জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৬ /বিজন সাহা

সাবর প্রিসভ্যাতই বগোরদিৎসি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৬
বিজন সাহা 

ইয়ারোস্লাভল 

ইয়ারোস্লাভল – রুশ দেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। একাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই শহরটি উন্নতির শিখরে পৌঁছে সপ্তদশ শতকে আর ২০১০ সালে সহস্র বছর পূর্তি উৎযাপন করে। ইয়ারোস্লাভলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সাধারণত মে মাসের শেষ শনিবার উৎযাপন করা হয়, তবে ২০১০ সালে সহস্র বছর উৎযাপন করা হয় ১০ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর। শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্র কতরসলি নদী যেখানে ভোলগায় মিলিত হয় সেখানে অবস্থিত। বর্তমানে তা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। এছাড়াও ইয়ারোস্লাভল রাশিয়ার বিখ্যাত গোল্ডেন রিঙের অন্তর্ভুক্ত। শুধু তাই নয়, ইয়ারোস্লাভল গোল্ডেন রিঙের সবচেয়ে বড় শহর। ছোট শহরগুলো কমপ্যাক্ট বিধায় ঘুরে দেখতে সুবিধা, কিন্তু এখানে সব দেখতে হলে অনেক জার্নি করতে হয় যা সময় সাপেক্ষ। 

এই শহরের সবচেয়ে প্রাচীন জনপদ ভোলগার বাম দিকে যেখানে কতরসলি নদী ভোলগায় মিলিত পড়েছে তার বিপরীতে পাওয়া গেছে। এই জনপদ খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ থেকে তিন হাজার বছর আগের ও নব্য প্রস্তর যুগের সাথে সম্পর্কিত। সাবেক মেদভেদিৎসে নদীর মোহনায় নব্য লৌহ যুগের যে জনপদ পাওয়া গেছে সেটা খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার বছরের। নবম শতকে এখানে স্কান্ডিনাভ ও স্লাভিয়ান জনপদ ছিল। খননকার্যে প্রাপ্ত সমাধি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। খননকার্যে এখানে স্কান্ডিনাভিয়ান অস্ত্র, রুনিক শিলালিপি, দাবার ঘুঁটি এবং আরব মুদ্রার বিশাল গুপ্তধন পাওয়া যায়। সবচেয়ে পুরানো মুদ্রা ছিল উত্তর আফ্রিকার ইদ্রিসিদ বংশের। এছাড়াও সেখানে স্কান্ডিনেভিয়ান ব্রোশ পাওয়া গেছে যা শুধু গহনাই হিসেবেই নয় সেফটিপিন হিসেবেও ব্যবহৃত হত। এসব থেকে ধারণা করা যায় যে প্রটো-ইয়ারোস্লাভল ছিল ভোলগার বানিজ্য পথে এক বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।         

  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীরদের সম্মানে মেমোরিয়াল

 দিনপঞ্জিতে প্রথম উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে ইয়ারোস্লাভল ভোলগা তীরে অবস্থিত শহরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ারোস্লাভ মুদ্রি। তিনি যখন রোস্তভ ভেলিকির শাসক (৯৮৮ – ১০১০) ছিলেন, তখন  কতরসলি নদীর মোহনায় অথবা মেদভেঝি উগল নামক মূর্তি পুজারীদের মহল্লায় এই শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভোলগা ও কতরসলি নদী এবং মেদভেৎস্কি গিরিখাত দ্বারা তিন দিক থেকে প্রাকৃতিক ভাবে শত্রুর হাত থেকে সংরক্ষিত এই স্থানে তৈরি হয় ইয়ারোস্লাভল ক্রেমলিন। বর্তমানে সেখানে একটা পাথরে খোদাই করে লেখা আছে “এই স্থানে ১০১০ সালে ইয়ারোস্লাভ মুদ্রি ইয়ারোস্লাভল প্রতিষ্ঠা করেন।” এই শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৭১ সালে দুর্ভিক্ষের ফলে ভলখভ বিদ্রোহের সময়। আর শহরের নাম ইয়ারোস্লাভল এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়ারোস্লাভ মুদ্রির নামানুসারে করা হয়েছে বলেই বিশ্বাস করা হয়। শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে খননকার্যে প্রাপ্ত দুর্গের ধ্বংসাবশেষ একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের। আর দ্বাদশ শতকেই এখানে পেত্রপাভলভস্কি ও স্পাসস্কি মনাস্তির গড়ে উঠেছিল। তবে সেসময় এসব মনাস্তির ছিল শহরের বাইরে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথম দুই শ' বছর ইয়ারস্লাভল ছিল রোস্তভ-সুজদাল রাজ্যের এক সীমান্ত শহর মাত্র।   

