জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—মায়ানমার (এশিয়া)শামুকদের পেশীতে কখনও টান ধরে না /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোক গল্প—মায়ানমার (এশিয়া)
শামুকদের পেশীতে কখনও টান ধরে না
চিন্ময় দাশ

শামুক পাড়ার মোড়ল চলেছে রাস্তা দিয়ে। একটা ঘোড়া আসছিল পেছন দিক থেকে। শামুককে দেখে, একটু মস্করা করবার সাধ হোল ঘোড়ার। বলল—এই যে মহারাজ! রাস্তার ধার দিয়ে চলতে হয়, সেটা জানিস না?
সক্কাল বেলায় এমন ব্যাঙ্গ কার ভালো লাগে? মেজাজ বিগড়ে গেল শামুকের। তবুও শান্ত গলায় বলল—কেন গো, রাস্তা কি কম পড়েছে তোমার? 
--কম পড়েছে কি বেশি, সে হিসাবের কথা নয় এটা। আমি কেবল জানতে চাই, দ্রুতগতির জীবকে রাস্তা ছেড়ে দিতে হয়, বনের সব্বাই জানে এটা। তোর জানা নাই?
শামুক উত্তর দিতে যাবে, তার আগেই ঘোড়া বলে উঠল—পুঁচকে একটা শুঁয়োপোকা। তোর চেয়ে কত্তো ছোট। সেও তোর চেয়ে দ্রুত চলে বেড়াতে পারে। ঠিক আছে, শুঁয়োটার কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। কেন না, শতখানেক পা আছে তার। সে চলতেই পারে। তাহলে, কেঁচোর কথাই ধর। তোর মতো পা নাই তারও। চেহারায়ও অনেক ছোট। সেও তোর চেয়ে অনেক দ্রুত চলতে পারে। বলিহারি যাই বিধাতাকে। সৃষ্টি করেছেন একটা জীবকে। দুটো পা দিতে কী এমন অসুবিধা ছিল? বুঝি না বাপু। 
শামুকের আর সহ্য হোল না। সে বলল, শুধু চলাফেরা নয়। আমরা শামুকেরা দৌড়তেও পারি। তবে, সে কেবল দৌড়ের কোনও প্রতিযোগিতা হলে। তোমাকে পেটের জন্য হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়। তাই ছোটাছুটি করে বেড়াও। আমার সে দায় নাই। খামোখা ছুটে মরতে যাবো কেন।
আর যায় কোথায়? ঘোড়া খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠল। বিরক্ত হয়ে শামুক বলল—হাসলে যে বড়? কারণটা কী? 
--তোর কথা শুনে হাসিতে পেট ফুলে ফেঁপে উঠছে যে রে! না হেসে কি মারা পড়ব নাকি? 
--এর মধ্যে হাসির কথা আবার কোথায় পেলে তুমি? 
--কেন? ঐ যে তুই দৌড় প্রতিযগিতার কথা বললি!তাতেই হাসিতে পেট গুড়গুড় করে উঠল। 
শামুক ধীর গলায় বলল—অতো কথাবার্তা হাসাহাসির কী আছে? দৌড়ের একটা প্রতিযোগিতা হয়ে যাক। সব প্রমাণ হয়ে যাবে। 
ঘোড়া বেশ মজা পেল এমন প্রস্তাবে। বলল—তাহলে আর দেরি কেন? কাল সকালেই হয়ে যাক প্রতিযোগিতাটা।
🍂

 --আমারও তাই মত। শুভকাজে বিলম্ব করতে নাই। 
ঘোড়া হাসতে হাসতে বলল—চলি হে দৌড়বীর। কাল সকালে দেখা হচ্ছে। এখানেই এসো কিন্তু।
ঘোড়া চলে গেল। রাগে সারা শরীর রি-রি করছে শামুকের। তাড়াতাড়ি পাড়ায় ফিরে গেল। সব শামুককে ডেকে জড়ো করল এক জায়গায়। বলল—একটা ভালো দাঁও মারবার সুযোগ পেয়েছি। তোমরা রাজি আছো কি না বলো। 
সবাই হামলে পড়ল –রাজি না হওয়ার কী আছে? কিন্তু দাঁওটা কী, সেটা একটু শোনাও আগে। তবে না—
--শোন তাহলে, বলি। বাপ-ঠাকুরদারা বলে গিয়েছে, ঘোড়ার মাংসে রোগ নিরাময়ের গুণ আছে। তাতে পেশির ব্যথা মরে। পিঠের খোল শক্ত হয়। তাছাড়া, …
--আর তাছাড়া বলে কোন কথা নয়। আমরাও জানি। কিন্তু ঘোড়াটা মরেছে কোথায়? কতো দূরে?
