জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক দিলীপকুমার রায় /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক দিলীপকুমার রায়

নির্মল বর্মন

সুসাহিত্যিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুযোগ্য পুত্র কবি, উপন্যাসিক, গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা ভাষা তথা সাহিত্যে সুবাসের অধিকারী ছিলেন। দিলীপকুমার রায় ১৮৯৭ সালের ২২ শে জানুয়ারি, নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জন্ম গ্রহণ করেন। সংগীত শাস্ত্রে তার ব্যুৎপত্তি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অংক অনার্স নিয়ে পাশ করার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে চলে গেছেন। গণিত ও সঙ্গীত বিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেন সে সময় তার সহপাঠী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস। রায় সাহেব পরে জার্মান ইতালিতে সংগীত শিক্ষা লাভ করার পর বার্লিনেও সংগীত শিখতে যান। ১৯২৭ সালে সংগীত সমন্ধে বক্তব্য রাখার জন্য ইউরোপে পাড়ি দেন। ১৯২৮ এ পন্ডিচেরির শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে যান। ১৯৫০ পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। ১৯৫৯ এ পুনেতে হরি কৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে ৬ই জানুয়ারি এই হরি কৃষ্ণ মন্দিরে রায় সাহেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দিলীপ কুমার রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতের পাঠ্যসূচিতে "গীত সাগর" ও ₹সাঙ্গীতিকী₹   গ্রন্থ দুটি রচনা করে ছাত্রছাত্রীদের উপহার দিয়েছিলেন।
                        সম্মানীয় দিলীপ কুমার রায় সুরকার সঙ্গীতজ্ঞ ,সংগীতসমালোচক ,গীতরচয়িতা, সুরকার ও গায়ক ও সাহিত্যের নানা শাখায় অবাধ বিচরণ করে গেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী, রম্যাঁ রঁলা , ব্রার্টান্ড রাসেল ইত্যাদি বিখ্যাত মনীষীদের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। 
রায় সাহেবের "সাঙ্গীতিকী" (১৯৩৮) বইয়ের 'কীর্তন' প্রবন্ধটি আলোচনা করে প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর মর্যাদা যথেষ্ট আধুনিক। প্রবন্ধের প্রথমেই কীর্তন কি জাতীয় সংগীত সে বিষয়ে নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ সহ 'মহান নাট্য সংগীত' এ  বক্তব্য রেখেছিলেন। রায়ের মতে কীর্তন লোকসংগীত না হলেও কীর্তনের মতো লোকসংগীত এর আঙ্গিক ও গঠন পদ্ধতি বিচিত্র। তিনি কীর্তন এর প্রবর্তক বিভিন্ন শ্রেণীর কীর্তন কীর্তনের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করে কীর্তন যে বাঙালির "একমাত্র ক্লাসিক্যাল জাতীয় সংগীত" সেই সিদ্ধান্ত, দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায় প্রবন্ধের উপসংঘারে সুনিপুণভাবে জানিয়েছেন--
      "কীর্তনের রসিক হতে হলে চাইতে হবে সব আগে গভীর হৃদয়াবেগের দাম দিতে শেখা, ভাগবত প্রেমের উদাসী হাওয়া, ভক্তির সাধনাকে বরণ করতে চাওয়া। এ সাধনার আলো অন্তরাত্মায় পড়লে সংশয়গ্রন্থি ভিন্ন হবে,মনে প্রত্যয় জাগবেই যে, প্রেমের দিশারি করে যে সংগীত-  অচিনের অভিসারে চলে কোনো একান্ত অধিক-ঐহিক এস্থেটিক অণুবীক্ষণ দিয়ে তার রসঘন আত্মার নাগাল মেলে না "!
সুরকার দিলীপ কুমার রায়ের প্রবন্ধে প্রকৃষ্ট বন্ধনই মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রসঙ্গান্তরে  গিয়ে প্রসঙ্গকে বলিষ্ঠ করার টেকনিক রসবোধ  ও যুক্তি নিষ্ঠা ভাবনা। দৃষ্টান্ত --
    কীর্তনের লোকপ্রিয়তা যে কীর্তনের বৈশিষ্ট্যর জন্য নয় তা বোঝাতে জানিয়েছেন স্বয়ং প্রাবন্ধিক-- 
   "কীর্তন অধিকাংশ স্থলেই পপুলার হয় তার ছোট আবেদনটুকুরই জন্যে,তার মাতামাতি, ঝাঁপাঝাঁপি হৈ হৈ  রৈ রৈ এর  জন্য"।
🍂

দিলীপ কুমার রায় কীর্তনের প্রসঙ্গান্তরে  গিয়ে মূল বক্তব্যকে ঋদ্ধ করার রীতিতে --
      "যা বলেছিলাম, কীর্তন কে পপুলার বলেই বলা হয় প্রায়ই:  দেখো এত লোকের ভালো লাগলো, কাজেই এ বড়ো, যা সবাইয়ের ভালো লাগে তাই তো মহৎ-- টলস্টয়ও বলেছেন ইত্যাদি"।
রায় সাহেব কীর্তনের গভীর রসবোধের কথাও তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। এই রসবোধ নিয়ে রায়ের সরস মন্তব্য প্রণধানযোগ্য---
      " কিন্তু এ কথায় 'সবাইয়ের' মনে এ  ডিমক্রাসির যুগে আত্মগৌরবের হিল্লোল বইলেও ডিমক্রাসির সস্তা নৌকা যে আজ বানচাল হবার জো হয়েছে একথা সব চিন্তাশীল মানুষই স্বীকার করেছেন"।
সংগীত সমালোচক দিলীপ কুমার রায়  পঞ্চাশটি গানের কথা লিখেছেন। স্বরলিপি সহ গানের চারটি খন্ড প্রকাশ করেছেন। ইংরেজি ভাষাতে একুশটি। বাংলায়ও প্রচুর স্বরলিপি লিখে গেছেন। উপন্যাস, কবিতা , নাটক, চিঠিপত্র, স্মৃতিচারণা সর্বোপরি প্রবন্ধ যথেষ্ট পরিমাণে লিখেছেন।
সাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় ও তার কীর্তন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য পরিষ্কার প্রণিধানযোগ্য---
     "বাংলাদেশে কীর্তন গানের উৎপত্তির আদিতে আছে একটি অত্যন্ত সত্যমূলক গভীর এবং দূরব্যাপী হৃদয়াবেগ"- কে প্রাবন্ধিক বলেছেন 'কীর্তন সম্বন্ধে এ হলো লাখ কথার এক কথা' সুতরাং পান্ডিত্য, মনীষা ও প্রকাশের সাবলীলতা প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধ গুলিকে দিয়েছে স্বতন্ত্র।
বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় ট্রিপোসের জন্য
কেমব্রিজ যান পাশ্চাত্য সংগীত বিদ্যায় পাশ করেন। এতসবের জন্য "সংগীত নাটক একাডেমী_ ফেলসিপ দেওয়া হয়। রায় বাবু ১৯২৮ সালে সামাজিক দায়দায়িত্ব মাথায় নিয়ে, মানসিক প্রশান্তির জন্য, সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন! আমৃত্যু সন্ন্যাস জীবন যাপন করে গেছেন। দিলীপ কুমার রায়ের সংগীত সাহিত্য অসামান্য অবদানের জন্য বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হয়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।।
 ‌

Post a Comment

0 Comments