জ্বলদর্চি

ড. প্রবোধকুমার ভৌমিক (নৃতত্ববিদ গবেষক, নারায়ণগড়) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭১
ড. প্রবোধকুমার ভৌমিক (নৃতত্ববিদ গবেষক, নারায়ণগড়) 

ভাস্করব্রত পতি

মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৪২ এর ৯ ই সেপ্টেম্বর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেপ্তার হন। ২৩ শে সেপ্টেম্বর তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। টানা আড়াই বছর কারান্তরালে কাটাতে হয় তাঁকে। যদিও কারার প্রাচীর তাঁর পড়াশোনায় কোনও রূপ ছেদ ফেলতে দেয়নি। ১৯৪৫ এ জেল থেকে বেরিয়ে জাতীয় স্কুল কলাগেছিয়া জগদীশ বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন বেশ কয়েকটা লেটার সহ। এরপর কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে নৃতত্ত্ব বিষয়ে স্নাতক হন। ১৯৫১ তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরের বছরেই বঙ্গবাসী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। একসময় সমগ্র বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হন। সেইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য হন। 
তিনিই ড. প্রবোধকুমার ভৌমিক। মেদিনীপুরের মানবদরদী বীর সন্তান। ১৩৩৩ এর ১৯ শে ভাদ্র (১৯২৬ এর ৬ ই সেপ্টেম্বর) নন্দীগ্রামের আমদাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ ভৌমিক এবং মা স্বর্ণময়ী ভৌমিক। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মেদিনীপুরের লোধা জনজাতির জীবন। মেদিনীপুরের মানুষদের নিয়েই তাঁর কাজ ফুলপল্লবিত হয়েছে। জন্মভূমির প্রতি টান ছিল তাঁর কর্মজীবনের নানা অধ্যায়ে। তাঁর এই মেদিনীপুর প্রীতি বিষয়ে ড. রেবতীমোহন সরকার লিখেছেন, "ডক্টর ভৌমিক ছিলেন অঞ্চলপ্রেমী। মেদিনীপুর জেলাকে তিনি যে কেবল অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন তাই নয়, এর প্রতি তাঁর ছিল হৃদয়ের শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা। কাজেই প্রথম জীবনে তিনি যত গবেষণার কাজ করেছেন, তার সবগুলিরই বিষয়বস্তু ছিল মেদিনীপুর জেলাকেন্দ্রিক। এইজন্য অনেকেই তাঁকে অঞ্চলভিত্তিকতা দোষে দুষ্ট করতেন। মানবগোষ্ঠীর জীবনচর্যার ধারা অনুসন্ধানে তিনি দৃষ্টিভঙ্গিকে সীমিত করে একটি জেলার গণ্ডীর মধ্যেই থেকে গিয়েছেন, যেখানে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা রয়েছে যে, কোন মানবগোষ্ঠী এবং গোষ্ঠীর কার্যাবলীকে রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। অধ্যাপক ভৌমিক এবিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং সমস্ত রকম সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে এই আঞ্চলিক বন্ধনে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টাকে এতটুকুও দূষণীয় বলে মনে করেন নি। অন্যদিকে দেখতে গেলে এই বিষয়টিই প্রতিভাত হবে যে, তিনি এই বিশেষ অঞ্চলের মানুষ বলেই লোধাদের মত দাগী অপরাধীদের মধ্যে প্রবেশে সমর্থ হয়েছিলেন"। 

