সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১০
গৌতম বাড়ই
দীপশিখা দিদিমণি ক্রমান্বয়ে রোগা আর দূর্বল হয়ে পড়ছিলেন শারীরিক ভাবে। শরীর যখন সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে, মানসিক দিকও ভেঙ্গে পড়ে আপনা- আপনি ভেতর থেকে। তিনি নিজেও বুঝেছিলেন কী? ভেতরে এক জটিল রোগ বাসা বেঁধেছে। আগে তিনি অতটা শ্লথ গতিতে হাঁটতেন না। এখন কেমন যেন ধীরপদে চলেন তিনি। স্কুল থেকে দলবেঁধে সব দিদিমণিরা নন্দনে গিয়েছিলেন একদিন, একটি বাংলা সিনেমা দেখতে। হইহই করে চলছে সে সিনেমা, সপ্তাহ কয়েক ধরে। পারিবারিক এক দাম্পত্য সম্পর্কের উপর সিনেমার গল্পটি। যেখানে বর্তমান সময়ের উপর দাঁড়িয়ে এক জটিল অথচ চিরকালের না বলা কথাটা বলা হয়েছে। যে দাম্পত্য জীবনের শেষভাগে এসে বিবাহবিচ্ছেদের মুখোমুখি। একদম সাদামাটা গল্প, তবে বাঙালি মননে আলোড়ন তুলেছে। তাই দর্শকদের আনুকূল্যে বছরের সুপার-ডুপার হিট। এখন কি এক বলে যেন, বক্স-অফিসে ফাটাফাটি রেসপন্স। সবার মনেই সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে বেশ ভালো লাগা এক রেশ মনের মধ্যে ছিল। অনেকক্ষণ ধরে সবাই হাসিঠাট্টা করছিল, কিন্তু তারা খেয়াল করছিল, অত হাসিখুশি দীপশিখা- দি আজ কেমন মনমরা হয়ে আছে! শুধু আজ নয় বেশ কিছুদিন ধরেই দীপশিখাদির শরীর এবং মনে আগের সেই ঔজ্জ্বল্য যেন হারাতে বসেছে। স্তিমিত হয়ে এসেছে দীপশিখার সেই আলোর তেজ। ইংরেজিতে লুমিনাস বলে যে শব্দটি আছে, তাই যেন হারাতে বসেছেন তিনি।
সবাই কলকাতার এই দক্ষিণ দিকেই থাকে। রবীন্দ্র সদন থেকে মেট্রো ধরে সবাই বাড়ি ফিরছিল। মেট্রোর ওজন মাপার মেশিনে সবাই মিলে ওজন করল। দীপশিখাদেবী প্রথমেই না, না, করে উঠেছিল আর বলল- " আমি যে হারে কমছি অবয়বে, আমাকে ওখানে আর চাপাস না। ওজন দেখলে , তোরাও না ভিরমি খাস!" দুজনকে বাদদিয়ে, বাদবাকি চারজন দিদিমণি মাঝবয়সী বা অবসরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে । সবার চেয়ে কম, মাত্র সাতচল্লিশ কেজি ওজন হল দীপশিখার। অথচ সাত- আট মাস আগেও ওজন ছিল তার পঁয়ষট্টি কেজি। ভিরমি খাওয়ার মতন ঘটনা বটে। রাজিয়া দিদিমণি বললেন, " দীপশিখা- দি বলব- বলব করেও যে কথাটি বলা হয়নি, আজকাল তোমার খুব চোখে পড়বার মতন চেহারা হয়েছে গো! এবারে একজন ভালো ডাক্তার দেখিয়ে নাও।"
চোখের দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে আরও । ছয়মাসে দু-দুবার চশমার লেন্সের পাওয়ার পাল্টেছেন তিনি। অনেক ছোটখাটো ভ্রম আজকাল করে ফেলে দীপশিখাদেবী। সেদিন সবার কথা শুনে আর থাকতে পারলেন না নিশ্চিন্ত হয়ে, কয়েকদিন পর সুশোভনবাবুকে বললেন, তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। একবার অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে তাকে। এই মুহূর্তে ভালো একজন ডাক্তার দেখিয়ে তার উপদেশ নেওয়া বড্ডো জরুরী। সুশোভনবাবু এতে প্রথমে অবাক হলেন কিছুটা। হাসনুকেও বললেন -" তোমার মাকে আমি যখন বলতাম, আজকাল আমার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ছে তোমার দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে, চলো ডাক্তার পাতিলের কাছে যাই গড়িয়াহাটে। আমায় কেমন ঝামটা মেরে বলে উঠত, তাকে নাকি জোর করে অসুস্থ বানাচ্ছি। বয়স হচ্ছে, স্বাস্থ্যহানি তো বয়সের ভারেই হয় ইত্যাদি। এখন নিশ্চয় স্কুলের সহকর্মীদের সবাই হয়ত এক কথা বলেছেন, তাই নিজের শরীরের আগাম অশনি সংকেত টের পেয়েছেন। হয়ত ডায়াবেটিস বা শক্ত কোনও অসুখের আশঙ্কা থেকেই ডাক্তার দেখানোর কথা বলছেন।"
