জ্বলদর্চি

কর্ণগড় রাজবংশ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯০

কর্ণগড় রাজবংশ

সূর্যকান্ত মাহাতো


'কর্ণগড় রাজবংশ'। ইতিহাস, কাব্য, বিদ্রোহ, সাহিত্য সবকিছুই এত বেশি করে এই রাজবংশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যা জঙ্গলমহলের আর কোন রাজবংশে নেই। শেষের দিকে দু- দুবার এই 'গড়' প্রবল ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। একবার চুয়াড়দের দ্বারা, আর একবার ইংরেজদের দ্বারা। বিনয় ঘোষের ভাষায়,"চুয়াড় বিদ্রোহের সময় দলপতি গোবর্ধন দিকপতি রাজবাড়ি দখল করেন। রানীরা দুজনেই নাড়াজোলের রাজা ত্রিলোচন খাঁনের আশ্রয় নেন।"(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৩) পরবর্তীকালে আবার চুয়ার বিদ্রোহের সঙ্গে এই রাজবংশ জড়িয়েও পড়েছিল। অন্যদিকে যোগেশচন্দ্র বসুর ভাষায়, "ইংরাজ সৈন্য কর্তৃক কর্ণগড় লুন্ঠিত হয় এবং একদিনেই কর্ণগড় রাজভবন শ্রীহীন শ্মশানে পরিণত হয়।"(মেদিনীপুরের ইতিহাস, যোগেশচন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৫২৭)

তো এরকমই এক রাজবংশের ইতিহাস জানতে হলে রাজবংশের রাজাদের ধরে ধরে আলোচনা করলে বিশেষ সুবিধা হয়। তাই রাজাদের বংশ পরিচিতিটা বরং একবার দেখে নেওয়া যাক। 'বিনয় ঘোষ' তার 'পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি' গ্রন্থে 'কর্ণগড় রাজবংশের' একটি বংশ তালিকা সাল সহ উল্লেখ করেছেন এইভাবে---
১) রাজা লক্ষ্মণ সিংহ (১৫৬৮ থেকে ১৬৬১খ্রিস্টাব্দ)
২) রাজা শ্যাম সিংহ (১৬৬১-১৬৬৮)
৩) রাজা ছটু রায় (১৬৬৮)
৪) রাজা রঘুনাথ রায় (১৬৭১-১৬৯৩)
৫) রাজা রাম সিংহ (১৬৯৩-১৭১১)
৬) রাজা যশোবন্ত সিংহ(১৭১১-১৭৪৯)
৭) রাজা অজিত সিংহ(১৭৪৯) (এই সালটা তরুণদেব ভট্টাচার্য আবার তার বইয়ে ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন।(মেদিনীপুর, পৃষ্ঠা- ১৮৯)
৮) রানী শিরোমণি(১৭৫৬-১৮১২)

যোগেশচন্দ্র বসু তার 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' গ্রন্থে বলেছেন, "ঐ দুই বংশের (কর্নগড় ও বলরামপুর) কুলখ‍্যান পত্র হইতে জানা যায় যে, খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে ঐ দুইটি রাজবংশ এতদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত হন।" (মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১২৯) রাজা লক্ষ্মণ সিংহের রাজবংশ কর্নগড়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও 'গড়' বা 'দুর্গ' এবং 'মহামায়া মন্দির' তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এমনটা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ "ভবিষ্য ব্রহ্মখন্ড" নামে এক সংস্কৃত গ্রন্থে বলা আছে, এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে 'কর্ণগড়' বা 'কর্ণদুর্গের' অস্তিত্ব ছিল। (গৌড়ের ইতিহাস, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, দ্বিতীয় ভাগ) শুধু তাই নয় যোগেশবাবুও এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ঐ গড় এবং মন্দিরাদি কবে এবং কার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল তা বলা বেশ কঠিন। (মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১২০) তবে তিনি 'কেশরী রাজবংশ' নামে এক রাজবংশের কথা অনুমান করেছিলেন। তাঁর এমন অনুমানের কারণ হল, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী 'মেদিনীপুর সাহিত্য পরিষদের' চতুর্থ বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতি পদে যোগদান করতে এসে এই মন্দিরাদি দর্শন করেছিলেন। এবং সেগুলিকে 'উৎকল শিল্প' বলেই মত প্রকাশ করেছিলেন। এদিকে ভুবনেশ্বরের অধিকাংশ মন্দিরগুলো নাকি 'কেশরী রাজবংশের' রাজত্বকালেই গড়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, উৎকলের ইতিহাস বলছে যে, এমন মন্দির নির্মাণে তাদের পুরুষানুক্রমে একটা আগ্রহও নাকি বরাবর ছিল। তাই যোগেশবাবু এই সব থেকেই অনুমান করেছিলেন 'কেশরী' রাজবংশের রাজা 'কর্ণকেশরী' এই গড় ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করে থাকতে পারেন।

