জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৭/বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৭
বিজন সাহা 

ইয়ারোস্লাভলে একদিন   

আমরা ইয়ারোস্লাভলের দিকে যাচ্ছি আর মনে পড়ছে এর ইতিহাস। মাত্র মাস খানেক আগে ১৭ জুলাই ২০২১ আমরা এখানে এসেছিলাম এক এক্সারশনে। তখন গাইড শুনিয়েছিলেন ইয়ারোস্লাভলের ইতিহাস। গত পর্বে সে সম্পর্কে অনেকটাই বলেছিলাম। আমাদের ইয়ারোস্লাভল ট্রিপের গল্প বলার আগে সেটাই না হয় শেষ করা যাক। 

স্মুতা বা অরাজকতার সময় ইয়ারোস্লাভল কিছুদিন রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানীর দায়িত্ব পালন করে। রুশ দেশে রোমানভ ডাইনাস্টি ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে ইয়ারোস্লাভল বানিজ্য ও কুটির শিল্প কেন্দ্র হিসেবে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এটা তখন ছিল আয়তনের দিক থেকে রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আর বানিজ্যের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম। সে সময় এই শহরে রুশ দেশের সব চেয়ে প্রভাবশালী বনিকদের এক ষষ্ঠাংশ বসবাস করত। উত্তরে আরখানগেলস্ক থেকে দক্ষিণে বুখারা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের বাণিজ্য। এখানকার গুরিয়েভ বনিকরা বর্তমান কাজাখস্তানে গুরিয়েভ শহরের পত্তন করেন। এরাই ইয়ারোস্লাভলে রঝদেস্তভা খ্রিস্তভা গির্জা স্থাপন করেন যেখানে ইসলামী সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয়। সপ্তদশ শতকে ইয়ারোস্লাভল খ্যাতির শিখরে পৌঁছে। এই শতকে এখানে তিনটি মনাস্তির ও কম করে হলেও ৬০ টি পাথরের গির্জা তৈরি হয়। এসময়ই এখানে প্রতিষ্ঠা পায় ইয়ারোস্লাভল আর্ট স্কুল যা সেই সময়ের রুশ শিল্পের উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর। ইয়ারোস্লাভলের শিল্পীরা রুশ দেশের প্রধান প্রধান গির্জার যেমন ত্রইস্কি মনাস্তির থেকে মস্কো ক্রেমলিনের বিভিন্ন গির্জার দেয়াল ফ্রেস্কো দিয়ে অলঙ্কৃত করেন। ১৬৫৮ সালের অগ্নিকান্ড শহরের বিরাট অংশ ধ্বংস স্তূপে পরিণত করে। সেখানকার কাঠের স্থাপনা পুনর্নির্মাণ না করে দেয়াল উঁচু করা হয় আর খাঁদ করা হয় অনেক গভীর। কাঠের টাওয়ারের স্থান নেয় পাথরের টাওয়ার। ফলে ক্রেমলিন তার প্রতিরক্ষার ভূমিকা হারায়, ক্রেমলিন পরিণত হয় প্রাশাসনিক কেন্দ্রে। পিটার দ্য গ্রেটের রিফর্মের সময় ইয়ারোস্লাভল রাশিয়ার দ্বিতীয় শহরের মর্যাদা হারায়। তাছাড়া আরখানগালস্ক দিয়ে বানিজ্য চালানোর ব্যাপারে পিটারের অনিচ্ছার কারণে শহরের বানিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়, অনেক সওদাগর দেউলিয়া হয়ে যান। বানিজ্যের জায়গা নেয় শিল্প কারখানা। ১৭২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লিনেন কারখানা। ইয়ারোস্লাভলের লিনেন কারখানা রাশিয়ায় অন্যতম প্রথম ও বৃহৎ জয়েন্ট ভেঞ্চার। ১৭৭১ সালে এখানে ১১ টি বৃহৎ কারখানা ছিল। ১৭১৯ সালে এটা প্রভিন্সিয়াল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। সে সময় ইয়ারোস্লাভল উচ্চপদস্থ আমলাদের জন্য নির্বাসন কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। ১৭১৮ সালে এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা হয় যা ছিল শহরের প্রথম শিক্ষালয়। আরও ৩০ বছর পরে ইয়ারোস্লাভল আধ্যাত্মিক স্কুল কাজ শুরু করে। ১৭৫০ সালে তৈরি হয় পাবলিক থিয়েটার যা ১৭৫২ সালে পিটারবারগে স্থানান্তরিত হয়।  

