জ্বলদর্চি

তাপস মাইতি (পত্রিকা সম্পাদক, কবি, গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, মেদিনীপুর)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭২
তাপস মাইতি (পত্রিকা সম্পাদক, কবি, গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

ইতিমধ্যে তাঁর সম্পাদনায় মেদিনীপুরের ১৪০০ গ্রামের কথা প্রকাশিত হয়েছে। জেলার ১২২ জন বিভিন্ন পেশার মানুষকে যুক্ত করতে পেরেছেন। কৃষক, শিক্ষক, গৃহবধূ, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, উপাচার্য, ডাক্তার, ছাত্র, গবেষক, ব্যবসায়ী, পত্রিকা সম্পাদক, উকিল পেশার লোকজন লিখেছেন নানা গ্রামের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। সেই ২০০৬ এর ১৬ ই জুলাই প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। খুব শিগগিরই এইসব গ্রাম নিয়ে ১৬ তম খণ্ড প্রকাশিত হতে চলেছে। ইউ জি সি যেটা নিয়ে কখনো ভাবেনি, সেটা ভেবেছিলেন তাপস মাইতি। তার বাস্তব রূপায়ণ করে দেখিয়ে চলেছেন। এহেন মহাকলেবর সমৃদ্ধ গ্রাম বিবরণী ছাপিয়ে বের করার লাগাতর দুঃসাহস দেখিয়ে চলেছেন 'মেদিনীপুরের গ্রামের কথা'র সম্পাদক তাপস মাইতি। মেদিনীপুরকে ভালোবেসে মেদিনীপুরের গ্রাম গ্রামান্তরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস তুলে আনা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। যা কিনা গ্রামচর্চার পথে এক অপ্রতিরোধ্য মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। 

তাপস মাইতি নামটি মেদিনীপুরের সাহিত্য সংস্কৃতি ও গবেষক মহলে নিত্য উচ্চারিত নাম। মেদিনীপুরকে ভালোবেসে মেদিনীপুরের রূপ রস গন্ধ পাঠকসমাজে তুলে ধরার ব্রত নিয়েছেন তিনি। ১৯৫৬ এর ১৯ শে নভেম্বর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরীর ধজিভাঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন অবিনাশ মাইতি এবং মা শতদলবাসিনী দেবী। হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন থেকে পড়ার পর তমলুক কলেজে বায়ো সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েট হন ১৯৭৮ এ। এরপর সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা অর্জন। ১৯৭৮-৭৯ নাগাদ তল্লা এলাকায় তাঁর ঘরবাড়ি ভেঙে দেয় সিপিআইএম এর লোকেরা। চলে আসেন মেদিনীপুর। শুরু করেন পত্রিকা প্রকাশ। আর থেমে থাকেনি তাঁর কলমের মুখ। এখনও সাবলীল তাঁর মননশীল কলম। আর উদজীবিত হয়ে চলেছে মেদিনীপুরের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য এবং সংবাদ।

১৯৭৯-৮০ সালে তিনি শুরু করেন মেদিনীপুরের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র 'দৈনিক দেশকাল'! এই 'দৈনিক দেশকাল' অবশ্য ১০০ টি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়। তখন এতে লিখতেন মহাশ্বেতা দেবী, মৃত্যুঞ্জয় মাইতি, রতনতনু ঘাঁটি, শ্যামলকান্তি দাস প্রমুখ। ১৯৮৭ র ২৩ শে জানুয়ারি থেকে প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক 'উপত্যকা'। যা আজও বহাল তবিয়তে পাঠক সমীহ আদায় করে চলেছে। তবে 'উপত্যকা' প্রথমে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে হেঁড়িয়া থেকে। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে। অবশেষে 'দৈনিক উপত্যকা'। যা আজও চলছে সাবলীলভাবে। সামনের শারদোৎসবে দৈনিক 'উপত্যকা' পত্রিকার ৪৩ তম শারদীয়া সংখ্যা বেরোচ্ছে। এতোগুলো বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশ করে যাওয়া তো মুখের কথা নয়। দম লাগে। সে দম রয়েছে তাপস মাইতির কব্জিতে। 

তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে শহর মেদিনীপুরের কথা, মেদিনীপুরের নদ নদী কথা, মেদিনীপুরের ধর্ম কথা, তাম্রলিপ্তের কথা, জঙ্গলমহল কথা, হারিয়ে যাওয়া গ্রাম, মেদিনীপুরের দুর্গাপূজা ১ এবং ২, মেদিনীপুরের কবি ও কবিতা ১ এবং ২, মেদিনীপুরের গল্প (মেদিনীপুরের লেখক ও মেদিনীপুর কেন্দ্রীক গল্প সমৃদ্ধ), পর্যটনে মেদিনীপুর, ছড়ায় ছড়ায় মেদিনীপুর ইত্যাদি। এগুলি আজ বোদ্ধামহলে চির প্রশংসিত। তাঁর লেখা প্রবন্ধের বই 'বোধিবৃক্ষের পাতা'তে রয়েছে অখণ্ড মেদিনীপুরের সংবাদপত্রের ইতিহাস। খুব শিগগিরই আলোর মুখ দেখতে চলেছে তাঁর সম্পাদিত 'রহস্যাবৃত মেদিনীপুর'! প্রতিটি কাজে মেদিনীপুর চলে আসে অবধারিতভাবে। অনন্ত ভালোবাসা ছাড়া এটা সম্ভব হয় না। 

