জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৮
মকুন্দরামকে নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের মন্তব্য ও বলরাম কবিকঙ্কন
সূর্যকান্ত মাহাতো
দীনেশচন্দ্র সেন 'কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম' ও 'ভারতচন্দ্র'-কে সরাসরি 'কুম্ভীলক' বলে অভিযোগ করেছেন। অর্থাৎ তারা নাকি অন্যের লেখা নকল বা চুরি করেছেন। দিনেশবাবুর স্তম্ভিত করে দেওয়া বক্তব্য হল, "কবিকঙ্কন, ভারতচন্দ্র প্রভৃতি লেখক নানা স্থান হইতে আহৃত রত্নের উৎকৃষ্ট সমন্বয় করিয়াছেন, পৃথিবী ক্ষমতার পূজক --- এজন্য ইহারা অপহরণ করিয়াও লোক পূজার পুষ্প চন্দন পাইতেছেন। কিন্তু যাহারা চুরি করিয়া ঢাকিতে পারে না--- যাহাদের কুৎসিত সমন্বয়ে পল্লবের সঙ্গে শাখার, ত্বকের সঙ্গে অস্থির মিল পড়ে না, সেই দুর্ভাগ্যগনের জন্যই লোকনিগ্রহের নিষ্ঠুর শাসনের ব্যবস্থা।" (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য/ দিনেশচন্দ্র সেন, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৩৮৯)
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আলোক সামান্য কবি ও প্রতিভাগুনে শ্রেষ্ঠ কবি হলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মেদিনীপুর জেলার গর্ব তিনি। জঙ্গলমহলের চুয়াড়রাও তার লেখায় উঠে এসেছিল। গোটা বঙ্গবাসীর কাছে শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত এমন মানুষটাকে নিয়ে হঠাৎ দীনেশচন্দ্র সেন এত বড় মন্তব্য করলেন কেন? 'অপহরণ' বা 'চুরি' শব্দটার মতো কঠিন শব্দই বা তিনি ব্যবহার করেছিলেন কেন? চন্ডীমঙ্গলের এমন প্রথিতযশা কবিকে দীনেশচন্দ্র সেন কেনই বা অপহরণের দোষে দুষ্ট করেতে গেলেন? এর যথাযথ উত্তর দীনেশচন্দ্র সেন অবশ্য নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
"মাধবাচার্য প্রভৃতি পূর্ববর্তী চন্ডী লেখকগণের নিকট মুকুন্দরাম নানা বিষয়ে ঋণী। মূল বিষয়ের ত কথাই নাই--- সমস্তই এক কথা; তাহা ছাড়া পঙক্তিগুলি পর্যন্ত অপহৃত হতে দেখা যায়।"(বঙ্গভাষা ও সাহিত্য/ দীনেশ চন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা- ৩৮৯)
এতবড় কথা তো আর মনগড়া নয়। প্রমান পেয়েছেন বলেই না এতবড় কথা লিখতে পেরেছেন। দীনেশবাবু মাধবাচার্যের চন্ডী এবং মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল দুটোই বেশ ভালোভাবে অধ্যয়ন করে দেখেছেন। তারপরেই তিনি আরো জোরের সঙ্গে বলেছেন, "উভয় চন্ডীতে অনেক ছত্র পাওয়া যায়, যাহা ঠিক একরূপ, হয়ত মুকুন্দরাম সেগুলি মাধবের চন্ডী হইতে সংগ্ৰহ করিয়াছেন, নতুবা উভয় কবিই কোন লুপ্ত কবির ভূপ্রোথিত ধনাগার লুন্ঠন করিয়া লইয়াছেন।"(বঙ্গভাষা ও সাহিত্য/দীনেশচন্দ্র সেন, পৃষ্ঠা- ৩৯৪)
প্রভাবিত হওয়া আর নকল করা যে এক নয়, সেটা যে দীনেশবাবু জানেন না এমনটা তো নয়। তিনি নিশ্চয়ই এ কথাগুলো শিশুসুলভ ভাবে বলেননি। কিংবা আত্মপ্রচার লাভের জন্যও বলেননি। 'ধনাগার লুণ্ঠন' করার মতো কঠিন শব্দ ব্যবহারও তিনি বেশ সচেতনতার সঙ্গেই করেছেন। আর এটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি করেননি। যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েই তিনি একথা বলেছেন। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল, দীনেশচন্দ্র সেনের এমন বক্তব্যের আজ পর্যন্ত কেউ বিরোধিতা করেছেন বলে মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতারাও এ বিষয়ে কোন কথা লেখেননি। এমনকি মুকুন্দরাম বা ভারতচন্দ্রের 'কুম্ভিলক' প্রসঙ্গ নিয়েও তারা এতকটু কালি খরচ করেননি।