নেপোলিয়নের সাথে যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহতদের ইয়ারোস্লাভলে আনা হয়, এখানেই সমাহিত করা হয় জেনারেল তুচকভকে। এই যুদ্ধের সময় সম্ভ্রান্ত মানুষদের মস্কো থেকে  ইয়ারোস্লাভল পালিয়ে যাওয়ার বর্ণনা আছে তালস্তোইয়ের “যুদ্ধ ও শান্তি” উপন্যাসে। ১৮১২ সালেই কতরসল নদীর উপর প্রথম সেতু নির্মিত হয়। ১৮৬০ সালে মস্কো ও ইয়ারওস্লাভলে মধ্যে টেলিগ্রাফ লাইন নির্মিত হয় আর ১৮৭০ সালে থেকে মস্কো, পিটারবারগ ও কস্ত্রোমার সাথে ইয়ারোস্লাভলের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯০০ সালের মধ্যে এখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, টেলিফোন, ইলেক্ট্রিসিটি, ট্রাম এসব কাজ করতে শুরু করে। এ সময় এখানে একের পর এক প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র। 
🍂
১৮৭১ সালে গঠিত হয় ইয়ারোস্লাভের শহর দুমা বা পার্লামেন্ট। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে এখানে বিভিন্ন ধরণের সোসাইটি গড়ে ওঠে যাদের মধ্যে কৃষিবিদ, চিকিৎসক, শিল্পী ও নাট্যকর্মীদের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮৬৫ সালে গঠিত হয় যাদুঘর যেখানে শহরের ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়। আর ১৯০১ সালে এখানে গঠিত হয় উত্তর রাশিয়ার প্রথম মার্ক্সিস্ট সংগঠন – উত্তর শ্রমিক ইউনিয়ন। বিংশ শতকের শুরুতে ইয়ারোস্লাভল ছিল রাশিয়ার বৃহৎ শহরগুলোর অন্যতম। শিল্পোন্নত এই শহরে ৫০ টির বেশি কারখানায় ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করত। টেক্সটাইল, কেমিক্যালস, তামাক ইত্যাদি শিল্পের বিকাশ ইয়ারোস্লাভলকে ভোলগা তীরের অন্যতম সুন্দর ও ফুলে ফুলে ভরা শহর হিসেবে গণ্য হতে কোন বাঁধার সৃষ্টি করেনি। স্থানীয় সাহিত্যে ইয়ারোস্লাভলকে “রুশ ফ্লোরেন্স” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাজধানী থেকে অনেকেই এখানে ভোলগার তীরে গ্রীষ্মকালীন বাড়ি তৈরি করতেন। তাদের কাছে এটা “রুশ সুইজারল্যান্ড” বলে পরিচিত ছিল। আলেক্সান্দর ডুমা, মারকিজ ডে কিউস্টিন সহ অনেক নামকরা ইউরোপিয়ান লেখক এই শহর ভ্রমণ করেন। ফ্রান্স কাফকার ডাইরিতে ১৯১৩ সালে রোমানভ ডাইনাস্টির ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে জার ফ্যামিলির ইয়ারোস্লাভল ভ্রমণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।     

সোভিয়েত রাশিয়ায় সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটে এখানে ১৯১৮ সালে যখন স্থানীয় জনগণ সোভিয়েত শাসনের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইয়ারোস্লাভল রেজিওন থেকে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ যুদ্ধে যায় যার মধ্যে প্রায় দুই লাখ হয় নিহত না হয় নিখোঁজ হয়। সোভিয়েত আমলে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও এবং প্রথম দিকে ইয়ারোস্লাভল অবহেলিত হলেও যুদ্ধের পর এখানে পুরানো কলকারখানা নতুন উদ্যমে কাজ করতে শুরু করে, তৈরি হয় নতুন কারখানা। ১৯৫৮ সালে ইয়ারোস্লাভল মোটর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান গাড়ির জ্বালানি সরবরাহকারী কারখানায় পরিণত হয়। একের পর এক তৈরি হয় অনেকগুলো রেল ও সড়ক সেতু। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি তৈরি হয় মেডিক্যাল কলেজ, কৃষি ইনস্টিটিউট, আর্মি একাডেমি ইত্যাদি। নতুন রাশিয়ায় প্রথম দিকের ধাক্কা কাটিয়ে ইয়ারোস্লাভলেও এখন চলছে নির্মাণ যজ্ঞ। 