জঙ্গলমহলের নেতাইয়ের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন কাব্যগ্রন্থ 'নেতাইয়ের নোটবুক'। এই কবিতার বই প্রতিটি সভায় নেতারা পাঠ করতো। কবি হিসেবে যা এক অসামান্য পাওয়া। প্রায় ৫০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল এটি। নন্দীগ্রাম, লালগড় আন্দোলন নিয়ে তাপস মাইতির লেখা 'বৈশাখে বৃষ্টিতে' কাব্যগ্রন্থের ৮ টি কবিতা দিল্লির এক প্রকাশনীর The Fuming Forest এ স্থান পেয়েছে। ১৭ তম মেদিনীপুর কবিতা উৎসবে জেলার কবিদের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে তিনটি ভাষায় 'ত্রিমাত্রিক' কবিতার বই। ইতিমধ্যে ৭ টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, তেলুগু, উর্দু, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া এবং অসমিয়া ভাষায় অনূদিত হয় তা। এছাড়াও 'দ্বিমাত্রিক' নামে দু ভাষায় কবিতার বইয়ের ৪ টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। 
প্রথম প্রেমিকা রীনা মাইতি। তাঁকে সামনে রেখেই তাঁর কবিতার পথচলা। কবিতার আবেশে নিজেকে আবিষ্ট করেছেন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থে। তাপস মাইতির অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে বন্দীত্বে আমি এবং অন্যান্য (১৯৮০), সময় ও অসময়  (১৯৮৫), বৈশাখে বৃষ্টিতে (২০০৬), মিশর নীলনদ ও নারী (২০০৮), সময়ের সংলাপ (২০১০), এবং রবীন্দ্রনাথ (২০১১), নেতাইয়ের নোটবুক (২০১১), জঙ্গলমহলের চিঠি (২০১৫), মৃত্যু এক পদাবলী (২০১৫), ঐতিহ্যের উচ্চারণ (২০১৫), পথের ধারে কুরচি (২০২২), বাউল তুই (২০২৩) ইত্যাদি। লিখেছেন অসংখ্য নাটক। একেই বলে ভাগ্য, বিষাক্ত মৌচাক অশান্ত পিপাসা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। 'পথের ধারে কুরচি' কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তনুশ্রী ভট্টাচার্য। 

কলেজে পড়ার সময়েই ১৯৭৪-৭৫ সালে 'ভারতী রেকর্ডস' থেকে রিলিজ হয় তাঁর লেখা দেহতত্বের গান 'একদিন উড়বে সাধের ময়না'। গেয়েছিলেন সনৎ সিংহ। এছাড়াও প্রকাশিত হয় প্রথম নাটকের বই 'একেই বলে ভাগ্য'। এ পর্যন্ত ১০০ খানা গান লিখেছেন। তাঁর লেখা গানে কন্ঠ দিয়েছেন সনৎ সিংহ, মৌসুমী মোহান্তি, তাপস মান্না, গৌতম ভকত, ঝুমঝুমি চক্রবর্তী, সমীর মোহান্তি, প্রশান্ত মাইতি প্রমুখ সঙ্গীতশিল্পীরা। গত লোকসভা ভোটে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনের উদ্যোগে যে থিম সঙ হয়েছিল, তা লিখেছেন তিনিই। 

সিনেমা পরিচালনাতেও সিদ্ধহস্ত। মোট ৭ টি সিনেমার পরিচালক তিনি। বিদ্রোহিনী নারী শিরোমণি, আগুনঝরা তিন বছর, ময়নানগর ময়নাগড়, ব্যাবধান, লক ডাউন প্রেম, দূরত্ব এবং মোহনায় ময়নাগড় তাঁর পরিচালিত নানা ধরনের সিনেমা। সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালতে দেখানো হয়েছে 'আগুনঝরা তিন বছর' সিনেমাটি। পরপর তিন বছর মেদিনীপুরের তিন জেলাশাসককে হত্যার ঘটনা নিয়ে এই সিনেমার কাহিনী। রাণী শিরোমণিকে নিয়ে প্রথম সিনেমা বানানোর ধৃষ্টতা তিনিই দেখিয়েছেন। 

তাঁর নিরলস কাজের জন্য পেয়েছেন নানা সম্মান। ঝাড়গ্রাম জেলা গঠনের দিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে সাংবাদিকতার জন্য পেয়েছেন বিশেষ সম্মান। ২০১৮ তে বাংলাদেশের কত্থক সাহিত্য পুরস্কার, মালীবুড়ো পুরস্কার, আই সোসাইটি সম্মান ফিল্ম সোসাইটি সম্মান, ওড়িশার বালেশ্বরের লেখক সম্মান তাঁর শিরোপায় রয়েছে। অনেকেই নানাভাবে পেছনে লাগার চেষ্টা করলেও দমাতে পারেনি তাঁকে। লক্ষ্যে অবিচল থেকে মেদিনীপুরকে লাইমলাইটে তুলে আনতে বদ্ধপরিকর মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটি। তাঁর সম্পাদিত প্রতিটি বইতে লেখক হিসেবে মেদিনীপুর জেলার মানুষকেই বাছেন। অন্যদের নয়। এটাই তাঁর অহঙ্কার।
🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার ঐতিহ্য তুলে ধরার কাজে নিবেদিত প্রাণ এক গুণী মানুষ 🙏🏻

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ🙏💕

    ReplyDelete