সুমিত্রা ঘোষ
স্বামী-রাজচন্দ্র দাসের সুযোগ্য সহধর্মিণী রানি রাসমণির মধ্যে সত্ত্ব আর রজঃ গুণের অদ্ভুত এক মিশ্রন ঘটেছিল। রানি রাসমণি অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ ভক্তিপরায়ণা মহিলা ছিলেন। বরাবরই তিনি অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। বিবাহের পর অতিরিক্ত ভোগবিলাসের মধ্যে থেকেও তিনি নিজেকে ভোগ বিলাসমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। সামান্যতম ভোগ বিলাসিতা রানির মধ্যে ছিল না।
স্বামীর মৃত্যুর পর রানি সাধারণভাবে জীবন কাটাতে লাগলেন। সেকালের নিয়মানুসারে দানধ্যান করলেন স্বামীর মৃত্যুতে। যেমন ব্রাহ্মণ ভোজনের পর সেকালের নিয়মানুসারে তুলাদণ্ডে উঠে নিজের দেহের ওজনের পরিমাণে ৬০১৭ টাকা ব্রাহ্মণদের দান করলেন। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলেন রানি তাঁর অগাধ সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবেন না। তখনকার দিনে নামকরা ধনী ব্যক্তি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর রাজচন্দ্র দাসের বিশেষ বন্ধু ছিলেন এবং মাড় বাড়ির একজন হিতকারী বন্ধুও ছিলেন। তাই তাঁর মনে হয়েছিল রানির পক্ষে এত বড় জমিদারি চালানো কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। তিনি রানির কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি রানির জমিদারির ম্যানেজার হতে রাজী আছেন। বুদ্ধিমতী রানি ওই নামীদামী মানুষটিকে কোনভাবেই তুচ্ছ না করে জামাতা মথুরামোহনকে দিয়ে বলে পাঠালেন, আপনি প্রিন্স দ্বারকানাথ, আপনার মতো সম্মানিত ব্যক্তিকে আমার জমিদারির কাজে নিয়োগ করা আমার পক্ষে খুবই অশোভন হবে। যৎসামান্য বিষয় কর্ম আমি আমার জামাতাদের সাহায্যেই চালিয়ে নিতে পারব। তখনকার দিনে একজন মহিলার এরূপ আত্মবিশ্বাসের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। রানির মা এবং জ্যোতিষী ঠিকই বলেছিলেন, ওরে রানি, তুই সত্যিই রানি হবি।
🍂
স্বামীর মৃত্যুর পর রানি বিষয়কর্মে মন দিলেন। রোজ প্রাতে স্নান সমাপন করে গৃহদেবতা রঘুনাথ জিউকে প্রণাম করতেন। এরপর স্ফটিকের মালা হাতে জপ করতেন। গলায় তুলসীর মালা এবং একগাছি সরু সোনার হার- এই ছিল তাঁর অঙ্গভূষণ, কান-হাত আভরণশূন্য। সারাটা দিন বিষয়কর্ম, সামান্য বিশ্রাম, তারপর সন্ধ্যার পূজার্চনা, শাস্ত্র ব্যাখ্যা শোনা, পুরাণাদি পাঠ করা বা শোনা। পুরাণাদি ও কথকতা শোনা রানির ছেলেবেলাকার অভ্যাস ছিল, রাজরানি হয়েও সেই অভ্যাস ছাড়তে পারেননি বরং বৃদ্ধি হয়েছিল আবাল্য অভ্যাসের। বিষয়সম্পত্তির কাজকর্ম ছাড়াও পরিবারে পুত্রকন্যা আর পরিজন, দাসদাসীদের নিত্য খোঁজখবর নেওয়া ছাড়া অনাথ আতুরজনের দেখভাল করা তার রুটিনের মধ্যে পড়ত। যদি কখনও শুনতেন কেউ বিপদে পড়েছে তখুনি লোক পাঠিয়ে তাকে বাড়িতে এনে সেবার ব্যবস্থা করতেন। এমনই ছিল করুণাময়ী রানি রাসমণির চরিত্র।রাজকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে রানি কখনও কোমল আবার কখনো কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। যেমন তখন আমাদের ভারতবর্ষ বিদেশী শাসনের অধীনে ছিল। ফিরিঙ্গিদের ব্যাপারে রানি কঠোর মনোভাব দেখাতে কখনও কুণ্ঠিত হননি। যখন যেমন তখন তেমন তিনি।
রানি রাসমণির উৎসবপ্রিয়তা প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে হয় উৎসবে রানির রাজকীয়তার প্রকাশ ঘটতে দেখা গেলেও তার মধ্যে ছিল সেবামূলক কাজের নানাবিধ অনুষ্ঠান যেমন অনাথ-আতুরদের নিজ বাড়িতে কর্মচারীদের দিয়ে ডেকে এনে দিনকতক পেটভরে খাওয়ানো, জামাকাপড় ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করা, ব্রাহ্মণদের দানধ্যান করা। রানি মনে করতেন সকলকে নিয়েই উৎসব অতএব প্রতিটি উৎসবে যতটা পারা যায় মানুষের সেবা করা। তিনি উৎসব উপলক্ষে আগত অতিথি অভ্যাগতদের বলতেন, আমি এক রানি যে সর্বদাই তোমাদের পাশে আছি।
ক্রমশ
0 Comments