখে শুরু হয় গমহা পূর্ণিমার পূজো। গমহা পূর্ণিমা তেমন আড়ম্বরপূর্ণভাবে আয়োজিত হয়না। এতে উপকরণ হিসেবে লাগে সিঁদুর, হলুদ, পৈতা, বেনে বাজার, সাদা ফুল, সরিষার তেল, রুটি এবং কাঁকড়া পিঠা। পূজার নৈবেদ্য ভোগ হিসাবে রুটি, ঘিয়ে ভাজা পিঠে (কাকড়া পিঠে) তৈরি করা হয়। এতে কোনো লবন দেওয়ার রেওয়াজ নেই। সেইসাথে দেওয়া হয় নানা ধরনের ফল এবং মিষ্টি। গরুকে খুব যত্ন করে খেতে দেওয়া হয় পিঠে। বাড়ির লোকজনও খান। তবে খাওয়ার আগে তাঁরা আশেপাশের সকল জীবজন্তু ও পাখপাখালির নামে উৎসর্গ করে। পূজোর সময় প্রদীপ জ্বালানো হয়। বাড়ির মহিলারা শাঁখ বাজান। ধূপ ধুনো দেওয়া হয়। পুরোহিত তথা বাড়ির বয়স্ক মহিলারা যেমন ঠাকুমা, জ্যাঠাইমা, কাকিমারা ঘন্টা বাজিয়ে পূজো করেন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মান্দারমনি কোস্টাল থানার বালিসাইয়ের দুবলাবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা জ্যোতির্ময় খাটুয়া এই গমহা পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে ছোটবেলার কিছু মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, "এই পুজো উপলক্ষে পিঠা চুরি করে খাওয়ার একটা অলিখিত নিয়ম আছে। বিশেষ করে ইয়াং ছেলেরা অপেক্ষায় থাকতাম, কখন শাঁখ বা ঘন্টি বাজানো বন্ধ হবে। শাঁখ বা ঘন্টি বাজানো বন্ধ হলেই আমরা পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে গপাগপ পিঠে খেয়ে নিতাম। পিঠে চুরি করার সময় অনেক মজার ঘটনা ঘটতো! এই যেমন গরুর লাথ খাওয়া, গরুর খুঁটায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া, গোবরে পা পড়ে স্লিপ করে পড়ে গিয়ে সারা গায়ে গোবর লেগে যাওয়া, গরুর গুঁতো খেয়ে যন্ত্রনায় ছটকানো ইত্যাদি ইত্যাদি...."।
অনেক সময় গরুর লাথি গিয়ে লাগতো চুরি করতে আসা ছেলেদের গোপন জায়গায়! কিন্তু এক্ষেত্রেও কোনো শব্দ করা যেতোনা। মুখ বুজে থাকতে হত! উল্লেখ্য, বাঁধনা পরবের রাতেও এরকম চুরি করতে বেরোতো কচিকাঁচারা। তবে তাঁরা সেক্ষেত্রে আঁখ, কলা এবং কাঁচা সুপুরি নিত। ঐ আঁখ দিয়ে 'ধা রে মশা ধা' করত। গমহা পূর্ণিমায় চুরি করে পিঠা খেতে গিয়ে গরুর লাথি খাওয়ার যন্ত্রনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জ্যোতির্ময় খাটুয়া জানিয়েছেন, "যন্ত্রনায় ছটকাবে, কিন্তু মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোতো না। আওয়াজ পেলেই বাড়ির মালিক জেনে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জানাজানি হয়ে গেলে লাইট জ্বালিয়ে চিৎকার শুরু করে তাড়াতে থাকবে। ধরা পড়লে মান সম্মানের ব্যাপার। তাই যতই যন্ত্রনা হোক নাক মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোতো না"।
তবে ঝাড়গ্রামের দক্ষিণ অংশে গমহা পূর্ণিমার উপচার সম্পর্কে ড. মধুপ দে উল্লেখ করেছেন, "এই দিনে হিন্দু ঘরের পুরুষরা প্রাতঃস্নান সেরে নিজের ঘরে পৈতে পরার জন্য পুরোহিতের অপেক্ষা করতে থাকে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ নূতন পৈতে নিয়ে যজমানের ঘরে ঘরে আসেন। তাঁরা ছোটো থেকে বড় সব পুরুষ সদস্যদের কপালে নূতন পৈতে ঠেকিয়ে মন্ত্র পড়েন এবং পৈতে পরিয়ে দেন। অবশ্যই গৃহকর্তা এর জন্য পুরোহিতকে যথাযোগ্য দক্ষিণা প্রদান করেন। এই এক দিনের জন্য জঙ্গলমহলে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্রের ব্যবধান মুছে যায়। গমহা পরবের দিনে গোপীবল্লভপুরের সকলেই রাখির মত পৈতা পরে। জাতিভেদহীন এই দিনে সকলেই পৈতেধারী ব্রাহ্মণ"।
সকলের মধ্যে পৈতে পরার চল রয়েছে এই সময়। বাড়ির পুরোহিত বা অন্যান্য ব্রাম্ভণরা এই সময় রাখীর সাথে পৈতেও নিয়ে আসে। আর লোকজন ব্রাম্ভণকে উপযুক্ত দক্ষিণা দিয়ে পৈতে ধারণ করে। সাধারণত দিনটি অতিবাহিত হলেই ঐ পৈতে জলে ফেলে দেওয়ার রেওয়াজ। কিন্তু অনেকেই তা ফেলেনা। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলের দল পৈতে গলাতেই ঝুলিয়ে রাখে, যতদিন না এটা ছিঁড়ে যায়। আসলে প্রত্যেকের মধ্যে ব্রাম্ভণ হওয়ার সুপ্ত বাসনা জাগে। এই গমহা পূর্ণিমা সেই সুযোগ করে দেয় তাঁদের। এইসময় ব্রাম্ভণগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৈতে পরিয়ে ভালো অর্থ উপার্জন করে। এদিন পূর্ণিমা হলেও অনেকের বাড়িতে মাংস রান্না হয়ে থাকে। এই ধরনের লৌকিক উৎসব কিন্তু অন্যত্র দেখতে পাওয়া যায় না।
🍂
0 Comments