সবুজ দ্বীপ আন্দামান
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
বিংশতি পর্ব
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
জারোয়াদের বিভিন্ন হস্তশিল্প -
যে সমস্ত হস্তশিল্পগুলি জারোয়ারা মেহনত করে তৈরী করে তার সমস্ত উপকরণ তাদের অরণ্য থেকে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রকম গাছের ডাল ও পাতা থেকে এবং লোহা, পাথর ও সমুদ্রের কড়ি থেকে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরী করে। যে সমস্ত অরণ্য সম্পদ তারা ব্যবহার করে তাদের স্থানীয় নাম ও ব্যবহার প্রণালী নিচে উল্লেখ করলাম।
ধানিপাতি ও সেলাইপাতি - কুটীরের আচ্ছাদনের জন্য এই গাছের পাতা ব্যবহার করে। থাঙ্কোবাজেটা - জঙ্গলে মৌমাছির চাক ভাঙ্গার সময়ে মৌমাছি তাড়ানোর জন্য এই গাছের পাতা ব্যাবহার করে। জংলী হলদি - এই গাছের লতা ও পাতার রস মেখে জারোয়ারা মৌচাক পেড়ে আনে। নেওয়া - এই গাছের রস মেখে ও সরু কান্ড দিয়ে জারোয়ারা মৌমাছি তাড়ায়। মাকচুন - জারোয়া নারীরা ঋতুমতী হওয়ার সময় এই গাছের পাতা ব্যাবহার করে। বাঁশ- তীরের দণ্ড তৈরী করে। ছিলোকা - এই গাছের ছাল জারোয়াদের শিকারের বর্ম ও দড়ি বানাতে লাগে। এছাড়াও লালবম্বে নামে এক প্রকার গাছের ছাল দিয়েও বর্ম বানায়। মোটা, পেনসিল ও জংলী বেত - কুটির তৈরী করার জন্য ব্যাবহার করে। কদম ও ঝিঙ্গাম - গাছের কান্ড দিয়ে মধু রাখার পাত্র বানায়। গর্জন - গাছের ডাল-পালা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। লম্বাপাতি - এই গাছের পাতা শুকর মাংস সিদ্ধ করতে ব্যাবহার করে। টুংকাপো - এই গাছের লতা দিয়ে গাঁড় মারা ধনুকের দড়ি তৈরি করে এবং চুঁই কাঠ দিয়ে ধনুক বানায়।
জারোয়া মহিলারা বেত গাছের ডাল ও লতা দিয়ে ঝুড়ি তৈরী করে। জারোয়া পুরুষেরা লোহাকে পিটিয়ে তীরের ফলা বানায়। যখন লোহার প্রচলন ছিল না তখন তারা জংলী সুপারি গাছের শক্ত ও পুরু ছাল দিয়ে তীরের ফলা বানিয়ে তীরের সাথে ছিলোকা গাছের ছাল থেকে তৈরি দড়ি দিয়ে মজবুত করে বাঁধত। এই সুপারি গাছের ছালের তীর লোহার তীরের মত সমান উপযোগী। এছাড়াও সমুদ্রের কড়ি ও পাথর থেকে তারা তীরের ফলা বানাত। সমুদ্র থেকে পাওয়া বড় কড়ি থেকে ছুরির ব্যবহার আজও আছে যেগুলি লোহার ছুরির মতো ধারালো। প্রস্তর যুগে পড়ে থাকা আদিম মানুষদের একদিনের ভরসা ছিল এই সমস্ত কড়ি ও পাথরের অস্ত্র।বহু যুগ পরে লোহার তীরের ফলা তারা ব্যাবহার করতে শুরু করে।সমুদ্রের জলে ভেসে আসা ভগ্ন জাহাজের লোহা থেকে তারা তীরের ফলা বানানো শুরু করে। ১৯৭৪ সাল থেকে আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসনের জনজাতি বিভাগ থেকে তাদের লোহার রড উপহার সামগ্রী হিসেবে দিতে থাকে সেই রডকে পিটিয়ে তারা তীরের ফলা ও ছুরি বানায়। লোহাকে গরম করে বার না করেও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তারা এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বানায় এবং