হালে কলকাতার চিকিৎসক মহলে এম.ডি. পুরনভাই পাতিলের খুব নাম- ডাক হয়েছে। তার কাছেই একদিন টেলিফোনে এপয়েন্টমেন্ট করে দেখানো হল দীপশিখাকে।ডাক্তার বিভিন্ন রকমের ডায়াগোনিস্টিক টেস্ট করাতে বললেন, ভালো কোনও ল্যাব দেখে। দীপশিখার রক্ত সহ বিভিন্ন পরীক্ষা হল তারপর দিন। পরীক্ষার রিপোর্ট শারীরিক পরীক্ষার ঠিক পরদিন হাতে এল। রিপোর্ট ডাক্তারকে দেখানোর আগেই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞানে সেই রিপোর্ট দেখে, মায়ের শারীরিক অবনতির একটা প্রাথমিক ধারণা বসন্তসেনা আর তার বাবার মনে দৃঢ় হল। এর সাথে সাথে বসন্তসেনাদের পুরো বাড়িটাই যেন মনখারাপের কালো মেঘে ঢেকে গেল। মানুষের মনের সাথে, তার নিত্য বসবাসের ঘর আর তার ভেতরের নানান অনুষঙ্গেরও মনখারাপ হয়, বিরাট এক অদৃশ্য যোগ আছে যেন। ঘরের আসবাবপত্র আর নানান জড়বস্তুকে আমরা যেমন প্রাণময় করে তুলি, আবার তা প্রাণহীনও হয়ে পড়ে আমাদের চেতনায়।
সেই মনখারাপের রাতে বসন্তসেনার আজও মনে আছে, প্রায় অভুক্ত থেকে বাবা রাতে তার স্টাডি রুমে বসে গোটারাত কাটিয়ে দিয়েছিল। বসন্তসেনা মায়ের সাথে সে রাতে পাশে শুয়েছিল। মায়ের সাথে তার বকবকানি ঘন্টার পর ঘন্টা চলত, সেই রাতটুকু কেটেছিল নিদ্রাহীন এক দুঃস্বপ্নের মতন। তার মা দীপশিখার দুই চোখ জলে ভিজে আসছিল বারবার। বসন্তসেনা মায়ের গায়ে হাত বোলাতেই দীপশিখা দেবী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন বারবার। বলেছিলেন তিনি-" তোদের ছেড়ে যেতেই হবে আমায়, আর সেটাও খুব তাড়াতাড়ি, আমার মন বলছে হাসনু-মা!"
ডাক্তার পুরনভাই সব রিপোর্ট দেখে গালে হাত দিয়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর কথা বলেছিলেন খানিকটা হেসে- " মা, আপনি একদম দুশ্চিন্তা করবেন না। রিপোর্ট খারাপ এলেও তাতে কিছু যায় আসে না, আমরা ডাক্তাররা রয়েছি কী করতে? ঠিক সেরে উঠবেন মা।" বড় ডাক্তার হতে গেলে মানুষ হিসেবেও তাকে যে সুন্দর হতে হবে ব্যাবহারে আর তার আচরণে, কথা- বার্তায়, ডাক্তার পুরণভাইকে দেখলে সে কথাই মনে পড়ে যায় বারবার। ডাক্তার আবার নতুন করে আরও একটি টেস্ট করাতে বললেন, এন্ডোস্কোপি টেস্ট।
🍂
এরকম মেঘকালো বিষাদের সময়ে, বসন্তসেনা তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ। তার মা দীপশিখা একদিন নিজের ভেতরের কষ্ট লুকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন তার মেয়েকে - " হাসনু জানিস তো, আমাদের তোদের মতন এই বয়সে বিনোদনের জন্য একমাত্র সেরা জায়গা ছিল সিনেমা হাউসগুলো, যার অধিকাংশ আজ ভেঙে বড় বড় এপার্টমেন্ট বা শপিং মল হয়েছে, বা অন্য কিছু। আমরা কত কত ফিল্ম দেখেছি, অবাক হবি সাদাকালো ছবিও তখন বছরে এক- দুটো রিলিজ করত, তো সিনেমা দেখতে বসলে একটা সময় দশমিনিটের জন্য বিরতি বা ইন্টারভাল দেওয়া