১৯৬১ তে তিনি ডক্টরেট উপাধি পান। তিনি মেদিনীপুরের মোট ৩১ টি বিভিন্ন গ্রামের ৪০৮ টি পরিবারকে নিয়ে সমীক্ষা করেন। এরমধ্যে ছিল ১০৪০ জন পুরুষ এবং ৯৬৭ জন মহিলা। সেই সমীক্ষা লব্ধ নির্যাস ফুটে ওঠে "দ্যা লোধাস অব ওয়েস্ট বেঙ্গল" গ্রন্থে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এখান থেকেই পান ডি ফিল। ভারতের অন্ত্যজ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে তাঁর নিবিড় গবেষণা। তাঁদের সংস্কার সংস্কৃতি, জীবন চর্চা, বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা, জাতিভেদ প্রথা নিয়ে তুল্যমূল্য গবেষণার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ উঠে এসেছে তাঁর লেখা নানা রচনায়, প্রবন্ধে এবং প্রকাশিত বইগুলিতে। ১৯৬৭ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেয় ডি এস সি ডিগ্রি। তিনি তাঁর দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবনে সমাজের বঞ্চিত মানুষের হয়ে গবেষণা করে গিয়েছেন এবং তাঁদের মানোন্নয়নে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। ২০০৩ এর ৫ ই ফেব্রুয়ারি তিনি দেশান্তরিত হন। তাঁর দেহ এই বিদিশা চত্বরেই শায়িত করা হয়। 
তাঁর গবেষণার মুখ্য উপাদান ছিল সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বর্গ লোধা জনজাতির মানুষদের নিয়ে। উচ্চ সমাজের চোখে এঁরা নাকি জন্মদাগী অপরাধপ্রবণ জনজাতি। তাঁদের পুনর্বাসন এবং তাঁদের জাতিগত উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৫ তে নারায়নগড়ের ফুলগেড়িয়া মৌজায় ৫০-৬০ বিঘা জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন "বিদিশা"। যা পুরোদমে শুরু হয় ১৯৬১-৬২ সালে। আজও ড. প্রবোধকুমার ভৌমিকের স্বপ্নের 'বিদিশা' প্রতিপালিত করে চলেছে প্রিমিটিভ জনজাতির অসংখ্য ছেলে মেয়েদের। এখানেই তিনি গড়ে তোলেন চিড়িয়াখানা -- 'কণ্ববন'। এখানেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন নির্মল বসু স্মৃতি কক্ষ, বারীন ঘোষ স্মৃতি কক্ষ, রাঢ় সংস্কৃতি সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, ক্রেইশ বালোয়াড়ি কেন্দ্র, শিশু রক্ষনাগার ইত্যাদি। রেখেছেন নৌ বিহারের ব্যবস্থাও। আছে হরিণদের জন্য মুক্তাঞ্চল। ড. প্রবোধকুমার ভৌমিক নিজেই নামকরণ করেছেন কালকেতু অঙ্গন, ফুল্লরা অঙ্গন, স্বপ্ন সন্ধ্যা, পাঞ্চালী, বিশ্বাবসু অঙ্গন, বকুল, রূপমতী, আম্রপালি, জতুগৃহ ইত্যাদি আবাস এবং কুটিরের নাম। তিনি মনে করতেন লোধা জনজাতির ছেলে মেয়েদের যথার্থ উন্নয়ন করতে হলে তাঁদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। বিদিশার সমাজ সেবক সংঘের উদ্যোগে সেই কাজ শুরু হয় ১৯৬৫ র ১১ ই এপ্রিল। অবশেষে ১৯৬৬ এর ৩০ শে জুন উদ্বোধন হয় লোধাদের ছাত্রাবাস - 'কালকেতু অঙ্গন'! ফের ১৯৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে উদ্বোধন হয় 'বিশ্ববসু অঙ্গন'। ১৯৭৩ এ ছাত্রীদের জন্য উদ্বোধন করা হয় 'ফুল্লরা অঙ্গন'। 

তিনি সৌম্য দর্শন পুরুষ ছিলেননা। কিন্তু একঝলক দেখলেই মনে হবে তিনি আসলে FACE OF THE COMMON MAN। তিনি বঞ্চিত নিপতিত নিপীড়িত এবং নির্যাতিত মানুষজনের প্রতিভূ। ব্রিটিশদের চোখে যাঁরা ছিলেন Born Criminal, তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য দরবার করতে ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। এই বিদিশার চারপাশে বসবাস করেন সাঁওতাল, লোধা, কোঁড়া, ওঁরাও, মাহালী, ভূমিজ, মুণ্ডা জনজাতির মানুষজন। তাই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের অধ্যাপকরা এই বিদিশাকে বেছে নিতেন এখানে এসে এইসব তপশিলি জাতি উপজাতির মানুষদের সঙ্গে মেশার এবং একান্ত আলাপ করার সুযোগ পাবেন বলে। আজও প্রতি বছর তাঁর জন্মদিনে এখানে আয়োজিত হয় লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ে জাতীয় আলোচনা চক্র।  আসলে এই নামটিই গবেষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। 

ভারতের ফলিত নৃতত্বের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই মানুষটি তাঁর নিরন্তর গবেষণাতে বিভিন্ন আদিবাসী সমৃদ্ধ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমির উদঘাটন করতে সচেষ্ট ছিলেন সবসময়। আসলে নানা ধরনের গোষ্ঠীর মানুষদের আগমন এবং তাঁদের বহন করে নিয়ে আসা সাংস্কৃতিক চেতনা সেই ভিত্তিভূমির ওপর একটা আবরণ তৈরি করেছিল। সেই আবরণ উন্মোচন করার প্রয়াসে ব্যাপৃত রেখেছিলেন নিজেকে। 

