পর্ব ৮৫
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
কবি বিবেকানন্দ
গদ্য রচনায় শুধু নয়, কাব্যসৃষ্টিতেও সমানভাবে সমুজ্জ্বল স্বামীজীর প্রতিভা। ইংরাজি বাংলা উভয় ভাষাতেই অসামান্য ভাবসমৃদ্ধ, আধ্যাত্মিকতার উচ্চ স্তর প্রকাশকারী সব কাব্য রচনা করেছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য তাঁর ‘Kali The Mother’ কবিতাটি। ইংরাজি ভাষায় লেখা। বিবেকানন্দ এই কবিতাটি রচনা করেন ১৮৯৮ সালে। সেই সময় উনি পাশ্চাত্য ভক্তদের সঙ্গে কাশ্মীরের ডাল লেকে একটি হাউসবোটের মধ্যে বসবাস করছিলেন। এই যাত্রার অন্যতম সঙ্গী ছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। কবিতাটির শুরুর কয়েকটি পংক্তি এইরকম -- The stars are blotted out, ,/ The clouds are covering clouds,/ It is darkness vibrant, sonnet./ In the roaring, whirling wind/ Are souls of a million lunatics/ Just loose from the prison-house,/ Wrenching trees by the roots,/ Sweeping all from the path. পরবর্তী সময়ে এই কবিতারই বঙ্গানুবাদ করলেন ছন্দের রাজা কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর শেষ কয়েকটি পংক্তি এইরকম -- “লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,/ নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!/ করালি! করালি তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে/ তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!/ কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে।/ সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,/ কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারই কাছে আসে।”
এই অতি সুবিখ্যাত রচনাটির প্রেক্ষাপট বিষয়ে সিস্টার নিবেদিতা লিখেছেন -- “অমরনাথ যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা ছিল শিববিষয়ক চিন্তার সঙ্গে জড়িত; প্রতি পদক্ষেপে মনে হইত, আমরা সেই চিরতুষারমণ্ডিত মহান পর্বতমালার সমীপবর্তী হইতেছি, যাহা একাধারে তাঁহার প্রতিরূপ এবং আবাসভূমি। সায়াহ্নে তুষারময় গিরিসঙ্কট ও আন্দোলিত সরল বৃক্ষগুলির উপর দিয়া দৃশ্যমান নবীন চন্দ্রমা যেন আমাদের জোর করিয়া মহাদেবের কথা স্মরণ করাইয়া দিত।... যাহা হউক, কোন অজ্ঞাত কারণে, আগস্ট মাস হইতে স্বামীজীর চিত্ত শিব হইতে শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়। সর্বদাই তিনি রামপ্রসাদের গানগুলি গাইতেন, যেন নিজেকে শিশুরূপে কল্পনা করিয়া সেইভাবে মগ্ন হইতে চাইতেন। একবার তিনি আমাদের কয়েকজনকে বলেন, যে দিকেই দৃষ্টিপাত করিতেছেন, জগন্মাতার উপস্থিতি অনুভব করিতেছেন -- যেন তিনি সাকার রূপ ধারণ করিয়া কক্ষমধ্যে বিরাজ করিতেছেন। সর্বদা জগন্মাতা সম্বন্ধে অত্যন্ত সরল ও স্বাভাবিকভাবে কথা বলা তাঁহার অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। আমাদের দলের মধ্যে যাঁহারা প্রবীণ ছিলেন, তাঁহারাও এই ধরণের কথাবার্তা বলিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সুতরাং কোন সযত্নপোষিত উদ্দেশ্য ত্যাগ করিবার প্রয়োজন হইলে তাঁহারা এই বলিয়া মনকে প্রবোধ দিতেন, ‘মার যা ইচ্ছা, মা সব জানেন।’
🍂
