শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৯ / সালেহা খাতুন
আঘাত পেলে উন্নত মনও ভেঙে যায়। মন আমার ভেঙে গেল। কে ভাঙল? উত্তরটা হলো: উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট। রেজাল্ট যাই হোক পড়াশোনায় কোনো কমতি ছিল না।
উলুবেড়িয়া কলেজে বাংলা পড়িয়েছেন ছন্দা ম্যাডাম, অলোকবাবু, দীপকবাবু এবং সুহৃদবাবু। সুহৃদবাবু অর্থাৎ ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিক মহাশয়। স্যার যে কত বড়ো মাপের পণ্ডিত মানুষ সে বয়সে বোঝার ক্ষমতা এবং বোধ কোনোটাই হয়তো ছিল না। স্যার যে কত কত বই লিখেছেন, কত ভাষা জানেন, কত গুণী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন এসব জানার সুযোগও তখন সহজ ছিল না। কিন্তু এখন গর্ব হয় এই ভেবে যে এমন একজন মানুষকে নিত্যদিন ক্লাসে পেয়েছি। চর্যাপদ পড়াতেন আমাদের। ইলেভেন টুয়েলভের সেই পড়া এখনও হৃদয়ে গেঁথে আছে। বিরাট হল ঘর ভর্তি সায়েন্সের স্টুডেন্টদের তিনি বাংলা পড়াচ্ছেন। চোখ মাটির দিকে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আই কনট্যাক্ট করতেন না। অথচ পুরো ক্লাস নিজের কন্ট্রোলে। কোনো শব্দ নেই। শুধু স্যারের গলা শোনা যাচ্ছে। এরপর স্যার যা বোঝাচ্ছেন তা আমাদের নিজেদের লিখে স্যারকে দেখাতে হতো। আমার ছোটো একটা খাতা ছিল। উপরে নন্দিতা লেখা। খুবই দুর্বল খাতা। তাতে চর্যাপদ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাবলী লিখে স্যারকে জমা দিলাম। স্যার সুন্দর করে যত্ন করে দেখে দিয়েছিলেন সঙ্গে বেশ কিছু পয়েন্ট যোগ করে। এখন নবনির্মাণে চর্যাপদ সংক্রান্ত কত যে তথ্য শিক্ষার্থীদের বলি তার ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল সুহৃদবাবুর হাতে। তেমন ভাবে স্যারের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়নি হয়তো তিনিও আমাকে চেনেন না। কিন্তু তাঁর হাজার হাজার ছাত্রীর মধ্যে আমিও যে একজন এটা আমাকে তৃপ্তি দেয়।
🍂
দীপকবাবু পড়াতেন “পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন”। অধ্যাপক দীপক কুমার দে মহাশয় ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। নিজের গাত্রবর্ণ নিয়ে গর্ব করতেন। আমরা যারা শ্যামলা বা তামাটে বর্ণের অধিকারী তাদের নিজের দলে টেনে বলতেন “আমরা হচ্ছি ডীপ আর ফর্সারা ফ্যাকাশে”। তিনিও বেশ যত্ন নিতেন। বন্ধুরা কেউ কেউ স্যারের বাড়িতেও পড়তে যেতো।
অলোকবাবু অর্থাৎ অলোক বন্দ্যোপাধ্যয় ছিলেন বিখ্যাত আবৃত্তিকার ঘোষক সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যয়ের ভ্রাতা। তিনি পড়াতেন বঙ্কিমচন্দ্রের “বাবু” প্রবন্ধটি। তিনি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম ছিলেন। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে তিনি চলে যেতেন চলচ্চিত্র জগতে। বলতেন “ দো অর দো পাঁচ” কীভাবে হয় তোমরা বুঝিয়ে দাও। স্যারের সঙ্গে কোনো কোনো সময় একই ট্রেনে যাওয়া আসার পথে সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপ হতো। স্যার এবং ছন্দা দি একই রিকশায় ফুলেশ্বর স্টেশনে যেতেন। শুনেছিলাম তাঁরা স্বামীস্ত্রী। অলোকবাবু বলেছিলেন “কাপুরুষেরা বার বার মরে। বীর একবারই মৃত্যুবরণ করে।“ হাসতে হাসতে নিজের উদাহরণ দিয়েছিলেন। আসলে স্যার দিনে পঁচিশ কাপ চা খেতেন। সবাই সাবধান করে বলতেন এতো চা খেলে সমস্যা হবে। তাই তাঁদের ঐ কথা বলতেন। ক্লাসের ফাঁকে টুকরো গল্প করে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণে শিক্ষকদের কত কৌশলই অবলম্বন করতে হয় এখন বুঝি সেকথা।
ছন্দাদি পড়াতেন “ রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা”। বাস্তব জগতের উপমা দিয়ে বোঝাতেন। ছেলেদের বলতেন সাইকেল নিয়ে গার্লস হোস্টেল বা স্কুলের সামনে দাঁড়ালে হবে না। এখনকার রাধাদের মন জয় করতে হলে মারুতি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। সেটা অর্জন করতে গেলে এখন পড়াশোনাটা ভালো করে করতে হবে। কলেজের মাঝখানের ঐ পুকুর পাড় দিয়ে ছোটোখাটো মিষ্টি চেহারার মিষ্টি ম্যাডামের হেঁটে ক্লাসে আসা এখনো যেন চোখ মেললেই দেখতে পাই।
ইংরেজি পড়াতেন আক্রামবাবু, বিমানবাবু প্রমুখ। আমি যখন পিএইচ ডি করছি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার পিএইচ ডি গাইড অধ্যাপক ড . লায়েক আলি খান অধ্যাপক ড . আক্রাম হোসেনের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে হতবাক হয়ে যান যে আক্রামবাবুকে আমি চিনি এবং উলুবেড়িয়া কলেজে তাঁর সরাসরি ক্লাসরুমের ছাত্রী। আক্রামবাবু সেই সময় আমার বেশ কিছু আত্মীয়স্বজনের কথা বলেন যাঁদের তিনি জানেন। এখন লাইব্রেরিতে স্যারের অজস্র বইপত্র দেখি আর ভাবি কই তখন তো এতো কিছু জানতাম না। জেরোম কে জেরোম এর “প্যাকিং” এবং ও হেনরির “ গিফ্ট অব দি ম্যাজাই” পড়াতেন তিনি। আসলে শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীদের ঋণের শেষ নেই। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষে কী বিরাট কৃতজ্ঞতা পাশে তাঁরা আজীবন আমাদের বেঁধে রেখেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
0 Comments