জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান২২/ দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান                                  

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      
দ্বাবিংশতি পর্ব    

পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ   

অবৈধ সন্তানকে জারোয়া সমাজের গোষ্ঠীপতিরা কিছুতেই বেঁচে থাকতে দেয় না। পূজা অর্চনা বা দেবদেবীতে বিশ্বাস জারোয়াদের মধ্যে নেই, তবে তারা অশুভ শক্তিকে বিশ্বাস করে। কোন শিশু বা জারোয়া পুরুষ ও নারী বেশিদিন অসুস্থ অবস্থায় থাকলে তারা বিশ্বাস করে সেই অসুস্থ ব্যক্তির উপরে অশুভ শক্তি ভর করেছে। জারোয়াদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর আত্মা স্বর্গে চলে যায়। অসুস্থ অবস্থায় তারা বিশেষ প্রক্রিয়াযোগে শক্তি সঞ্চয় করে স্বর্গে যেয়ে পূর্ব পুরুষদের কাছে চিকিৎসা লাভ করে সুস্থ হয়। তাদের অভিজ্ঞতায় স্বর্গ বা 'পাঙনাং চাড্ডা' খুব ঠাণ্ডা জায়গা। তাদের বিশ্বাস তাদের শিকার করা পশু, কুসংস্কারের বলি নিষ্পাপ শিশুরা, তাদের অতীত পূর্বপুরুষেরা এবং সভ্য জগতের যেসব মানুষকে তারা অতীতে হত্যা করেছে সবাই সেই স্বর্গে নাকি মহা আনন্দে আছে। জারোয়া সমাজের বিভিন্ন সংস্কারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তাদের দলপতি। জারোয়া সমাজে শ্বশুর বা শাশুড়ি জামাইয়ের নাম উচ্চারণ করে না এবং জামাইও শ্বশুর শাশুড়ির নাম কখনো উচ্চারণ করে না। ভূমিকম্পের সময় তাদের ধারণা একটা বড় ভূত শক্ত দড়ি দিয়ে পৃথিবীকে টান দিয়ে দোলায়। তাদের আরো কুসংস্কার জঙ্গলের গোলফল গাছের পাতায় নির্মিত মাথার ব্যান্ড বা রিং পরে শিকারে গেলে শুকর শিকারে সাফল্য আসে। শিকার করা শুকরের মাথা কুটিরে টাঙ্গিয়ে রাখলে তাদের গা হাতের ব্যথা কমে যায়। কুটিরে যত বেশি শুকরের মাথা থাকে ততই তাদের শিকারের দক্ষতা ও সম্প্রদায়ের কাছে সম্মান বাড়ে।
🍂

ডাক্তার করের সঙ্গে আমার দুই ঘণ্টার মত আলাপ-আলোচনা উপরের সমস্ত তথ্য পেয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে আসার পূর্বে তার কাছে জারোয়াদের সামগ্রিক উন্নয়নের ব্যাপারে তার অভিমত জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন বর্তমানে জারোয়াদের সমস্যা ও কল্যাণের জন্য আন্দামান আদিম জনজাতি বিকাশ সমিতি ও ভারত সরকারের জারোয়া কল্যাণ দপ্তর সচেষ্ট। এছাড়াও সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে চিকিৎসার ব্যাপারে তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করা হয়। আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড অরণ্যবাসী জারোয়া ও সভ্য জগতের মানুষের মাঝে ব্যবধান ভেঙে দিয়েছে। প্রস্তরযুগীয় আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া এসেছে তবে সভ্য মানুষের সংস্পর্শে এসে কিছু অবাঞ্ছিত জিনিস তাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। যেমন আন্দামান ট্রাংক রোডে গাড়িগুলির পিছনে ধাওয়া করে খাবার বা জামাকাপড় চেয়ে নেওয়া। পরিশেষে তিনি বললেন মধ্য আন্দামানের কদমতলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র জারোয়াদের চিকিৎসার ব্যাপারে খুবই সজাগ ও সতর্ক। জারোয়াদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা প্রায় বন্ধ করতে পেরেছে। তাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে খুঁটি ও লতাপাতা দিয়ে 'জারোয়া ওয়ার্ড' যেখানে আধুনিক চিকিৎসার সমস্ত সুযোগ সুবিধা রয়েছে। ফলস্বরুপ জারোয়াদের জনসংখ্যা তিরিশ বছরের ব্যবধানে প্রায় আশি শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে অন্যান্য প্রস্তর যুগের মানুষেরা পৃথিবী থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আসার মুখে।
পরের দিন আমাদের ফেরার পালা। চোদ্দ দিন আন্দামানে কাটিয়ে এখানকার সুখস্মৃতি নিয়ে ফিরে চললাম। দুপুর সাড়ে বারোটায় আমাদের ফ্লাইট। বীর সাভারকার বিমানবন্দর থেকে আমাদের বিমান ছেড়ে ওপরে ওঠার পরে বিমানের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নীল সমুদ্রের বুকের উপরে সবুজ বনানীর আবছা ছবি। বিদায় আন্দামান। দেড় ঘন্টা পরে বিমান কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করল। এখান থেকে আমাদের গন্তব্য স্থল শহীদ মিনারের পাদদেশে বাস ডিপো। সেখান থেকে মেদিনীপুরের বাস ধরে সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার পীঠস্থান আমাদের বাড়ীতে। 
                                                               
সমাপ্ত

নাম - দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী।          
ঠিকানা- মাইকো লেন, ক্ষুদিরাম নগর, মেদিনীপুর-৭২১১০১।           
মোবাইল নম্বর- ৮৯১৮০২১৩১২।      

লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি- কর্মজীবনে ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের আধিকারিক ছিলেন। ২০১১ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ২০০২সালে ভারত সরকারের পরিচালনায় কৈলাস ও মানস সরোবর ঘুরে এসেছেন। বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও বই লেখায় নিয়োজিত।


Post a Comment

1 Comments

  1. 'সবুজ দ্বীপ আন্দামান' সিরিজ দারুন লাগলো।
    মাননীয় লেখককে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আশা করি পুরো লেখাটি বই আকারে বেরোবো। তার প্রথম ক্রেতা হবো আমি। এই আশায় রইলাম।

    ReplyDelete