শামুক বলল—মরেনি কোথাও। আমরাই মারব একটা ঘোড়াকে। বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। কাজটা করতে পারলে ছ’মাসের খাবার ভাবনাও থাকবে না গোটা পাড়ার। 
এ কথা শুনে, আহ্লাদ হবে কী, সবাই দমে গেল—অতো বড়ো পাহাড়ের মতো একটা জীব। তাকে আমরা মারব তাকে?
আর একজন বলল—তার একটা পায়ের চাপেই তো দশ-বারোজন থেতলে মরে যাব আমরা? 
শামুক বলল—অত ভয় পেতে হবে না কাউকে। তোমাদের কাউকেই ঘোড়াটার সামনে যেতেও হবে ন। 
একজন বলল—তবে সে ঘোড়া একলা আছাড় খেয়ে পড়ে মরবে না কি?
মোড়ল বলল-- কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট না করে, যা বলছি শোন। যারা ঘোড়ার মাংস খেতে চাও, আমার কথা শোন। যাদের মাংস খাওয়ার ইচ্ছে নাই, তারা বাড়ি গিয়ে বসে থাকো।
ঘোড়ার মাংস বলে কথা। কে না খেতে চায়? একজনও বাড়িমুখো হল না। 
খুশি হয়ে মোড়ল শামুক বলল—যা বলছি, মন দিয়ে শোন সবাই। ভুলে গেলে বা উলটো পালটা করলে চলবে না। আগামী কাল সকালে ঘোড়ার সাথে একটা দৌড় প্রতিযোগিতা হবে আমার। তোমাদের কেবল একটু সাহায্য করতে হবে।
সামনে যে পাহাড়টা দেখছ, দৌড় হবে সেটাকে বেড় দেওয়া রাস্তা ধরে। আমরা সবাই জানি, ঘোড়ার সাথে এক কদমও দৌড়াবো, সে মুরোদ আমাদের নাই। আমাদের কেবল মাথা খাটিয়ে বোকা বানাতে হবে ঘোড়াকে। 
একজন বলল—দৌড়বে তোমরা দুজনে। সেখানে আমাদের কাজটা কী?
--সেটাই বলছি। মন দিয়ে শোন। ঐ রাস্তায় একটা বড় পাথর আছে, সবাই জানো তোমরা। 
সবাই বলে উঠল-- জানি, জানি। খুব ভালোই জানি।
--সেখান থেকেই দৌড় শুরু হবে। আমি থাকব সেখানে। তোমাদের কাজ হোল, আমার থেকে মাপা এক ফার্লং দূরে দূরে, এক একজন শামুক দাঁড়িয়ে থাকবে। গাছ-পাতার আড়াল রেখে। ছোটাছুটি করতে হবে না কাউকেই। ঘোড়াটা তোমার কাছে পৌঁছে গেলেই, তুমি রস্তায় উঠে চলতে শুরু করবে। ঘোড়া তোমাকে দেখতে পাক, বা না পাক, প্রশ্ন করবে—দৌড়চ্ছো তো? নাকি সটকে পড়েছ? তখন শুধু বলবে-- পালাবার বান্দা আমি নই। শামুক কখনও পালিয়ে  যায় না। ঘাবড়াবে না, চমকাবে না। তাড়াহুড়ো করবে না। যদি প্রশ্ন না করে, আগ বাড়িয়ে বলতে যাওয়ার দরকার নাই। যা বললাম,খুঁটিনাটি মনে রেখে, কাজ করো। তার পর দেখবে, কেল্লা ফতে। কাজ হয়ে যাবে। বুঝতে পেরেছ সবাই?
সবাই বলল—বুঝে গেছি। না বোঝার কী আছে এতে? 
