জ্বলদর্চি

রিঙ্কু চক্রবর্তী (প্রকাশক, সমাজসেবক, মেদিনীপুর)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭০
রিঙ্কু চক্রবর্তী (প্রকাশক, সমাজসেবক, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

তখন বয়স মাত্র এগারো বছর। একরত্তি ছেলেটা তখনও জেনে ওঠেনি জীবনের অর্থ। গোঁফের রেখাটাও চামড়ার গভীরে। মাথায় ভেঙে পড়ল বাজ। জীবনের অন্যতম ছাতাটা একটা দমকা হাওয়ায় উড়ে গেল দূরে, সুদূরে। কমল চক্রবর্তী হার মানলেন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার অসম লড়াইতে। পিতৃহারা হলেন ঐ বালক রিঙ্কু চক্রবর্তী।

কমল চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর বাবা। তিনি ছিলেন একটি দোকানের সামান্য বেতনের কর্মচারী। সেই উপার্জিত অর্থেই চলত সংসার। পরিবারের মুখে কোনও রকমে তুলে দিতেন ক্ষুন্নিবৃত্তির আহার। 
বাবার মৃত্যু ছোট্ট রিঙ্কুর জীবনে নিয়ে এলো বিভীষিকা। অথৈ জলে স্নান করার পরিবেশ তৈরি হল চোখের সামনে। চারিদিকে নেমে এলো অমানিশা। তখন জীবনের পরতে পরতে নেমে এলো এক গভীর সংকট। ঠিক সেই সময় তিনি নয়াগ্রামের নছিপুর আদিবাসী হাইস্কুলের ছাত্র হিসেবে পাঠরত। 

রিঙ্কু চক্রবর্তীর মায়ের তখন হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। পরের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ নিলেন। এই করেই কোনোওরকমে সংসার চালানোর আপ্রাণ চেষ্টা। লবেজান অবস্থা। কষ্টসাধ্য দিন গুজরান। কিন্তু এই সামান্য অর্থে এই বিশাল গুরু দায়ভার কি সামলানো যায়? তাই স্কুলে পাঠরত ছেলের পড়াশুনার ব্যয়ভার বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। হার মানতে হয়েছিল সেসময়। কিন্তু ঐ ছোট্ট পড়ুয়ার অদম্য ইচ্ছে ছিল পড়াশোনার। সেসময় হোস্টেল জীবনে থাকাকালীন শিক্ষকদের কাছ থেকে পেলেন প্রভূত সাহায্য। সেইসাথে হোস্টেলের বন্ধুদের থেকেও মিললো প্রচুর ভালোবাসা ও সাহায্য। সেই হোস্টেলে থেকেই দ্বাদশ শ্রেণির পড়া সম্পন্ন করলেন অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। অনেক লড়াইয়ের সাক্ষী থেকে। 
চোখে তখন লালায়িত স্বপ্ন। আরও পড়াশোনা করে আরও বড় হতে হবে। নছিপুর হাইস্কুলের স্মৃতিগুলো ফেলে রেখে সটান মেদিনীপুর কলেজ যাত্রা। ভর্তি হলেন সাম্মানিক ইতিহাস বিষয়ে। তখন কাকারা বারবার বারণ করেছিল। কিন্তু তিনি শোনেননি। তাঁদের বারণ সত্ত্বেও মেদিনীপুর কলেজে জোরপূর্বক ভর্তি হলেন। এককথায় তাঁদের উপেক্ষা করেই। 

আসলে তখন দরকার ছিল টাকা। উপার্জন করতে হবে। মেদিনীপুর কলেজে পড়াশুনা চলাকালীন সেই কাকারা দৈনিক মাত্র ১৭ টাকা বেতনের কাজে ঢুকিয়ে দিলেন তাঁকে। এজন্য চলে যেতে হয় কলকাতায়। জীবিকা অর্জনের জন্য তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় ফের এক অসম লড়াইতে। একজন খালাসির কাজ যেরকম, ঠিক সেরকমই ছিল কিশোর রিঙ্কুর কাজ। কলকাতার বুকে খালাসির ন্যায় কাজ করতে করতে সেখান থেকেই মেদিনীপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করলেন। গ্র্যাজুয়েট হলেন। একটা কঠিন লড়াইয়ের ময়দানে নেমে প্রাথমিক যুদ্ধ জিতলেন নিজের মনের জোর আর গভীর ইচ্ছাশক্তিকে পাথেয় করে। পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীও অর্জন করে ফেলেন নিজের নামে।