ইয়ারোস্লাভলে প্রথম পাথরের স্থাপনা তৈরি হয় ১২১০ সালে তাতার-মঙ্গোলদের আক্রমণের কিছু আগে। আর সেটা হয় ভসেভোলোদ বলশই গ্নেজদোর জ্যেষ্ঠ পুত্র কনস্তান্তিনের ইচ্ছায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভসেভোলোদ বলশই গ্নেজদো ১১৭৬ সাল থেকে ছিলেন ভ্লাদিমিরের গ্র্যান্ড ডিউক। এর আগে তিনি ৩৫ দিন কিয়েভের যুবরাজ ছিলেন। তিনিই প্রথম উত্তরপূর্ব রুশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। রোস্তভ ভেলিকির চেয়ে ভোলগা তীরের শহর ইয়ারোস্লাভলে অনেক বেশি পাথরের তৈরি গির্জা ছিল, তাই একে যুবরাজ কনস্তানতিনের রাজধানী বললে ভুল হবে না। এমনও হতে পারে যে স্পাস্কি মনাস্তিরের বইয়ের সংগ্রহ শুরু করেন যুবরাজ কনস্তান্তিন। এই গ্রন্থাগারে ছিল ১৪ টি পার্চমেন্ট বই  আর ছিল বিখ্যাত «স্লভা ও পোল্কে ইগোরভে» বা ইগরভ রেজিমেন্টের কাহিনী বইয়ের একমাত্র সংস্করণ। এখানে সাহিত্য শুধু পুনর্লিখন করাই হত না, ইলাস্ট্রেশনও করা হত। এর প্রমাণ স্পাস্কি ও ফেওদরভস্কি গসপেল। এছাড়া কনস্তান্তিনের সময়ই এখানে বড় সাইজের শিল্পকলার কাজ শুরু হয় যার প্রমাণ তলগস্কই গড মাদারের আইকন। ১২১৮ সালে কনস্তান্তিনের মৃত্যুর পর ইয়ারোস্লাভল তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ভসেভোলোদের রাজধানীতে পরিণত হয়। তিনি তাতার-মঙ্গোলদের সাথে সিতিসের যুদ্ধে নিহত হন। ১২৩৮ সালে মঙ্গোলদের আক্রমণে শহরে ধ্বংস যজ্ঞের নিদর্শন হিসেবে পাওয়া গেছে সহিংসতায় মৃত মানুষের হাড় দ্বারা পরিপূর্ণ বেসমেন্ট। পরে স্থানীয় জনগণ ১২৫৭ সালের ঐতিহাসিক যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে তাদের স্মরণে যুদ্ধক্ষেত্রে স্মারক ক্রেস্ট স্থাপন করে। তাতার-মঙ্গোলদের কাছে পরাধীনতার প্রথম দিক থেকে যুবরাজ ভাসিলি গ্রজনিয়ে অচি বা রক্তচক্ষু ভাসিলির শাসনকাল পর্যন্ত ইয়ারোস্লাভল ক্রমাগত শক্তিশালী হতে থাকে। বিশেষ করে আপার ভোলগায় তার আধিপত্য বিস্তারিত হয়। আর সেটা উন্নতির শিখরে পৌঁছে স্মলেনস্ক ডাইনাস্টির প্রতিনিধি ফিওদর চিয়রনির রাজত্বকালে। সোনালি হোর্ডের খানের মেয়ের জামাই, ইয়ারোস্লাভলের গ্র্যান্ড ডিউক ফিওদর সেই সময়ের রুশ রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সময় ইয়ারোস্লাভল বানিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়, ভোলগার অন্য তীরে প্রতিষ্ঠিত হয় তলগস্কি মনাস্তির। চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইয়ারোস্লাভল রাজ্য ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে, ফলে স্থানীয় রাজন্যবর্গ রাশিয়ার রাজনীতিতে বলতে গেলে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেনি, শহরের একাংশ মস্কোর অধীনে চলে যায়। ১৩৮০ সালে ইয়ারোস্লাভলের সেনারা কুলিকভ যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৪৬৩ সালে ইয়ারোস্লাভল সম্পূর্ণ মস্কোর অধীনে চলে আসে। তৃতীয় ইভানের শাসনামলে কনস্তান্তিন ভসেভোলোদোভিচের সময়ে প্রতিষ্ঠিত গির্জাগুলো অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। মস্কো ও ইতালীর স্থপতিদের দ্বারা সেখানে তৈরি হয় নতুন গির্জাসমূহ। ১৫৩৬ সালে অগ্নিকান্ডের পর সেখানে কতগুলো টাউয়ার ও মাটির বাঁধ তৈরি করা হয়। সে সময় ক্রেম্লিনের চারিদিকে কাঠের প্রাচীরও তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে মস্কোর এক কোম্পানি আরখানগেলস্কের মাধ্যমে রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে বানিজ্য শুরু করলে ইয়ারোস্লাভল ভোলগা পথে এক গুরুত্বপূর্ণ ট্র্যানজিটে পরিণত হয়। 