--তাহলে, আর কী, কাজ সুরু করে দাও। এক ফার্লং ছাড়া ছাড়া দাঁড়িয়ে পাড়া আরম্ভ করে দাও। নইলে শেষ করে উঠতে পারবে না।
ভীড়ের ভিতর থেকে এক বয়স্ক শামুক বলল—সব কাজ আমরা বুঝে নিয়েছি। ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে পড়ব আমরা। তুমি বরং বাসায় চলে যাও। টানা বিশ্রাম নাও গিয়ে, কাল ধকল আছে তোমার।
মোড়ল শামুক বাসায় চলে গেল। বাকিরা হিসাব মতো, এক ফার্লং ছাড়া ছাড়া দাঁড়িয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু শামুকের চলা তো, সারাটা দিন গেল। রাতও কেটে গেল।
সকাল না হতেই, মোড়ল এসে হাজির হয়ে গেল পাথরটার কাছে। একেবারে শেষের শামুক যখন এসে দাঁড়াল মোড়ল শামুকের ঠিক এক ফার্লং আগে,  সূজ্জিমামা তখন আকাশে উঁকি মারছেন।
খানিক বাদেই ঘোড়া এসে হাজির—কই হে, দোড়বীর! তৈরি তো?
ব্যাঙ্গটা গায়ে মাখল না শামুক। জবাব দিল—হ্যাঁ, আমি তৈরিই আছি। তবে, একটা নিয়ম ঠিক করে নেওয়া যাক।
ঘোড়া তাচ্ছিল্যের গলায় বলল—তুমিই বলো, কী নিয়ম? 
শামুক বলল—একসাথেই দৌড় শুরু করব আমরা। তারপর প্রতি এক ফার্লং পৌঁছে, আমরা যে কেউ জানতে চাইব, অন্যজন সেখানে পৌঁছেছে, না পিছিয়ে পড়েছে। এইভাবে দৌড়তে দৌড়তে, পাহাড়টাকে চক্কর দিয়ে, আবার এইখানে এসে পৌঁছব দুজনে। যে পিছিয়ে পড়বে, তার হার।
--ঠিক আছে। তাই হোক। চল তাহলে। বলেই, জোর কদমে দৌড় শুরু করে দিল ঘোড়া। শামুকের কোন হেলদোল নাই। চলতে শুরুই করল না সে। যেখানে ছিল, সেখানেই বসে রইল।
এক ফার্লং দৌড়ে এসে, দৌড় থামাল না ঘোড়া। শুধু জিজ্ঞেস করল—কী হে, দৌড়চ্ছো তো? 
ঘোড়ার খুরে খটখট আওয়াজ। কানে যেতেই প্রথম শামুক চলতে আরম্ভ করেছিল। সে জবাব দিল—দৌড়ব না কেন? তোমার সামনেই তো আছি।
একটু চমকেই গেল ঘোড়া। আরে, সত্যিই তো। কিন্তু পারল কী করে পুঁচকেটা? অবাক হয়ে ভাবছে। কিন্তু থামছে না সে। বরং একটু বেশি জোর লাগিয়েছে পায়ে। 
দ্বিতীয় ফার্লং পার হওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল। উত্তরও পেল-- তোমার সামনেই দৌড়চ্ছি। 
যত দেখে শামুক চলেছে সামনে সামনে, ততই অবাক হয় ঘোড়া। যত অবাক হয়, ততই জোরে দৌড়তে থাকে। 
এই ভাবেই দৌড় চলতে লাগল দুই দৌড়বাজের। পাহাড়টাকে পাক খাওয়া যখন শেষ হয়ে আসছে, ঘোড়ার তখন একেবারে কাহিল অবস্থা। নিশ্বাসের চাপে বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড়।
শেষ ফার্লং যখন পার হোল, চোখ বিস্ফারিত ঘোড়ার। অবাক কাণ্ড! মোড়ল শামুকটা তার আগেই পৌঁছে গিয়েছে! শামুকের ফন্দি, ধরতেই পারেনি ঘোড়া। 
শামুক চেঁচিয়ে উঠল—কী হে, কে আগে পৌছলো? হার কার হোল তাহলে?
কে দেবে তার কথার উত্তর? কলিজা ফেটে, দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল ঘোড়া। বুকের ধুকপুকানি থেমে গিয়েছে তার।
তার পর? তারপর আর কী? শামুকদের গোটা পাড়া অনেকদিন ধরে ভোজ খেয়েছিল ঘোড়ার মাংসের।
এজন্যই মায়ানমারের লোকেরা বলে—শামুকদের পেশীতে টান ধরে না কখনও।

Post a Comment

0 Comments