কিন্তু সেটাও যে কতটা সত্য তা সুনিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ 'রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়' তো বলেই দিয়েছেন, উৎকলের ইতিহাসে 'কর্ণকেশরী' বলে কোন রাজার নাম নেই। এমনকি কোন খোদিত লিপিতেও 'কর্ণকেশরী' নাম আবিষ্কৃত হয়নি। (বাংলার ইতিহাস, প্রথম ভাগ, পৃষ্ঠা- ২৩২, দ্বিতীয় সংস্করণ) তাহলে কে এই 'কর্ণকেশরী'? যোগেশবাবু যে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলা কথাটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না এমনটা তো নয়। তারপরেও তিনি তাহলে এমন কথা বলেছিলেন কেন? কারণ যোগেশবাবু, রাখালবাবুর বিষয়টি অবগত হয়েই বলেছেন, এই 'কর্ণকেশরী' সমগ্র উৎকলের রাজা ছিলেন না। সম্ভবত কোন এক প্রদেশের রাজা ছিলেন। তবে কোন প্রদেশের রাজা ছিলেন সেইটা তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। তাই তার অনুমান কতটা সঠিক সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার মন্দিরের সামনে 'বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়' কর্তৃক একটি 'ফলক নামা' রয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, এই 'গড়' 'মহাবীর সিংহ' কর্তৃক নির্মিত।  যদিও সেটা বিনয় ঘোষ, যোগেশচন্দ্র বসু এবং তরুনদেব ভট্টাচার্যের মতো লেখকেরা উল্লেখ করেননি। 

যাইহোক, রাজা লক্ষ্মণ সিংহ কীভাবে কর্ণগড়ে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করলেন তারও একটা পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। "ভবিষ্য ব্রহ্মখন্ড" নামে এক সংস্কৃত গ্রন্থ বলছে, খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে বর্ধমান প্রদেশে দামোদর নদীর তীরে 'হেমসিংহ' নামে এক ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। তার ভাই ছিলেন 'বীর সিংহ'। তিনি পরাক্রম বলে তাম্রলিপ্ত, বরদাভূমির সঙ্গে কর্ণদুর্গও অধিকার করেছিলেন।( গৌড়ের ইতিহাস, রজনীকান্ত চক্রবর্তী, দ্বিতীয় ভাগ) তারমানে বীর সিংহের দখলেরও পূর্বে 'কর্ণগড়' এর অস্তিত্ব ছিল। এই বীর সিংহের বংশে মোট চারজন রাজার নাম পাওয়া যায়, যারা মেদিনীপুর জেলার একাধিক জায়গায় 'গড়' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই চারজন রাজা হলেন অভয়া সিংহ, কুমার সিংহ, জামদার সিংহ ও সুরথ সিংহ। অভয়া সিংহ শালবনীর সাতপাটি গ্রামের অদূরে 'অভয়াগড়' নির্মাণ করেছিলেন। কুমার সিংহ গদাপিয়াশাল গ্রামের অদূরে 'কুমারগড়' নির্মাণ করেছিলেন। 'জামদার গড়' তবে কি জামদার সিংহ? সেটা সুনিশ্চিত করে বলা যায় না। সুরথ সিংহ ছিলেন এই বংশের শেষ রাজা। H.V.Bayley(বেলি) সাহেব তার "Memoranda of Midnapore" গ্রন্থে  সুরথ সিংহকে 'খয়রা' জাতির রাজা বলেছেন। তিনি একই সঙ্গে 'কর্ণগড়' এবং 'বলরামপুর' রাজ্যের রাজা ছিলেন। কারণ পরবর্তীকালে তার দুই কর্মচারী 'লক্ষ্মণ সিংহ' ও 'ভিম মহাপাত্র' সুরথ সিংহকে হত্যা করে লক্ষ্মণ সিংহ 'কর্ণগড়'(১৫৬৮) রাজ্য এবং ভীম মহাপাত্র 'বলরামপুর' রাজ্য অধিকার করেছিলেন।

