বাগদি চরিত (পঞ্চবিংশ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
কথায় আছে পচা ভাদ্র। কাদা প্যাচপ্যাচানি বৃষ্টি কদিন ধরেই ঝরে চলেছে। থামবার যেন কোন লক্ষণ নাই। পেত্তোবা পাট কাচছিল তাদেরই ভিটার সামনে ডবায়। মাথায় পলিথিনের বস্তাকে বৌ ঘোমটা করে দিয়ে রেখেছে। নিচের অংশটা পেটের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা। এক তাড়া পাট নিয়ে কাঠের হাতাটা দিয়ে গোড়ার দিকটায় থাবড়া বসাচ্ছে। আর আনাধুম খিস্তি খেউড় করে চলেছে বিষ্টিকে।
— তোর গুষ্টির লিকুচি করি, শালা বিষ্টি। হবি ত, হবার মতো হ। তা না! শালা টিপটিপানির বাতিক উঠেচে।
জ্বালি পুড়ি খেল শালা সব্বনেশা বিষ্টি।
— অত রেগে যাউঠু কেনে রে পেত্তোবা? সাধে কি কত্তারা বোলত ভাদ্দরর পনর দিন মুচির আর পনর দিন চাষির। ইটা ত শেষ বেরষার বিষ্টি রে। ই কদিন এখন ছাড়বেনি।
— কুন্তু ই ত তমাদের কুনু টপকা শুলুক মানেঠে নি গ। আগাশটার কি ঝরন্তি রোগ হই গেল নাকি, বল দিখি চঁচি খুড়া। উশালা মানুষ হলে নি,অর হাত পিটে মেকান ভেঙে দিতম,এগবারে।
— তোর রাগটা অনাজ্জ লয় রে, পেত্তো।পাটের তাড়া গুলান শুকাতে দিতে হবে,গাঁটরি বেঁধে তুলে রাখতে হবে। প্যাকাটি শুকনা কত্তে হবে। অনেকই কাজ আছে জানি। কুন্তু আগাশ না ধরণ কল্লে ত কিছুই কত্তে পারবিনি।
— থাইলে বল দিখি খুড়া! ই সব কম নিজ্জাতনের কাজ। কত উড়নিপুড়নি কত্তে হবে বল দিখি!
— তুই ত বহুদিন আগেই পাটের বজা পচাতে দিইলু। তদ্দিন কাচুনি কেনে? মোদের হাজা ডুবা এলাকার ভাবগতিক ত তুই জানতু।
— তা জানতম। জানি কটা দিন ধরন দিলেই কাজ করে লুব খন। ই ত দেখি আড়েও মরণ তাড়েও মরণ।
— থাইলে একটা মজুর করলিতে ত পাত্তু।
— আর মোজুর। উকিল মুক্তার মিলবে, মোজুর মিলবেনি। কত পায়ে তেল মাখাতে হবে৷ জান! তার উবরে লাট বাদশা চাল। সেই উঠা সুজ্জু ডুবা সুজ্জুর দিন কুন কালেই ফুরি গেছে। তাবাদে এখন মোদের জাতের ছেনাছকরারা আর জন খাটতে চাইনি। সনার কাজে পালি যাইঠে বাইরে। এর উবরে আরো ব্যাপার আছে
— আবার কি বেপার আছে এর মধ্যে!