লোহা কাটতে ছেনি ও হাতুড়ির ব্যবহার করে। সমুদ্রতটের পাথরে বারবার ধার দিয়ে তীরের ফলা ও ছুরি গুলিকে ধারালো করে তোলে। জল রাখার পাত্র বাঁশের চোঙ দিয়ে বানায়। আজকাল সমুদ্রে ভেসে আসা প্লাস্টিকের বোতলেও জল রাখে। মধু রাখার পাত্রকে তারা 'উহু' বলে। ঝিঙ্গাম ও কদম গাছের বড় কান্ড থেকে একদিক আস্ত রেখে অপর দিক থেকে কাঠকে কুরে কুরে ফেলে দিয়ে ঠিক একটা ডেকচির আকার নিয়ে আসে। এই পাত্রে মধুর চাক আস্ত রাখা যায়। শিকারের বর্ম (কেকার্ড), মধু রাখার পাত্র, তীরের দন্ড প্রভৃতিকে লাল লতার রস অথবা শূকরের রক্ত দিয়ে বিভিন্ন নকশা করে তারা সাজিয়ে রাখে। জারোয়ারা মাটির বাসন তৈরি করতে জানেনা। গ্রেট আন্দামানিজদের মধ্যে অবশ্য অতীতে মাটির বাসনের ব্যবহার ছিল। বর্তমানে প্রশাসনের দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিগুলি ও লোকালয়ের থেকে চুরি করে আনা থালা-বাসন তারা অনেকেই ব্যাবহার করে।
আদিম মানুষদের প্রথাগত চিকিৎসা বিদ্যা -
আজ পর্যন্ত নেগ্রিটো জারোয়াদের প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির অল্পই আবিষ্কার করা গেছে। তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই বেশি। ভয়াবহ হেপাটাইটিস- বি ভাইরাস যদিও তাদের মধ্যে প্রতি দুজনের এক জনের শরীরে পজিটিভ তথাপি তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। এই তথ্য বিস্ময়কর। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন অংশ, হাত বা পায়ের হাড় ভেঙে গেলে তারা উপযুক্ত সাইজের কাঠের তক্তা বা বাঁশের পাতি ভাঙ্গা অংশের উপরে লতা দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেয়। কোন জায়গায় ক্ষত হলে বিভিন্ন লতা পাতার রস লাগিয়ে বন্ধ করে। যদি বিষাক্ত হয়ে জীবন সংশয় হবার উপক্রম হয় তাহলে ধারালো ছুরি বা দা দিয়ে সেই অংশটা কেটে তারা লতা পাতার রস দিয়ে বেঁধে দেয়। ভঙ্গুর লাল পাথুরে মাটিকে পুড়িয়ে তারা এক রকমের পাউডার বানায়। তার সাথে বন্য শূকরের চর্বির তেল মিশিয়ে জারোয়া ভাষায় 'আলাম' নামে একপ্রকারের বেদনানাশক পেস্ট বানায়। শরীরের কোন অংশে ব্যথা অনুভব করলে সেখানে এই আলাম লাগিয়ে তারা প্রলেপ দেয়। উদরাময় রোগ হলে দেখা গেছে তারা সমুদ্রতট এলাকায় প্রাপ্ত হালকা বাদামী রঙের একরকম মাটিকে শুকনো করে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। সর্দি বা কাশি হলে জারোয়ারা জঙ্গলে প্রাপ্ত 'এনতাও' লতার কাণ্ডকে চিবিয়ে তার রস খায় এবং জঙ্গলে প্রাপ্ত মধু ব্যবহার করে। এছাড়াও বার্ধক্যজনিত অবসন্নতা এবং জড়তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা মধু খেয়ে থাকে। পেটে ব্যথা হলে লতা পাতা সহ ছোট ডাল দিয়ে বারবার রোগীর পেটে ঝাপটা মারে। কারো মাথা বা শরীরের কোন জায়গায় ব্যথা হলে তার নিকটজন পা দিয়ে সেই জায়গাটি ডলে দেয়। সন্তান প্রসবের পরে তলপেট, মাথা