১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে কর্ণগড়ে এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাজা 'লক্ষ্মণ সিংহ' জঙ্গলমহলের প্রভূত উন্নতি সাধন ঘটিয়েছিলেন। তিনি জাতিতে সদগোপ ছিলেন। তাই এই রাজবংশ সদগোপ রাজবংশ।

রাজা লক্ষ্মণ সিংহকে হত্যা করে তার ভাই 'শ্যাম সিংহ' পরবর্তী কালে রাজা হয়েছিলেন। তার সময়কাল ছিল ১৬৬১ থেকে ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

পরবর্তী রাজা ছটু রায় রাজ্যের অধিকার লাভ করার পূর্বে রাজা লক্ষ্মণ সিংহের পুত্র পুরুষোত্তম সিংহ, শ্যাম সিংহের কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য রাজ্যভার কেড়ে নিয়েছিলেন। এরপর তার পুত্র 'সংগ্রাম সিংহ' রাজা হয়ে উঠেছিলেন। এই সংগ্রাম সিংহের পুত্রই 'ছটু রায়' ১৬৬৮ সালে কর্নগড় রাজবংশের পরবর্তী রাজা হয়ে উঠেছিলেন।

ছটু রায়ের মৃত্যুর পর তার ভাই 'রঘুনাথ রায়' রাজা হয়েছিলেন। তার সময়কাল ছিল ১৬৭১ থেকে ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

এরপর কিছু সময়ের জন্য রাজা হয়ে উঠেছিলেন ছটু রায়ের পুত্র 'বীর সিংহ'। কিন্তু তার সময়কালে নাকি চরম বিশৃঙ্খলা দেখা গিয়েছিল। তাই নবাব সরকার রঘুনাথ রায়ের পুত্র রাম সিংহকে রাজার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

রাজা 'রাম সিংহ' ১৬৯৩ থেকে ১৭১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাম সিংহের পূর্বোক্ত রাজারা সেরকম ভাবে কেউ তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। কিন্তু 'রাম সিংহ' ছিলেন এই রাজবংশের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ রাজা। মেদিনীপুর শহরের উত্তরে অবস্থিত 'আবাস গড়' তিনিই নির্মাণ করেছিলেন।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা- ৪৮) কর্নগড় ও আবাস গড়ের পরিখা নির্মাণ সহ মেদিনীপুরের অদূরে কেশপুরের কাছে যে 'রামসাগর' নামে একটি সরোবর আছে, সেটাও নাকি রামসিংহের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। (মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৫২৪) তবে তার সব থেকে বড় অবদান ছিল 'শিবায়ন' কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যকে আশ্রয় দান।