কলকাতায় ছিলেন তিন বছর। সেখানে খালাসিসুলভ কাজের পর ফিরে এলেন বাড়িতে। এরপর মেদিনীপুরের বুকে বিভিন্ন দোকানে কাজের জন্য লেগে পড়লেন। শুরু হলো আরেকটা লড়াই। এবার লড়াই ভবিষ্যৎ পথটাকে মসৃন করার লড়াই। এবড়োখেবড়ো, ভাঙাচোরা জীবনের অলিগলিতে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে পথচলার লড়াই। এ লড়াই তাঁকে জিততেই হবে। 

ঠিক যেমন আঁধারমাখা রাত পেরিয়ে ভোরের আলো বেরিয়ে আসে, ঠিক তেমনই রিঙ্কু চক্রবর্তীর আঁধারিয়া জীবনের রূপ রস গন্ধ যেন প্রস্ফুটিত হওয়ার ইঙ্গিত দিল ১৯৯৯ সালে। যেন একটা পরশপাথর খুঁজে পেলেন অবশেষে। অনেক ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করে একসময় তিনি 'তপতী পাবলিশার্স' নামে একটা প্রকাশনা কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করলেন। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লো তাঁর জীবনে। খালাসির কষ্টগুলো তখন অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদে অদৃশ্যভাবে থেকে পালটে দিতে থাকলো পথচলার সুখ। পথচলার আনন্দ। জীবনের আনন্দ। 
আর এভাবেই চলতে চলতে চলতি ২০২৩ সাল তাঁর ব্যবসায়িক জীবনের ২৫ বছর পূর্ণ করল নিরবচ্ছিন্নভাবে। গত ২৫ বছরে ৫০০ র বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে তপতী পাবলিশার্সের হাত ধরে। পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য বেকার ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়েছেন তিনি। প্রত্যন্ত মেদিনীপুরের যে ছেলেটা একসময় অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যে পড়ালেখা করেছে নীরবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে, সেই ছেলেটা আজ পশ্চিমবঙ্গের একরাশ বেকার ছেলে মেয়ের চোখের লোনা জল মুছে দিতে পেরেছে "রুমাল" রূপি 'বই' উপহার দিয়ে। 

তপতী পাবলিশার্সের পথচলা শুরু হয় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ বছরের অনার্সের প্রশ্নপত্রের সেট প্রকাশ করে। ভালোই বিক্রি হয় সেসময়। তারপর সংস্কৃত অনার্সের বই ছাত্র ছাত্রীদের জন্য প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরেই শুরু হল পথচলা। এরপর ড. মৌসম মজুমদারের লেখা গ্র্যাজুয়েট লেভেলের ভূগোল বই প্রকাশ করলো তপতী পাবলিশার্স। তখনও লড়াই চলছে পাঠক সমাজে পরিচিত হওয়ার জন্য। পড়ুয়া পাঠকদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য। 

এরপরেই ২০০৩ সালে ড. মৌসম মজুমদার লিখিত জেনারেল নলেজ এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশ করে তপতী পাবলিশার্স। এস এস সি পরীক্ষার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য তা ছিল অন্যতম সহায়ক পুস্তক। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ব্যপক বিক্রি হয় তা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পানসি নৌকার মতো তীর বেগে ছুটতে থাকলো রিঙ্কু চক্রবর্তীর স্বপ্ন। এর মধ্যেই কমপিটিটিভ পরীক্ষার বইয়ের জগতে অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে সাবলীলভাবেই। এরপর ২০০৬ তে ফের ধামাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরির পরীক্ষার সহায়ক পুস্তক প্রকাশিত হল ড. মৌসম মজুমদারের সম্পাদনায়। সারা পশ্চিমবঙ্গে বিক্রি হল তা ছয় লক্ষের বেশি কপি। যা এখনও পর্যন্ত এই প্রকাশনারনার ক্ষেত্রে রেকর্ড। যাবতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা যেমন ব্যাঙ্ক, রেল, অঙ্গনওয়াড়ি, টেট, এস এস সি, পি এস সি, ইউ পি এস সি, ডাবলু বি সি এস, ফরেষ্ট, আই সি ডি এস, পুলিশ রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদির গাইড বই এখন ছাত্রছাত্রীদের উপহার দিতে পেরেছেন রিঙ্কু চক্রবর্তী। 