হত। আর ইন্টারভেলের পর সিনেমাটা যেন দ্রুত শেষ হয়ে যেত। কেন যে আমার আজকাল খালি মনে হয় আমার জীবনের ইন্টারভেল হয়ে গিয়েছে, এখন আমার দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার পালা!" বসন্তসেনা মায়ের দিকে পিঠ করে চেয়ারে বসে জেন অস্টিনের ' প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস' পড়ছিল একমনে, আর তার মাঝে মায়ের বলা কথায় মনোনিবেশ করেছিল, দ্রুত মায়ের দিকে ঘুরতে গিয়ে টেবিলের পায়ায় হাঁটুতে হোঁচট খেল। ব্যথাও সেই মুহূর্তে তুচ্ছ মনে হল। গলা যেন শুকিয়ে আসছে, তবুও বলল, " এরকম বলছ কেন মা? এতে আমাদের কষ্ট হয় না? জানো অনকোলজিস্ট ডক্টর তমাল রায় বলেছেন, তুমি সেরে উঠবে। আজকাল তো ক্যান্সার জয় করে অনেকেই ফিরছেন আবার সুস্থ জীবনে। ঠিক সময়ে ডিক্টেট করতে পারলে সেরে যাচ্ছে।কিওর হচ্ছে । মনে জোর রাখ মা। তোমায় আমরা কিছুতেই যেতে দেব না। সিনেমার উদাহরণে বাস্তব জীবন চলে না মা!আর তুমি হেসে হেসে এরকম ভাবে বিচ্ছেদের গভীর কথা বলছ?" এই বলে মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সাথে তার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল বসন্তসেনা। মা মেয়ে দুজনেরই তার আগে চোখ জলে ভিজে গিয়েছিল। বসন্তসেনা ঘুমের ঘোরে হারিয়ে গিয়েছিল কখন, তারপর দেখতে পেল তার মা দীপশিখা কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে , দুটো মুখ রদবদল হচ্ছে বারবার। তার শান্ত সুন্দর দুটি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ স্নিগ্ধ একদম সরল স্বাভাবিক জীবনের মা হঠাৎ করে যেন গা ভর্তি অলংকারে দামী রঙচঙে সিল্কের শাড়িতে কেমন যেন রাজমহিষী হয়ে উঠছেন, আবার মুহূর্তে বদলে গিয়ে তার নিজের মায়ের মুখ। আরে এ তো বঙ্গেশ্বরের স্ত্রী সুসীমার মা! বসন্তসেনার কল্পনার চোখে আঁকা, একদম অবিকল সেই বঙ্গরাণী- মাতা। ঘুম ভেঙে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মা এখন গভীর ঘুমে। মৃত মানুষ আর জীবিত মানুষের মধ্যে তো একটাই পার্থক্য, ঘুম ভাঙা আর না-ভাঙা ঘুম চিরটাকালের জন্য । তবে আমরা মৃত্যুকে আলাদা করি কেন? নিজেকে নিজেই একটা বোকা প্রশ্ন করে বসে এই শেষ বিকেলের আঁধারে।
ডাক্তার তমাল রায় যাই বলুন, দীপশিখা কিন্তু শারীরিক ভাবে ক্রমান্বয়ে যে খারাপের দিকে যাচ্ছেন, নিজেই টের পাচ্ছিলেন। আজকাল প্রতিদিন স্কুলেও যেতে পারেন না। তার পাওনা ছুটি প্রায় শূন্যের দিকে নেমে এসেছে। সুশোভনবাবু একদিন তার স্ত্রীকে বললেন, " দেখো দীপা এরকম কষ্ট করে তুমি আর কতকাল শিক্ষকতা করতে পারবে? খুব অসুবিধা হচ্ছে বুঝতেই পারছি তোমাকে দেখে, আমার তো এখনও চাকরি রয়েছে আরও কয়েকটি বছর। তুমি স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নাও। তোমার পেনশন আর আমার বেতন মিলিয়ে বেশ ভালোমতন চলে যাবে এখনকার মতন। তারপর তো হাসনু- মা বড় হয়ে উঠেছে। চিন্তা করো না। এতে তোমার শরীরটা বাঁচবে। আর পান্না তো রয়েছে সারাদিনের জন্য। আমরা সবাই মিলে এতে ভালো থাকব।"
দীপশিখা করুণ মুখে সুশোভনের দিকে চাইলেন। সেই দৃষ্টির কাছে সুশোভনের বুক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
ক্রমশ
0 Comments