কিন্তু ক্রমে স্বামীজীর তন্ময়ভাব গাঢ়তর হইল। ... একদিন তিনি বলেন, তাঁহার মাথায় কতকগুলি চিন্তা প্রবল হইয়া উঠিয়াছে এবং উহাকে লেখনী সাহায্যে প্রকাশ না করা পর্যন্ত তাঁহার অব্যাহতি নাই। সেই সন্ধ্যায় কোন স্থান ভ্রমণের পরে বজরায় প্রত্যাবর্তন করিয়া দেখিলাম, স্বামীজী আসিয়াছিলেন এবং আমাদের জন্য স্বহস্তে লিখিত ‘Kali The Mother’ কবিতাটি ( মৃত্যুরূপা মাতা ) রাখিয়া গিয়াছেন। পরে শুনিলাম, দিব্যভাবে তীব্র উন্মাদনায় কবিতাটির লেখা শেষ হইবামাত্র তিনি মেঝের উপর পড়িয়া গিয়াছিলেন।” ( স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি )
আবার ‘সখার প্রতি’ কবিতায় অসার সংসারের অস্তিত্বকে তুলে ধরেছেন। লিখছেন -- ‘আঁধারে আলোক অনুভব, দুঃখে সুখ রোগে স্বাস্থ্যভান; / প্রাণসাক্ষী শিশুর ক্রন্দন, হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান ?/ দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার, পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান;/ ‘স্বার্থ’ ‘স্বার্থ’ সদা এই রব, হেথা কোথা শান্তির আকর?/ ... যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়।/ হৃদিবান নিঃস্বার্থ প্রেমিক! এ জগতে নাহি তব স্থান;/ লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত মর্মর-মূরতি তা কি সয়?/ হও জড়প্রায় অতিনীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল--/ সত্যহীন স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।’
১৮৯৮ সালে আমেরিকান অনুগামী সমভিব্যহারে কাশ্মীর পরিভ্রমণকালে আরেকটি অসামান্য কবিতার জন্ম দেন স্বামীজী। এর রচনার প্রেক্ষাপটটি ছিল চমকপ্রদ। তাঁর এই অনুগামীদের জন্য মার্কিন স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্যে স্বামীজী লিখে ফেললেন কবিতাটি। To The Fourth July. সেইদিন প্রাতরাশের সময় পাঠ করলেন। ৪ জুলাই তারিখটি বিবেকানন্দের জীবনেও অদ্ভুত তাৎপর্যময়। কেননা এর ঠিক চার বছর পর অর্থাৎ ১৯০২ সালে বেলুড় মঠে এই তারিখেই মহাসমাধিতে লীন হন। ইংরেজি ভাষায় লেখা কবিতাটি এইরকম --‘ Behold, the dark cloud melts away,/ That gathered thick at night, and hung/ So like a gloomy pall above the earth!/ Before my magic touch, the world/ Awakes. The birds in chorus sing./ The flowers raise their star-like crowns --/ Dew-set, wave thee welcome fair./ The lakes are opening wide in love/ Their hundred thousand lotus-eyes/ To welcome thee, with all their depth./ All hail to thee, thou Lord of Light!/ A welcome new to thee, today,/ O Sun! Today thou sheldest liberty!’ ‘সন্ন্যাসীর গীতি’ কবিতাটি স্বামীজীর লেখা অপর একটি ইংরেজি কবিতা। ( ‘The Song of Sannyasin’ ) বঙ্গানুবাদে এইরকম -- ‘উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,/ হিমাদ্রিশিখরে উঠিল যে গান -- / গভীর অরণ্যে পর্বতে-প্রদেশে/ সংসারের তাপ যেথা নাহি পশে, / যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরী/ সংসারের রোল উঠে ভেদ করি!/ কাঞ্চন কি কাম যশ-আশ/ যাইতে না পারে কভু যার পাশ; / যথা-সত্য-জ্ঞান- আনন্দ-ত্রিবেণী/-সাধু যাঁর স্নান করে ধন্য মানি,/ উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান;/ গাও গাও গাও, গাও সেই গান-/ ওঁ তৎ সৎ ওঁ।’
0 Comments