এই মুহূর্তে বাংলা এবং ইংরেজি দুই ধরনের বই প্রকাশ শুরু করেছেন। ইংরেজি ভার্সানের বই প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর অ্যাডভিকন পাবলিশিং হাউস নামে প্রকাশনা সংস্থার ব্যানারে। আজ তিনি মেদিনীপুরের বুকে বসে কলকাতার নামজাদা প্রকাশনা সংস্থার সাথে টেক্কা দিতে পেরেছেন লড়াই করে। এই মুহূর্তে পাঁচশোর বেশি বই তিনি প্রকাশ করে ফেলেছেন মেদিনীপুর থেকেই। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের বইও তাঁর ঝুলিতে রয়েছে। নামজাদা লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, রতনতনু ঘাটি, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, ড. সন্তোষ ঘোড়াইদের লেখা বই তিনি প্রকাশ করেছেন। সেইসাথে জেলার বহু লেখকের নানা ধরনের বই তপতী পাবলিশার্স প্রকাশ করে চলেছে জেলার লেখকদের তুলে ধরতে। 

মেদিনীপুরের এহেন মানুষ রতনটি নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বই প্রকাশনা ও সমাজসেবার কৃতিত্বের জন্য ৩০ টিরও বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। ইতিমধ্যে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে পেয়েছেন THE REAL SUPER HERO AWARDS 2023, TOP 100 INFLUENTIAL INDIANS AWARD, STAR ICON AWARD, INTERNATIONAL BUSINESS AWARD, ASIAN EXCELLENCE AWARDS 2022, BEST PUBLISHERS AWARDS of 2022, INDIAN FABO AWARD, INSIGHT SUCCESS THE MOST INFLUENTIAL BUSINESS LEADERS 2022, INDIA PROUD AWARD 2022 (BEST PUBLISHERS AWARD), A P J ABDUL KALAM EMPOWERMENT AWARD 2022, IGI INDIAN ICON AWARD 2022, BHATATIYA RATNA AWARD (Oasis World Record), BEST BOOK PUBLISHER AWARD (A P J Abdul Kalam Award), ASIAN EXCELLENCE AWARD,  100 POWERFUL PERSONALITIES AWARD, ICONS OF ASIA AWARD, INTERNATIONAL SOCIAL HONOURABLE AWARD (World Charity Welfare Foundation) এবং National Book of Records 2023 থেকে পেয়েছেন APPRECIATION CERTIFICATE. এছাড়া তাঁর প্রাণপ্রিয় তপতী পাবলিশার্স পেয়েছে STUDENTS CHOICE AWARD (For Tapati Publishers), 1 BEST SELLER IN WEST BENGAL EDUCATION BOARD (For Tapati Publishers) এবং ENGAGEMENT GURU AWARD (For Tapati Publishers)। 

সমাজসেবা মূলক কাজের সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বহু দুস্থ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের পাশে তিনি নিয়মিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অবলীলায়। গরিব মানুষের চিকিৎসা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি পাশে থাকার চেষ্টা করেন। এই মুহূর্তে ১৩২ জন দুঃস্থ ছাত্র ছাত্রীর পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ৫ জন বিবাহযোগ্যা মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব হাসিমুখে নিয়েছেন মেদিনীপুরের গর্ব এই মানুষটি। জটিল রোগে আক্রান্ত ১৬ জন দুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে বহুবিধ সামাজিক কাজে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। 
সমাজসেবা মূলক কাজের জন্য পরিচিত জেলার অন্যতম একটি সংগঠন "মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি"র তিনি সভাপতি পদে আসীন। আজ জেলা জুড়ে এবং জেলার বাইরে তাঁদের কর্মকাণ্ড বহুল প্রচারিত। শুধুমাত্র সামাজিক কাজের জন্য Global Human Rights Trust (International Organization) থেকে রিঙ্কু চক্রবর্তী পেয়েছেন HONORARY DOCTORATE সম্মান (২০২২)। এছাড়াও গত ২০২২ এর ১৪ ই নভেম্বর COMMONWEALTH VOCATIONAL UNIVERSITY (Kingdom of Tonga) থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে Doctor of Philosophy Award তাঁর  Business Management এর প্রভূত সাফল্যের জন্য।

১৯৭৪ এর ১৫ ই সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর শহরে তাঁর জন্ম। সেই হিসেবে পঞ্চাশে পা দিতে চলেছেন। তিনি চান নিজের ছাত্রজীবনে যত ধরনের বাধার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল আর্থিক প্রতিবন্ধকতার জন্য, সেই সমস্যায় যেন কোনো ছেলে বা মেয়ে না পড়েন। চেষ্টা করেন এইভাবে তাঁদের পাশে যথাসম্ভব থাকতে। আসলে তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের পাশে থেকে সেবা করাই প্রকৃত দেশসেবা, জনসেবা তথা সমাজসেবা।
🍂

Post a Comment

0 Comments