রামসিংহের মৃত্যুর পর রাজা হয়ে উঠেছিলেন তার পুত্র 'যশোবন্ত সিংহ'। তিনি ১৭১১ থেকে ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্য অধিকার লাভ করেছিলেন। কর্ণগড় রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধু রাজা নয়, সেই সঙ্গে একজন ঐতিহাসিক, রাজনীতিজ্ঞ এবং সহৃদয় ব্যক্তিত্বও ছিলেন। নবাব মুর্শিদকুলি খানের কাছে বেশ কিছুদিন রাজকার্য শিখেছিলেন। আবার নবাব সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ খাঁর দেওয়ান হিসেবেও কিছুকাল কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ধার্মিক ব্যক্তিও ছিলেন। দেবী মহামায়ার একনিষ্ঠ সাধকও ছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি বানর, শৃগাল, পেচক, বাদুড়, কুম্ভীর বা বাঘ এই পঞ্চমুন্ডী মাথা গেড়ে তার উপর যোগাসন করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। (মেদিনীপুরের ইতিহাস, যোগেশচন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৫২৫)  বিনয় ঘোষও লোকমুখে এক সন্ন্যাসীর এখানে যোগ সাধন করে দেহরক্ষা করার কথা উল্লেখ করেছেন।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৮) 'শিবায়ন' কাব্য প্রণেতা 'রামেশ্বর ভট্টাচার্য' রাজা যশোবন্তের সভাষদ ছিলেন।(বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব/ রামগতি ন্যায়রত্ন, পৃষ্ঠা- ১৪৪) রাজা যশোবন্তের সময়কালেই কবি তার বিখ্যাত কাব্য 'শিবায়ন কাব্য' রচনা করেছিলেন। মহাভারতের পরে এবং বিদ্যাসুন্দরের পূর্বে এই গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। (বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব/রামগতি ন্যায়রত্ন, পৃষ্ঠা- ১৪৬) কর্ণগড় রাজবংশের রাজাদের কথা কবি রামেশ্বর উল্লেখ করেছেন এইভাবে---
"মহারাজ রঘুবীর, রঘুনাথসম ধীর, ধার্মিক রসিক রসময়।
যাঁহার পুণ্যের বলে, অবতীর্ণ মহীতলে, রাজা রামসিংহ মহাশয়।।
তস্য সুত যশোবন্ত, সিংহ সর্ব গুণবন্ত, শ্রীযুত অজিত সিংহ তাত।
মেদিনীপুরাধিপতি, কর্ণগড়ে অবস্থিতি, ভগবতী যাঁহার সাক্ষাৎ।।"
🍂

"মহামায়া ও মদনমোহনে ঠেলাঠেলি" এমন একটা প্রবচনেরও সৃষ্টি হয়েছিল রাজা যশোবন্তের আমলে। বিষ্ণুপুরের অধিপতি একবার নাকি কর্ণগড় আক্রমণ করলে কর্ণগড়ের সৈন্য বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। তখন মহামায়া দেবী নিজে এসে সেই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
দেবীর আবির্ভাবে বিষ্ণুপুরের কুলদেবতা মদনমোহনও তখন ভক্তকে বাঁচাতে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দুই পক্ষই দাবি করেছিল যে তাদের দেবদেবীরা সেই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। সেই থেকেই এমন প্রবাদটি চালু হয়েছিল। যদিও এই প্রবাদের অর্থ হিসাবে বড়লোকে বড়লোকে ঝগড়া বা কোন মামলা হলে তখন ঐ প্রবচনটি ব্যবহার করে থাকেন স্থানীয় মানুষজনেরা।

১৭৪৮ সালে যশোবন্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র অজিত সিংহ রাজা হয়ে উঠেছিলেন। যথেষ্ট প্রতাপশালী রাজা ছিলেন এই অজিত সিংহ। ১৫ হাজারের মতো সৈন্য ছিল তার। জঙ্গলমহলের অন্য সব রাজারা তার অধীনস্থ ছিলেন। ১৭৬৭ সালের এক সরকারি চিঠি থেকে জানা গিয়েছিল, জঙ্গলমহলের ছোট বড় মিলিয়ে ২১ টি জমিদারের উপর তিনি নাকি আধিপত্য করেছিলেন। (মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৫২৬)