ও বুকের ব্যথা কমানোর জন্য অনেকগুলি লতা ব্যথার স্থানে শক্ত করে বেঁধে দেয়। সন্তান প্রসবের সময় তাদের মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের কোন রকম অবনতি হয় না। নবজাতক শিশুর নাভি সংক্রমণও দেখা যায় না। গর্ভবতী মহিলা বা সদ্য সন্তান প্রসবা মায়ের রক্তহীনতা রোগলক্ষন দেখা যায় না। সন্তানসম্ভবা নারীকে জারোয়া নারীরাই সন্তান প্রসব করায়। পুরুষেরাও সন্তান প্রসব দক্ষতার সঙ্গে করে। সদ্যপ্রসূত শিশুর নাভিরজ্জু পরিষ্কার ছুরি দিয়ে কাটার পরে নাভি রজ্জুতেই গিঁট বেঁধে দেয়। নাভি রজ্জু বাঁধতে কোন সূতোর ব্যবহার করেনা। কাটা নাভিরজ্জুর মুখ থেকে যে রক্তপাত হয় তাকে বন্ধ করার জন্য তারা 'অরো' নামক একপ্রকার লতার পাতা গরম করে তার রস বার বার নাভির মুখে লাগায় এবং তাতেই রক্তপাত থেমে যায়। এই 'অরো'কে আমাদের ভাষায় জংলি জায়ফল গাছ বলে। সদ্য সন্তান প্রসব করা মা আগুনের সামনে বসে থাকে এবং কিছুটা মধু খেয়ে তার ক্লান্তি দূর করে। জারোয়া মহিলারা ঋতুকালে কোথাও বসার আগে কিছু পরিষ্কার লতাপাতা সেখানে পেতে তার উপরে বসে। ঋতুস্রাব শুষে নেওয়ার জন্য জঙ্গলের এক প্রকারের লতা শুকনো অবস্থায় অথবা তাজা লতা যোনি মুখে বেঁধে রাখে এবং তাতেই ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। সন্তান প্রসবের পরেও একই পদ্ধতিতে তারা রক্তপাত বন্ধ করে। জারোয়া নারীরা সন্তান প্রসবের পরে বহুদিন পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ায়। নবজাতক পুরুষ শিশুর ফাইমোসিস জনিত সমস্যার সমাধান তারা এক বিশেষ পদ্ধতিতে করে। এক মাসের মধ্যে পুংলিঙ্গের অগ্রভাগের চামড়াকে জারোয়া বয়স্ক মহিলারা হাতের আঙ্গুলের পরিষ্কার নখ দিয়ে চিরে চামড়াকে পিছনে ঠেলে দেয়। খুব কম ক্ষেত্রেই প্রথাগত এই বিশেষ চিকিৎসায় ক্ষত জীবাণু দুষ্ট হয়। মশার কামড়ে হাত পা লাল হয়ে গেলে এবং অসম্ভব চুলকানি হলে জঙ্গল থেকে তারা 'তিদাংওয়ে' নামে এক প্রকার লতার রস লাগিয়ে নিলে সুস্থ হয়ে যায়। আদিম জনজাতি জারোয়াদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত ব্যাধি নেই কেবলমাত্র সংক্রমণ জনিত সমস্যায় মাঝেমাঝে পুষ্টির অভাব দেখা গেছে। জারোয়া পুরুষ বা নারীর মধ্যে কোন রকম যৌন রোগ নেই। তাদের মধ্যে কোন পুরুষ বা নারীর বহুমূত্র রোগ নেই এবং তাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক। জারোয়াদের মধ্যে নারী পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। বেশিরভাগ দম্পতি বেশী সন্তান কামনা করে এবং তাদের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার খুব কম। যার ফলে একটি আশার আলো, যেখানে অন্যান্য আদিম জনজাতিরা কালের স্রোতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বা হবার উপক্রম সেখানে জারোয়াদের জনসংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরবর্তী অংশ একবিংশতি পর্বে
0 Comments