অধ্যাপক প্রবোধকুমার ভৌমিকের লিখিত বাংলা ও ইংরাজি গ্রন্থগুলি হল -- ১) উপজাতির কথা (সহ লেখক ড. এম. এন বসু), ১৩৬৩; ২) সমাজ ও সম্প্রদায়, ১৯৬১; ৩) প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতি, ১৯৬৪; ৪) বাংলার লোক উৎসব, ১৯৬৮; ৫) প্রত্যন্ত বাংলায় গুপ্তবিদ্যা (ভাষান্তর ড. দেবব্রত ভট্টাচার্য), ১৯৯৪; ৬) লোকসমাজ ও সংস্কৃতি, ২০০৩; ৭) দ্যা লোধাজ অভ ওয়েস্ট বেঙ্গল, অ্যা সোসিও ইকনমিক স্টাডি, ১৯৬৩; ৮) অকুপেশনাল মবিলিটি অ্যাণ্ড কাস্ট স্ট্রাকচার ইন বেঙ্গল, ১৯৬৯; ৯) সোসিও কালচারাল প্রোফাইল অভ ফ্রনটিয়ার বেঙ্গল, ১৯৬৭; ১০) অকালটিজিম্ ইন ফ্রিঞ্জ বেঙ্গল, ১৯৭৮; ১১) সাম এ্যাসপেক্টস অভ ইণ্ডিয়ান অ্যানথ্রোপলজি, ১৯৮০; ১২) অ্যাপ্লায়েড অ্যাকশন ডেভলপমেন্ট অ্যানথ্রোপলজি, ১৯৮৯; ১৩) দ্যা চেঞ্চুজ অভ দ্যা ফরেস্টস অ্যাণ্ড প্ল্যাটৌজ : অ্যা গ্যাদারিং-হান্টিং-ট্রাইব ইন ট্রানজিশন, ১৯৮৯; ১৪) প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপস ইন ইস্টার্ন ইণ্ডিয়া : ওয়েলফেয়ার অ্যাণ্ড ইভ্যালুয়েশন, ১৯৯৪; ১৫) রিথিঙ্কিং ট্রাইবাল কালচার ইন ইণ্ডিয়া, ২০০১, ১৬) কাস্ট ইন বেঙ্গল বর্ডার,, ২০০২; ১৭) আমাদের মেদিনীপুর ইত্যাদি। 
ড. রেবতীমোহন সরকার এই মহান মানুষটিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, "পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতীয় নৃবিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে অধ্যাপক প্রবোধকুমার ভৌমিক কেবলমাত্র একটি বিশিষ্ট নামই নয় — তিনি ছিলেন নৃবিজ্ঞানের প্রাণরসে সিঞ্চিত একটি উল্লেখনীয় ব্যক্তিত্ব। মানববিজ্ঞনের অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি মানবের অন্তর্লোকে প্রবেশাধিকার লাভ করেছিলেন। তবে সেই অধিকার নিঃসন্দেহে কষ্টার্জিত। জীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মানব প্রকৃতির অনুশীলন করার মাধ্যমে তিনি মানবমনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পেরেছিলেন। সেই অনুশীলনের পদ্ধতি ছিল তাঁর মৌলিক আন্তরিকতা এবং মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা । তিনি কোন পুস্তক উল্লেখিত পদ্ধতি বিজ্ঞানের ছায়া মাড়াননি। তাঁর প্রাথমিক পদ্ধতি ছিল উদার উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো এবং সেই পরিভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ এবং তার কর্মকাণ্ড ও চিন্তাধারাকে লক্ষ করে মূল্যায়ন করা। অধ্যাপক ভৌমিকের গবেষণা ও আলোচনার বিচিত্র ধারা পর্যালোচনা করলেই একটি বিষয়ই প্রতিভাত হয় যে, তিনি তাঁর অবিচ্ছিন্ন ক্ষেত্র পরিভ্রমণের মধ্য দিয়েই নৃবিজ্ঞানের শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। সাধারণ গ্রামীণ মানুষের জীবনবেদই তাঁকে মানববিজ্ঞানীতে পরিণত করেছিল। প্রথম থেকেই তিনি মৌলিক পর্যবেক্ষণের প্রতিই বিশ্বাসী ছিলেন। এই কারণেই কোন দেশী বিদেশী নৃবিজ্ঞানীর কোন বিশেষ তত্ত্বকে অনুসরণ করে তিনি কোনদিনই গবেষণাকর্মে উৎসাহী ছিলেন না। বরং দেশজ চিন্তাধারা এবং লোকজীবনের দর্শনকে (Peoples' philosophy) সবিশেষ গুরুত্বদান করে তার মধ্য দিয়েই তিনি গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করেছেন"।
🍂

Post a Comment

0 Comments