কিন্তু 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থের লেখক 'যোগেশচন্দ্র বসু' মুকুন্দরাম যে মাধবাচার্যের থেকে তথ্য অপহরণ বা নকল করেছেন বলে দীনেশবাবু উল্লেখ করেছেন সেই যুক্তি তিনি মেনে নিতে পারেননি। তার না মানার পিছনে তিনি দুটি যুক্তিও দিয়েছেন। প্রথমত, দুই কবির কাব্যের 'রচনাকালের ব্যবধান। রচনাকাল যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে মুকুন্দরাম, মাধবাচার্যের দুই বছর আগেই তার কাব্য রচনায় হাত দিয়েছিলেন। এবং এ কথার প্রমাণ স্বরূপ তিনি দুই কবির কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে দুটি করে ছত্রের উল্লেখ করেছেন। মাধাবাচার্যের রচনাকাল সম্পর্কে যে ছত্র দুটি পাওয়া যায় তা হল---
"ইন্দু বিন্দু বান ধাতা শক নিয়োজিত
দ্বিজ মাধবে গায়ে সারদা রচিত।"
অর্থাৎ এ লাইন দুটি থেকে জানা যায় যে, মাধবাচার্য ১৫০১ শকে বা ১৫৭৯ খ্রিস্ট অব্দে মাধবাবাচার্য তার গ্রন্থ রচনা প্রণয়ন করেন। অন্যদিকে মুকুন্দরামের কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কিত লাইন দুটি হল---
শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গনিতা
সেইকালে দিলা গীত হরের বনিতা।।"
অর্থাৎ ১৪৯৯ শক বা ১৫৭৭ খ্রিস্ট অব্দে কবি তার গ্রন্থ রচনার নির্দেশ পেয়েছিলেন। যোগেশচন্দ্র বসুর মতে মুকুন্দরামের গ্রন্থটি রচনা করতে দশ থেকে এগারো বছর লেগেছিল। এবং মাধবাচার্যের লেখার সাত থেকে আট বছর পর তার লেখা শেষ হয়েছিল। (মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৬১৯) তাহলে দেখা যাচ্ছে, মুকুন্দরাম তার গ্রন্থটি মাধাবাচার্যের দু'বছর আগে শুরু করলেও শেষ করেছিলেন মাধবাচার্যের অনেক পরে। সুতরাং মুকুন্দরাম যদিও বা মাধাবাচার্যের চণ্ডী থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকেন, তবে সেটা এই সাত আট বছরের মধ্যেই হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয় সে কথাই মনে করেন যোগেশবাবু। কারণ এই সাত আট বছরের মধ্যে মাধবাচার্যের কাব্যখানি নকলের পর নকল হয়ে গ্রামের পর গ্রাম পার হয়ে সুদূর ময়মনসিংহ জেলার 'নবীনপুর পল্লী' থেকে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার 'আড়রা' গ্রামে পৌঁছানো কোনমতেই সম্ভব নয়। (মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৬১৯)
তাই যোগেশচন্দ্র মহাশয় দীনেশচন্দ্র সেনের দ্বিতীয় যুক্তিটিকেই বরং বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাৎ মুকুন্দরাম ও মাধবাচার্য দুজনেই হয়তো 'কোন লুপ্ত কবির ভূপ্রোথিত ধনাগার লুণ্ঠন করেছিলেন'। যোগেশবাবু ওই 'লুপ্ত কবি' হিসেবে একজনকে অনুমানও করেছেন। তিনি হলেন 'বলরাম কবিকঙ্কন'। 'বলরাম কবিকঙ্কন' যে সেই 'লুপ্ত কবি' হতে পারেন তার একটা প্রবল সম্ভবনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। (মেদিনীপুরের ইতিহাস/যোগেশচন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৬১৯) কিন্তু দুঃখের বিষয় বলরামের লেখা গ্রন্থ অপ্রতুলতার কারণে দীনেশচন্দ্র সেন বা যোগেশচন্দ্র বসু কেউই সেটা পড়ে দেখেননি। না হলে মুকুন্দরাম, মাধবাচার্য ও বলরাম এই তিনজনের গ্রন্থ পাশাপাশি রেখে বিচার করলেই যে দুধ কা দুধ আর পানি কা পানি স্পষ্ট হয়ে যেত তা যোগেশবাবুও স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেটা সম্ভব হয়নি বলরামের গ্রন্থটি না-মেলার কারণে।
এখন প্রশ্ন হল কে এই 'বলরাম কবিকঙ্কন'? তাকেই কেন যোগেশবাবু ওই লুপ্ত কবি বলে অনুমান করেছেন? তিনি কত বড় কবি ছিলেন যে তাকে অনুকরণ করতে হয়েছিল স্বয়ং মুকুন্দরামকে?