১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা অজিত সিংহের মৃত্যুর পর রাজ্যের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তার দুই রানি, 'রানি ভবানী' ও 'রানি রাশমণি'। কারণ রাজা ছিলেন অপুত্রক। দুই রানি ১৭৫৫ সালে দায়িত্ব লাভের পর নাড়াজোলের জমিদার ত্রিলোচন খাঁনের হাতে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। (মেদিনীপুরের ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৫২৬) অর্থাৎ রানিরা যে সরাসরি রাজকার্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, এ কথা থেকে তাই মনে হয়। তবে আরো একটা অন্যরকম কারণ ছিল। চুয়াড় বিদ্রোহের সময় দলপতি গোবর্ধন দিকপতি রাজবাড়ী দখল করেছিল বলে রানিরা ত্রিলোচন খাঁনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। দুই রানি ত্রিলোচন খাঁনের সঙ্গে যেখানে সাক্ষাৎ করেছিলেন সেই জায়গাটির একটি নামও আছে। জায়গাটি "রানী পাটনা" নামে খ্যাত হয়ে আছে।( পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা ৫০) নাড়াজোল এর জমিদার ত্রিলোচন খাঁন রানিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাদের হারানো রাজ্য তিনি ফিরিয়ে দেবেন।  রানিরা তাই খুশি হয়ে তাকে একটি অঙ্গীকার পত্র দিয়েছিলেন। ঐ অঙ্গীকার পত্রটি "অছিয়তন একরার" নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। ১৭৫৮ সালে অঙ্গীকার পত্রটি সম্পাদিতও হয়েছিল। 'বিনয় ঘোষ' তার পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থে সেই অঙ্গীকার পত্রটির বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে---
১) বাবু ত্রিলোচন খাঁন চুয়াড়দিগকে দমন করেন
২) রানীদের জীবদ্দশায় ত্রিলোচন নায়েব রূপে মেদিনীপুরের জমিদারি অধিকার করবেন।
৩) রানীরা যথাযোগ্য খোরপোষ পাবেন।
৪) রাণীদের মৃত্যুর পরে ত্রিলোচন অথবা তার উত্তরাধিকারী মেদিনীপুর রাজ্যের অধীশ্বর হবেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা- ৫০)

১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথমা রানী, 'রানী ভবানী'-র মৃত্যু হয়। আবার ত্রিলোচন খাঁনের মৃত্যুর পর তার ভাইয়ের পুত্র মতিরাম খাঁন তখন রানী শিরোমনির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তারপর মতিরামের মৃত্যু হলে সেই দায়িত্ব নেন সীতারাম খান। সীতারামের তিন পুত্র ছিলেন, আনন্দলাল, নন্দলাল এবং মোহনলাল। এদের মধ্যে আনন্দলালকে 'রাণী শিরোমণি' একটু বেশি স্নেহ করতেন। তাই ১২০৭ বঙ্গাব্দের ১৯ আষাঢ় একটি 'হেবানামা'-র মাধ্যমে রানী শিরোমণি আনন্দলালকে তাঁর  সমস্ত রাজ্য দান করেন। 'নাড়াজোল' এবং 'কর্নগড়' রাজ্য তখন মিলেমিশে এক হয়ে গেছিল। ১২১৭ বঙ্গাব্দে আনন্দলালও অপুত্রক অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। একটি পত্রের মাধ্যমে তিনি অবশ্য ছোট ভাই মোহনলালকে মেদিনীপুর এবং নন্দলালকে নাড়াজোল রাজ্য দান করে গিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র: ১) মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু
২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, দ্বিতীয় খন্ড
৩) মেদিনীপুর/ তরুনদেব ভট্টাচার্য
৪) গৌড়ের ইতিহাস/ রজনীকান্ত চক্রবর্তী
৫) বাংলার ইতিহাস/ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়
৬) বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব/ রামগতি ন্যায়রত্ন

Post a Comment

0 Comments