ততক্ষণে হাতা পেটা থামিয়ে কোমর ডুবা পচা জল থেকে পাড়ে উঠে আসে পেত্তোবা। অসুরের মতো খাটে সে সারাদিন। দোষের মধ্যে সকাল হলেই দেশি চুল্লু তার চাই। ঘরে মজুত রাখে সে। সকাল সন্ধ্যা দুবেলা নিয়ম করে খেতেই হয় তাকে। নইলে তার হাত থরথর করে কাঁপে। মদ খাওয়া মাত্রই কাঁপুনি থেমে যায়। পেত্তোবা ভাগচাষী। পলতাবেড়ার মন্ডলদের জমি ভাগে চাষ করে। আড়িপাড়া থেকে মাল খেয়ে এসে একদম কাজ করে সে। তারপর এক জামবাটি পান্তা নিয়ে বসে। ঢেকুর না উঠা পর্যন্ত পান্তা খায়। সকালের পর আবার পেত্তোবা ভাত খাবে সেই দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মাথায়। সাঁতরাদের চঁচি খুড়ার সাথে কথা চলার মাঝেই ঝড়ি পান্তাভত নিয়ে পুকুর ধারে হাজির। ঝড়ি পেত্তোবার বউ। ভিজা কাপড়েই পাড়ের বাজাঘাসের উপর বসে পড়ে পেত্তোবা। হাতের ইশারায় চঁচি খুড়াকেও বসতে বলে। করঞ্জ গাছের তলায় বৃষ্টি তেমর করে পড়ছে না বললেই চলে। চঁচি খুড়ার মাথায় কাঠের বাঁট লাগানো পেল্লাই একটা ছাতা। ঘাড় নেড়ে সে বলে উঠে
— না বোসবোনি। কি বোলবি বোলছিলু বল না? দাঁড়ি দাঁড়ি শুনেলুব। এখন হাটুর জোর ভালোই আছে।
— বোলবো আর কি খুড়া। ভাগারি দিয়াজি হিংসায় মরে গেল সব। মোদের পাড়ায় কি কেউ জন খাটতে যায় নি বল দিখি! কত ত যায়। মশাই মশাই করে কত্ত বোল্লম।কেউ নাইয়ের সই হ্যাঁ যেদি বোলত। অথচ দেখ। কৈবত্তদের ঘরে জিয়ে লটাচ্ছে। ক্যানেরে তোকে কি আমি টাকা দুব নি। না,কৈবত্তরা তোকে এগবারে সিলসিলা দিয়ে দেয়। সুদু কি না পেত্তবা বাগদি একাই খেটে এতকিছু করেঠে। দুটা বেটাকে পড়ায়ঠে। এতেই শালারা তেলেবেগুনে জ্বলে মরেঠে।
— তোদের পাড়ায কুনু লোক লাগেনি বলে কি গেরামে কেউ নাই! মাল পাড়ার যেতে পাত্তু ত।
—থাইলে আর বলিঠি কেনে! আজগে মোর পাট কাজতে লাগার কথা ছিল মালপাড়ার লোখার। একে ত আগাশ গুঁড়ি ঝাড়েঠে। তার উবরে দেখি অর এসার নাম নাই। গেলম মালপাড়া। দেখি না বাবু ছাতা মাথায বেরিচে কুথা যাবে বলে। জিগ্যাস করি,কিরে লোখো কুথা বেরিচু? মোর পাট কাচতে লাগবিনি? কি বল্লে জান, নাহ্ আজগে মোর হবেনি। খগেনকে ত চিন,তার একটা কাজে যাব একজাগা। কালকে লাগব খন। বুজ,ঠেলা।
— আর লোক পেলিনি! মালেদের লোখাকে লিউচু কাজে। উ ত লটম্বোরা ছেনা। কাজ করবে একদম আর হুপার লিবে চারদম। অর মুরাদে কিচ্ছু নাই। দু'দিনের ছেনা উ,মাঠেঘাটে কাজ করা কি চাট্টিখানি কথা। অদের কলম ঠিলা হাতে। উ হাতে কদাল,হাতা সহজে মানবেনি। কেনে যে উ জন খাটতে লেগেচে বুজতে পারিনি বাপু।
—- তা তুমি ঠিকই বলেচ। শুনি ত ঘরদোর ফেলি রেখে বাঁজা চচ্চা লিয়েই পড়ে থাকে বেশি। অর মাকে ত হামেশাই বোলতে শুনতম, বেটা মোর পর উবগারি/ পোথুক ভাতারি।
—কি আর করবি বল।নিজের কাজ নিজেকেই ত তোকে কত্তে হবে।
— তা কত্তে তো হবেই খুড়া। তাবাদে পাটের উবরে দাদন লিযে রেখেছি হারু সাঁতের কাছ থিকে। গরীবের আড়েও মরণ, তাড়েও মরণ খুড়া! কি আর করা যাবে!