'বলরাম কবিকঙ্কন' এর প্রথম পরিচয় তুলে ধরেন 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা'। এক কথায় এই পত্রিকাই তাকে আবিষ্কার করেছে বলা যেতে পারে। কারণ এর আগে 'বলরাম কবিকঙ্কন' এর কথা আর কেউ সেভাবে লিখেছিলেন বলে মনে হয় না। আর সেটাও আবার সম্ভব হয়েছিল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কারণে। কারণ উনার উৎসাহ ছাড়া 'বলরাম কবিকঙ্কন' একপ্রকার পর্দার আড়ালেই থেকে যেতেন। এ বিষয়ে রামেন্দ্রসুন্দর মহাশয়ের কী ভূমিকা ছিল? আসলে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কাছে হাতে লেখা একখানি প্রাচীন 'শ্রীমদ্ভাগবত' গ্রন্থের শেষ পাতায় কয়েকটি 'ছত্র' ছিল। যার মধ্যে একটি অন্যতম 'ছত্র' হল, "শ্রীলশ্রীকবিকঙ্কনাত্মজসুত: পঞ্চাননাধ্যস্তৎসুতো"।
ত্রিবেদী মহাশয় ঐ শ্লোক সম্বন্ধে তার চারটি জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা' দপ্তরে। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্নটি ছিল,"শ্লোকক্ত কবিকঙ্কন আর চন্ডী প্রণেতা কবিকঙ্কন এক ব্যক্তি কিনা? প্রমাণের উপায় আছে কিনা?" (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩০২, শ্রাবণ সংখ্যা) পত্রিকার পক্ষ থেকে ত্রিবেদী মহাশয়ের প্রশ্নাবলী ধরে ধরে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন 'শ্রীমহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি'। ত্রিবেদী মহাশযয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি 'বলরাম কবিকঙ্কন' এর নাম তুলে আনেন। 'বলরাম কবিকঙ্কন' সম্পর্কে তিনি যেটুকু তথ্য দিয়েছেন তা হল,"কবিকঙ্কন উপাধিযুক্ত দ্বিতীয় ব্যক্তি বঙ্গ দেশে বর্তমান ছিলেন। তাহার পূর্ণ নাম 'বলরাম কবিকঙ্কন'। সেই কবি মেদিনীপুর নিবাসী। তাহার কৃত এক চন্ডী আছে।"(সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, শ্রাবণ সংখ্যা, ১৩০২) 'মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি' মহাশয় 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা'-র সম্পাদক মহাশয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে পেরেছিলেন 'বলরাম' কৃত চন্ডীমঙ্গলের একখানি 'চন্ডী'-র প্রতিলিপি শ্রীযুক্তবাবু ঈশানচন্দ্র বসু নামের এক ব্যক্তির কাছে আছে। সেটা তিনি দেখতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ গ্রন্থের প্রতিলিপি সেখানে ছিল না। কাব্যের 'দক্ষযজ্ঞ' পর্যন্ত প্রতিলিপি ছিল। কেবলমাত্র কয়েক পৃষ্ঠার পরিমিত প্রতিলিপি। ডিমাই কাগজের খাতার ২৬ পৃষ্ঠা জুড়ে অধিকৃত ছিল। (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩০২, শ্রাবণ সংখ্যা)
যাইহোক এখন প্রশ্ন হল, 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থ প্রণেতা যোগেশচন্দ্র বসুর তাহলে কেন মনে হয়েছিল যে মুকুন্দরামই বলরামের অনুকারী? যোগেশবাবু তার কারণ হিসেবে একটি যুক্তি ও প্রমান খুঁজে পেয়েছেন। কী সেই প্রমান? প্রমানটি হল, মুকুন্দরাম তার গ্রন্থের সূচনায় বন্দনা অংশে একটি ছত্র লিখেছেন, "গীতের গুরু বন্দিলাম শ্রীকবিকঙ্কন।" তাহলে কে এই 'গুরু কবিকঙ্কন'? নিশ্চয়ই বলরামই হবে! কারণ 'মুকুন্দরাম' ছাড়া দ্বিতীয় কবিকঙ্কন রূপে তো আমরা একটু আগে বলরামের নামই জেনেছি। সে কথা তো মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি মহাশয়ও 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায়' উল্লেখ করেছেন। সুতরাং যোগেশবাবুর ধারণা ভুল কিছু ছিল না।