🍂

১৫৬৫ সালে জার ইভান গ্রোজনি রুশ রাষ্ট্রকে অপ্রচিনা ও জেমশিনা এই দুই প্রশাসনিক ভাগে বিভক্ত করেন। ইয়ারোস্লাভল ১৫৬৯ সাল পর্যন্ত জেমশিনায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পরে অপ্রচিনায় স্থান পায়। ১৫৭০ সালে নভগোরাদে অপ্রচিনপন্থী রক্ষীরা গণহত্যা সংগঠিত করলে শহরের অনেক সমৃদ্ধশালী পরিবার ইয়ারোস্লাভলে আশ্রয় নেয়। এভাবে ভোলগা তীরে নভগোরাদের অনেক রীতিনীতি শেকড় গাঁথতে শুরু করে। স্মুতা বা অরাজকতার সময়ে ইয়ারোস্লাভল প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৬০৮ সালে দ্বিতীয় লঝেদ্মিত্রি বা নকল দ্মিত্রির সেনারা ইয়ারোস্লাভল দখল করে। লঝেদ্মিত্রি ছিল প্রতারক যে নিজেকে ইভান গ্রোজনির ছেলে উগলিচের দ্মিত্রি হিসেবে পরিচয় দেয় এই বলে যে সে আসলে মারা যায়নি, অলৌকিক ভাবে বেঁচে উঠেছে। ১৬০৯ সালে ভোলগদার মিলিশিয়াদের হাতে এই প্রতারক দল পরাজিত হয়ে শহর ত্যাগ করে, কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে নতুন সেনা সংগ্রহ করে লঝেদ্মিত্রি ইয়ারোস্লাভল অবরোধ করে, তবে কয়েক মাস পরে অবরোধ উঠিয়ে নেয়া হয়। ১৬১১ সালে ইয়ারোস্লাভলের মিলিশিয়ারা মস্কো মুক্ত করতে অগ্রসর হয়, কিন্তু লক্ষ্য অর্জিত হয় না। ১৬১২ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এখানে দ্বিতীয় মিলিশিয়া অবস্থান নেয়। সে সময় ইয়ারোস্লাভল মস্কো রাজ্যের রাজধানীর ভূমিকা পালন করে আর এখানে সাময়িক ভাবে টাঁকশাল কাজ করতে থাকে। যখন নতুন নতুন দল মিলিশিয়ায় যোগ দিতে শুরু করে তখন তারা আবার মস্কোর দিকে অগ্রসর হয়। কস্ট্রমা থেকে আহুত তরুণ ভবিষ্যৎ জার মিখাইল ফিওদরোভিচ সে সময় দীর্ঘদিন ইয়ারোস্লাভলে অবস্থান করেন। এখানেই তিনি রুশ সাম্রাজ্যের জার হবার সম্মতি পত্রে স্বাক্ষর করেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে ইয়ারোস্লাভলে কাজানস্কি মনাস্তির স্থাপন করা হয়। আর যুদ্ধবন্দীদের ভোলগা তীরে নির্বাসন দেয়া হয়।

 কতরসলি নদী যেখানে ভোলগায় মিশে গেছে

ইয়ারোস্লাভলের হারানো ইতিহাসের কথা ভাবতে ভাবতে আমরা এগিয়ে চলছিলাম সেই শহরের দিকে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা গাড়ির কাঁচের উপর পড়ে এদিক সেদিক চলে যাচ্ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সকালে উগলিচে ঘুরে লাঞ্চ করে ইয়ারোস্লাভল যাব। সেখানে বিকালে ঘোরাফেরা করে রাত কাটাব ইয়ারোস্লাভলেই। আর পরের দিন সকালে আবার রাস্তায় নামব, কস্তরোমা আর পেলস ঘুরে নিঝনি নভগোরাদ যাব। কিন্তু বৃষ্টি ইতিমধ্যে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনল। উগলিচ আর ঘুরে দেখা হল না। পারব কি ইয়ারোস্লাভল দেখতে? নাকি বৃষ্টি সেটাও করতে দেবে না?  

ছবিতে ইয়ারোস্লাভল
http://bijansaha.ru/album.php?tag=211

ভিডিও

https://www.youtube.com/watch?v=lPq7CS6H7lk 


Post a Comment

0 Comments