🍂
খাল বিল মাঠ টুবটুব করছে জলে। শিলাইও ভরভরন্ত। আশ্বিন মাসের শেষেও বন্যা দেখেছে ঢোল। এই তো সবে ভাদ্রের মাঝামাঝি সময়। এখনো শিলাই ফুঁসফুঁসিযে ওঠেনি। তবে কদিন ধরেই নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। এই ঝমঝমিয়ে নামে তো, এই টিপটিপানি! রেডিওর খবরে বলছে বৃষ্টি পশ্চিমেও হচ্ছে, নদীর মুখে। জলাধার থেকে জল ছাড়তে পারে। তার মানে বন্যা নিশ্চিত। ঢোল কখনো বানবন্যাকে ডরায় না। বন্যা নিয়ে ৰোখার কোন ভাবনা নেই। পেত্তোবা যে তাকে আচালিপচালি করে গেল তাতেও তার কিছু এসে যায় না। আকাশ একটু বিশ্রাম নিতেই লোখা হাঁটা দেয় পিয়নের ঘরের দিকে। কুচকুচে কালো মেঘ যেন ঝুলে আছে মাথার উপর। গাছপালাদের বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কদিনের বৃষ্টিফোঁটার একটানা আঘাত সইতে হচ্ছে তাদের। ঘড়ের চাল থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে ছাঁচায়। এঁটেল মাটি জলে ভিজে চটচটে আঠালে কাদা হয়ে গিয়েছে। তার উপরে গরু বাছুরের খুরের পাউড়িতে ,হাঁস মুরগির গুয়ে,ছাগলের নাদিয়ে একেবারে একাকার অবস্থা। চারদিক জলে ডোবা। বাঁশবাগান গুলোতেও জল ছুঁইছুঁই অবস্থা। বাঁধের ধারে কলাবাগানে, বেনাঝোপের আড়াে মেইয়া মানুষের দল লাজলজ্জার মাথা খেয়ে হাগামুতা সারে। ছেলেরা নদীবাঁধের দিকে চলে যায়। কাচ্চাবাচ্াদের বেশি ঝামেলা কত্তে হয় না। ভিটার ধারে এক কোণে মায়েরাই বসিয়ে দেয়। দুধের শিশুদের গু খড়ের লুটি করে ভিটার পিছনে ডোবার দিকে ফিকে দেয়। বর্ষাকালে বাগ্দী পাড়ার ভিটাবাস্রতুতে সাবধানে চলতে হয়। জুতো পরে যাওয়া মুশকিল। পায়ের আঙুল চেপে চেপে হাঁটতে হয়। বেতাল হলেই চিৎপটাং। লোখা বেমালুম হেঁটে চলে যায়। সর্দাদের ভটার পরেই দলবেরা পাড়া। মেইয়া মদ্দরা বসে আছে মাটির ঘরের দুয়ারে। বর্ষাকাল এলেই লোকখার বাপ বলত,
— এই ত এবার এসে গেল ঠাঁইলাড়া কাল। যত বিষ্টি হবে তত ঘর- ওলতলে ঠাঁইলাড়া হব। খাও আর ঘুমাও নো চিন্তা ঢেঁড়স ভাতে।
কথাটা মনে পড়তেই লোখা মনে মনে হাসে। আর সর্দার পাড়ার লোকগুলাদের দিকে আড় চোখে তাকায়। তবে শুধু দলবেরা পাড়া নয়,হাজা এলাকার একই দশা। লোখা সামনে এগোতে থাকে। বেচো সর্দারের বউ ছেনা ভুলাতে টপকা কাটে, আয় ঘুম যাউ ঘুম বাগদি পাড়া দিয়/ বাগদিদের ছেনাগুলি পথে বসে কাঁদে/ আর কেঁদোনা,আর কেঁদোনা ছলা ভাজা দেব/ এবার যেদি কাঁদো বাছা তুলে আছাড় দুব। চারি বুড়ি দুয়ারে পাকা তাল ঝুড়ে। ঝড়া উপুর করে দিয়ে তার সাথায় নাতিকে বসি দিয়েছে। দেখতে পেয়ে লোখাকে ডাকে,
— অ লাতি কুথা যাওঠ? দইরকে এস না। এস,তালের গুলি খাবে নাকি? নাইলে এস তালমাড়ি দিয়ে মুড়ি খাবে?
— না ঠাগমা। পরে এগদিন এসব খন। মোদের পাড়গার দিকে যে বহুকাল যাওনি গো!