এবার কেন মুকুন্দরামকে বলরামের অনুকারী বলা হয়েছে তা দেখা যাক। 'সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায়' মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি মহাশয় দুই কবির কাব্যের কিছু 'ছত্র' উত্থাপন করেছেন। সেখানে দুই কবির মধ্যে প্রভূত মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। যেমন বলরামের প্রতিলিপির দুটি লাইন হল,
"অভয়ার অভয় চরণে করি ধ্যান
বলরাম শ্রীকবিকঙ্কন রস গান।"
এবার মুকুন্দরামের দুটি লাইন দেখা যাক,
"অভয়া চরণে মজুক নিজ চিত
শ্রীকবিকঙ্কন গান মধুর সঙ্গীত।।"
এছাড়াও আরও দুটি লাইন হল--
কুঁচ দিয়া কৈল মান ষোল রতি দুই ধান
শ্রীকবিকঙ্কন রস গান।"
এখানে 'অভয়া', 'চরণে', 'রস', 'গান' এগুলো এত বেশি সমান যে কে কার অনুকারী সেটা স্পষ্ট করে বলেননি বিদ্যানিধি মহাশয়ও। বরং পাঠকের কাছেই এ প্রশ্ন তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এরকম মিল বা প্রভাব তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কালিদাসের মধ্যেও দেখা গেছে। 'বাসুকীর সন্ধানে' নামে একটি লেখায় ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায় তার কিছু দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন। যেমন, কালিদাস লিখেছেন---
"অভিনব মধু লোলুপপস্তং তথা পরিচুমা চুত মঞ্জরীম
কমলবসতিমাত্রনির্বৃতো মধুকর বিস্মৃতোহস্যেমাং কথম্।।"
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন---
"নবমধু লোভী ওগো মধুকর, চ্যুত মঞ্জরী চুমি
কমল নিবাসে যে প্রীতি পেয়েছো, কেমনে ভুলিলে তুমি?"
আবার 'ঋতুসংহার' কবিতায় কালিদাস লিখেছেন---
"পুষ্পাবতংস সুরভীকৃত কেশপাশা"
এদিকে 'বর্ষামঙ্গল' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন---
"কেতকী কেশরে কেশপাশ করো সুরভি।"(খ্যাপা খুঁজে ফেরে/ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা- ১৬২, ১৬৩)
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের কাব্যে প্রভাবিত হয়েছিলেন এমন কথা বলা হয়। কোথাও তিনি নকল করেছেন এমনটা বলা হয় না।
🍂
এবার আসি গুরু-শিষ্যের প্রসঙ্গে। কে গুরু? মুকুন্দরাম, নাকি বলরাম? তৎকালীন সময়ে মেদিনীপুরের লোকেদের বিশ্বাস ছিল বলরাম ছিলেন মুকুন্দরামের গুরু। (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩০২, শ্রাবণ সংখ্যা) এদিকে যোগেশচন্দ্র বসুও সেটাই মনে করেন। কারণ তিনি বলেছেন, বলরামের কাব্যখানির ছায়া অবলম্বনে মুকুন্দরাম তার 'চন্ডী' কাব্য রচনা করেন। এমনকি তিনি এ কথাও বলেন যে মুকুন্দরামের পূর্ববর্তী কবি ছিলেন বলরাম। (মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৬০৭) সুতরাং তিনিও বলরামকে মুকুন্দরামের গুরু বলেই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু গুরু শিষ্যের কথায় একেবারে বিপরীত সুর প্রতিষ্ঠা করেছেন বিদ্যানিধি মহাশয়। তিনি স্পষ্ট বলেছেন,"যদি গুরু শিষ্য সম্বন্ধ ধরিতে হয় তবে মুকুন্দরামই গুরু, বলরাম তদীয় শিষ্য।"(সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩০২, শ্রাবণ সংখ্যা) কিন্তু তাই যদি হত, তাহলে মুকুন্দরাম ও বলরামের মধ্যে কে কার অনুকারী সে বিতর্কটা অনেক আগেই মিটে যেতে পারত। কিন্তু ওটা মিটল না কারণ বিদ্যানিধি মহাশয়, বলরাম ও মুকুন্দরামের মধ্যে 'কে কার অনুকারী' এমন প্রশ্নচিহ্ন না রেখে তখনই বলে দিতে পারতেন মুকুন্দরামের অনুকারী বলরাম। কিন্তু সেটা তিনি বলেননি। আবার বলরাম ও মুকুন্দরামের সময়কালও তিনি এড়িয়ে গেছেন। এবং কে কার গুরু সেটাও পাঠককেই দুই কবির কাব্য পড়ে স্থির করতে বলেছেন। সুতরাং মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি মহাশয়ের যুক্তিও একেবারে সঠিক নয়।
যোগেশচন্দ্র বসু 'বলরাম কবিকঙ্কন' এর রচিত আসল গ্রন্থটি পাননি। তবে কোন এক উৎকল কবি বলরামের গ্রন্থটি নাকি উৎকল ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। সেইটি তিনি স্বর্গীয় জীবন কৃষ্ণ মাইতির সহযোগিতায় সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। সেখানে বলরামের চন্ডীর কাহিনী প্রসঙ্গে বলেছেন, সেটা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। কালকেতু ব্যাধ ও শ্রীমন্ত সদাগরের দুটি আলাদা আলাদা কাহিনী ছিল না। শ্রীমন্ত সদাগরের কাহিনীর মধ্যে কালকেতুর কাহিনী রয়েছে। বলরামের চন্ডিতে কালকেতুর গুজরাটে রাজ্য স্থাপন বা কলিঙ্গাধীপতির সঙ্গে যুদ্ধের ঘটনাও নেই। এমনকি ধনপতির সিংহল যাত্রার উদ্দেশ্যও ছিল ভিন্ন। গর্ভবতী খুল্লনাকে একটি মধুফল এনে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যেই তার সিংহল যাত্রা ছিল। সেখানে কমলেকামিনী-র দৃশ্যও নেই। বলরাম কবিকঙ্কনের চন্ডী পাঠের পর যোগেশ বাবুর মনে হয়েছে, "বলরামের চন্ডীর উক্ত উপাখ্যানের সঙ্গে মুকুন্দরামের কাব্যের উপাখ্যানগুলি মিলাইয়া দেখিলে আমরা স্পষ্ট দেখিতে পাই যে মুকুন্দরাম বলরামের চন্ডী হইতে তাহার কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করিয়াছিলেন।"(মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৬২৩)
যাইহোক দীনেশচন্দ্র সেনের কথা মাথায় রেখেও এ বিষয়ে ডঃ জয়দেববাবুর প্রাসঙ্গিক একটি লেখার এই অংশটুকু বলার লোভ সামলাতে পারছি না, "পূর্বসূরীর রচনার প্রভাব যদি এসে পড়েই অধস্তন কোন লেখক বা কবির মধ্যে, তাতেও 'সব গেলো- সব গেলো' করার তো কিছুই নেই। এই প্রভাবের মধ্যেও দেখা যায়, অধস্তন যিনি, তিনি তার প্রতিভার প্রাখর্যে অনন্য হয়ে উঠেছেন নিজস্ব এক স্টাইল গড়ে তুলে। হয়তো প্রবর্তন যাঁর প্রভাবে তিনি প্রভাবিত, হয় তার চেয়েও বেশি সুনাম, সুখ্যাতি আর যশের অধিকারী হলেন তিনি নিজস্ব শৈলীতে ভাস্কর হয়ে।" (বাসুকীর সন্ধানে/ ডঃ জয়দেব মুখোপাধ্যায়, উৎস- খ্যাপা খুঁজে ফেরে, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬১)
'বলরাম' ও 'মুকুন্দরাম' দুই 'কবিকঙ্কন' মেদিনীপুরের বুকে তাদের চন্ডী কাব্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এটাই মস্তবড় গর্বের বিষয়।
তথ্যসূত্র: ১) বঙ্গভাষা ও সাহিত্য/ দীনেশচন্দ্র সেন
২) মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু, ১ম ও ২য় খন্ড একত্রে
৩) সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৩০২, শ্রাবণ সংখ্যা
0 Comments