আমরা এখন যাচ্ছি সেই ইয়ারোস্লাভলের দিকে। প্রথম এখানে এসেছিলাম ১৯৮৮ সালে ছাত্র অবস্থায়। সোভিয়েত আমলে আমাদের চলফেরা ছিল নিয়ন্ত্রিত, মানে যখন কোন এক্সারশনে যেতাম তখন মূলত এর দায়িত্বে থাকা শিক্ষক বা গাইডদের সাথেই যেতে হত। এর এদিক ওদিক হলে ওরা ভর্ৎসনা করত। তাছাড়া সে সময় আমরা জাহাজে ওঠার স্বপ্নে এতটাই বিভোর ছিলাম যে শহর নিয়ে তেমন আগ্রহ হয়তো ছিল না। অন্তত আমি সেই সময় ইয়ারোস্লাভলের কথা খুব একটা মনে করতে পারছি না যতটা পারছি উগলিচ বা তভেরের কথা। তাই ২০২১ সালে যখন সুযোগ এলো চলে গেলাম এক দিনের ট্রিপে। দুবনা থেকে ২৬৬ কিলোমিটার দূরবর্তী এই শহরে যেতে রাস্তায় বেশ সময় কাটাতে হয়। তবুও সিদ্ধান্ত নিলাম যাবার। কেননা শত হলেও নতুন শহর, অনেক ছবি তোলা যাবে। আবার যেহেতু  আগে গেছিলাম, তাই পরিবর্তনটাও চোখে দেখা যাবে। তাছাড়া আমার এক ক্লাসমেট আন্না ওখানে থাকে, মানে ও ঐ শহর থেকে। আজকাল কারও সাথে দেখা হয় না বললেই চলে। এই সুযোগে ওর সাথেও দেখা করা যাবে। তাই এক্সারশনের সবকিছু ফাইনাল হলে ওকে জানালাম। জুলাই মানে ছুটি। এখানে আসলে জুলাই আর আগস্ট ছুটি। ইউনিভার্সিটিতে। ও নিজেও শিক্ষক। তাই বলল ও এখন গ্রামের বাড়িতে, তবে অবশ্যই আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে। তবে এটাও ঠিক এক্সারশন মানেই দলের নিয়ম মেনে চলা, তাই আমরা চাইলেও অনেক সময় দিতে পারব না। ঠিক হল লাঞ্চের পরে যখন আমাদের আধা ঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিট সময় দেয়া হবে নিজেদের মত ঘোরাঘুরির জন্য তখন ওর সাথে দেখা করব। সেটাই করলাম শেষ পর্যন্ত। আমাদের ভ্রমণের প্রথম পর্বে ছিল শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্র। সেখানে সেখান থেকে এক এক করে কিরভ স্ট্রিট, কাজানস্কি মনাস্তির, প্রোফেট ইলিয়া গির্জা সহ বিভিন্ন গির্জা। সাড়ে দশটা থেকে প্রায় তিনটে পর্যন্ত এভাবে ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত খাবারের ডাক এল। খেয়ে দেয়ে যখন ভলগার তীরে বিভিন্ন দোকানপাট ঘুরে ঘুরে দেখছি আন্নার ফোন এলো। ভালোই কাটল কিছুটা সময়। গুলিয়ার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে ও চলে গেল আর আমরা গেলাম ইয়ারোস্লাভল আর্ট গ্যালারী ঘুরতে। সেই গ্যালারির বিস্তারিত বর্ণনা পরবর্তীতে পর্বে দেব।   

ছবিতে ইয়ারোস্লাভল
http://bijansaha.ru/album.php?tag=211

ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=lPq7CS6H7lk


 


Post a Comment

0 Comments