—- বেরষা কালে চলতে পারিঠিনি ভাই। লাউঠার পেটে পা-টার জোর পাইনি। ধরন দউ,যাব খন।
— আচ্ছা।
কথা আর বাড়াতে চায় না লোখা। মনের ভিতরে তার কতরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। মাধুর সতল মা ঘরে থাকবে কি না! বাপ যে থাকবে না লোখা তা আগে থেকেই নিশ্চিত। তার উপরে ওপারের বঙ্কা সাঁত জোঁকের মতো কামড়ে পগে থাকে ঘরে। সে এই সময় যদি থাকে! দিগার পাড়ার লোকেই বা কি ভাববে! হঠাৎ কেন এসেছে সে তাদের পাড়ায়! মাধু যদি কথা না বলে! কত সব চিন্তা তার হাঁটার গতিকে মাঝেমাঝেই থমকে দিচ্ছে। তবে যদি ভাবগতিক উল্টো দেখে তবে লোখা যে কথা ঘোরাবে,তা আগেই ভেবে রেখেছে। দিগার পাড়ার গোপী তাদের নামের দলের লোক। গোপী মৃদঙ্গ বাজাতে ওস্তাদ। কদিন ধরে সে আঘড়ায় যাইনি। তার খোঁজ নিতে এসেছে বলে,তার ঘরের দিকে সোজা হাঁটা দেবে। লোখা ধীরে হাঁটে আর সাতবার মা কালিকে ডাকতে থাকে।
— মা গো কোউ যেন না থাকে পিয়নের ঘরে। মাধু যেন একা থাকে। তুমি মুখ তুলে চাঅ, মা। তমার ডাইনে বাইনে চাঁদমালা, ভেটি দিয়ে পুজা দুব।
ভাবতে ভাবতে খেয়াল করেনি লোখা কখন পিয়নের ঘরের ওলোতলে এসে গেছে। কতদিন এসে নি লোখা মাধুদের ঘর। সেই কবে বন্ধু খগেনের পাল্লায় পড়ে মাধুদের ঘরকে এসেছিল। তখন ঘরটা এরকম গুছানাথাতানা ছিল না মোটেই। লোখা দেখে উঠানের সামনে পাকার বাঁধানো চাতাল। দুয়ারের চাল বাড়িয়ে করগেটের ছাউনি দেওয়া আছে তার উপরে। সেখানে বসে আছে মাধু। সতল মাও আছে তার পাশে। মাধুর মাথা থেকে নিখি টানছিল পিয়নের বউ। লোখাকে দেখতে পেয়েই চাল চিবানো সুরে বলে উঠে,
— বাব্বা, ঝোড়াবাদলার দিনে মাল পাড়ার লোককে যে দেকচি!
— কেনে ঝোড়াবাদায় মালপাড়ার লোক কি বেরায় নি!
— আসলে আমাদের পাড়ার দিকে খুব একটা আসতে দেখিনা ত। তা কাদের ঘর যাবে?
— তমাদের ঘরকেই এলম আর কি। কিরে মাধু কেমন আছু?
কিভাবে যে কথাগুলো মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল লোখা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু নিজেকে শক্ত রাখে। মনে মনে স্থির করে কথার টিপ হালকা করতে দেবে না সে। সরাসরি মাধুর দিকে তাকায়। মাধু তার স্বভাব বশে ছোট্ট একটি প্রত্যুত্তর লোখার কানে পৌঁছে দেয়।
—ভাল।
পরক্ষণেই পিয়নের বউ বলতে শুরু করে,
—-এসচ যখন দুয়ারে উঠে এসো। নাকি শুধু মাধুর-ই খোঁজ নিতে এসছ!
লোখার মুখ কুটকুট করছিল ঝেড়ে একটা উত্তর দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজেকে সামলে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়। বলে,
— না,গ,আমি যাচ্ছিলম গোপী ভাইপোর কাছে। কদিন আঘড়ায় যাইনি। অধিকারী বলেছিল এগবার খপর লিতে। তাই যাইঠি। মোদের পাড়ার দিকে যাবি রে মাধু,বেড়াতে। থাকবিনি ত বোধয বেশিদিন
— না না উ কি করে থাকবে। জামাই অকে ছাড়তেই চাইছিল না। ভাদ্র মাস বাপের ঘরে কদিন কাটাতে হয় তাই অর বাপ নিয়ে এল অকে কদিনের জন্নে। উ ত বাইরেই চলে যেত। কিন্তু ভগমানের কিপায় লাতি লাতনি পেটে এসচে বলেই থেকে যেতে হল।
0 Comments