পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯১
সৌভাগ্য চতুর্থী
ভাস্করব্রত পতি
"আয়ু যশ ভাগ্য মোরে দাও ভগবতি।
সমস্ত কামনা সহ ধন ও সন্ততি৷৷
দুর্গতি হারিণী দুর্গে সর্বাশুভ বারিণী।
ধর্মার্থ মোক্ষদা তুমি সর্ব দুঃখ তারিণী॥
তুমি দুর্গা তুমি কালী, তোমা জগদ্ধাত্রী বলি,
ভগবতী সর্ব পাপ হরা।
সর্বকাম প্রদায়িনী, তুমি মাতঃ নারায়ণী,
প্রণিপাত তব পদে তারা"।
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থীর দিন ঘট উত্থাপন করে মা দুর্গার আরাধনা করতে হয়। এ তিথিতে হয় 'সৌভাগ্য চতুর্থী' পালন। উল্লখ্যনীয় যে, আশ্বিনের যে শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথি থেকে দুর্গা পুজো হয় সেই পক্ষের চতুর্থীতে এই উৎসব পালন করার নিয়ম। মূলতঃ সধবা এবং সন্তানের মায়েরাই এই ব্রত উদযাপন করে। এরপর দু'টি বড় এবং পরিস্কার কচুপাতা এনে সেগুলির একখানার ওপর যত রকম গয়না আছে সব তার ওপর আঁকতে হবে ঘি দিয়ে। আর অন্য আরেকটি কচুপাতাখানার ওপর ঐ একই রকমের গয়নার ছবি পিটুলি দিয়ে আঁকতে হয়। পরে সেই দুটি কচুপাতার ওপর পুজোর যাবতীয় নৈবেদ্য সাজানো হয়। এবার ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে পুষ্পাঞ্জলি দিতে হয়। চার বছর করার পর শেষ বছরে ষোড়শোপচারে মা ভগবতীর পূজো দিয়ে সমাপন হয় সৌভাগ্য চতুর্থী পালন। এই সৌভাগ্য চতুর্থী পালনের পেছনে যে কাহিনীর সন্ধান মেলে, তা এরকম ---
একময় এক রাজার সুয়োরাণী এবং দুয়োরাণী ছিল। রাজাা দুয়োরাণীকে একদমই ভালবাসতেন না। কখনো তাঁর মুখটাও দেখতেন না। রাজার এহেন ব্যবহারে দুয়োরাণী মনের দুঃখে রাজবাড়ী ছেড়ে বাগানের গোয়ালঘরে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন।
দুয়োরাণী রাজপুরী থেকে চলে যাবার পরে সুয়োরাণী এবার মনের সুখে থাকতে লাগলো। বড়রাণীকে কেমন করে রাজ্যছাড়া করবে, সখীদের সঙ্গে সুয়োরাণী নিয়মিত পরামর্শ করে। অবশেষে একটা মতলব কষে রাজাকে জানায় বড়রাণীকে বনবাসে পাঠানোর কথা।
বড়রাণীকে রাজ্যের সবাই খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। তেমনি রাজপুরীর দাসদাসীরা ছোটরাণীকে একদমই সহ্য করতে পারতোনা। যে দিন সুয়োরাণী বড়রাণীকে বনবাসে পাঠানোর শলা পরামর্শ করছিল, সেদিন অন্য দাসীরা সব কথা শুনতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বড়রাণীর কাছে গিয়ে সব জানায়।
বড়রাণী তখন গোয়ালঘরে একটা ছেঁড়া মাদুর ও ছেঁড়া কাঁথা পেতে ঘুমোতেন। আর যখন যা পেতেন, তাই একবেলা সেদ্ধ করে খেতেন। আর নিজের কপালে হাত দিয়ে নিজের দুঃখের কথা ভেবে কেঁদে কেঁদে রাতদিন ভগবানকে ডাকতেন। দাসীদের মুখে সুয়োরাণীর ষড়যন্ত্রের কথা শুনে তাঁর খুব প্রাণে কষ্ট হল। আর সেদিন ছিল আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথি। দুঃখে দিনের বেলায় কিছুই রাঁধলেননা। মনের দুঃখে ছোঁড়া মাদুরে উপুড় হয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলেন।
এইভাবে সমস্ত দিন কেটে গেল অবশেষে সন্ধ্যা হল। তবুও বড়রাণীমা উঠলেন না মাদুর ছেড়ে। ধীরে ধীরে রাত্রি গভীর হল। সমস্ত দিন উপবাসে থেকে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল তাঁর। তার উপর সারা দিন কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে একসময় বড়রাণীমা ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষ রাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে, একটি অতিব সুন্দরী মহিলা এসে তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে মিস্টি গলায় বলছে, “কিসের দুঃখ রে তোর? আর কাঁদতে হবে না। এবার তোর সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আজ চতুর্থী তিথি। রাত শেষ হলে তুই চতুর্থীর পালন করবি। তাহলে সব দুঃখ চলে যাবে। সৌভাগ্য ফিরে পাবি"। বড়রাণী স্বপ্নের মধ্যেই কথা বললেন ঐ সুন্দরী মহিলার সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলেন, “কে তুমি মা? তোমার মিস্টি মিস্টি কথা শুনে আমার সব কষ্ট চলে গেল। আমার প্রাণ জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মা, আমি কিভাবে পালন করবো চতুর্থী? আমার তো নিয়মকানুন জানা নেই"। তখন সুন্দরী মহিলা বললেন, “বাছা, এই গোয়ালঘরের পেছনে ছাইগাদার উপর অনেক মানকচুর গাছ রয়েছে। সেখান থেকে দুখানা পাতা কেটে এনে সেগুলোকে ভালো করে মুছে নিতে হবে। এবার একখানা মানকচুর পাতার উপর পিটুলির গোলা দিয়ে যত রকমের গয়না আছে তা আঁকবি। তারপরে সেই পাতায় আলোচালের নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখবি। আর অন্য মানকচুর পাতায় ঘি দিয়ে ঐ একই রকম গয়নার ছবি এঁকে তাতে চিনির নৈবেদ্য সাজিয়ে রাখবি। এরপরে একমনে চোখ বন্ধ করে ভক্তিভরে মা দুর্গাকে ডেকে মনে মনে তাঁর পূজা করবি। পূজা শেষ হলে ঐ আলোচালের ভাত রেঁধে ঘিয়ের গয়না আঁকা মানপাতাতে সাজিয়ে মনে মনে দুর্গাকে নিবেদন করবি। এখন সেই প্রসাদ খাবি। তারপর সেই এঁটো পাতা জলে ভাসিয়ে মুখ হাত পা ধুয়ে বাড়ি ফিরে আসবি। এইভাবে দুর্গার পূজা করলে তোর সব দুঃখ চলে যাবে। যাঁরা এটা এভাবে পালন করে, তাঁরা চিরসৌভাগ্যবতী হবেই হবে”।
এতক্ষন স্বপ্নের ঘোরে ছিলেন বড়রাণীমা। ঘুম ভেঙে জেগে উঠতেই তিনি 'দুর্গা দুর্গা' বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। তারপর স্বপ্নে যা যা শুনেছিলেন সেইভাবে মানকচুর পাতা এনে আলপনা দিয়ে ভোগ রাঁধলেন। অবশেষে এঁটো পাতা ভাসিয়ে মুখ হাত পা ধুয়ে ফিরে এলেন। এভাবেই কেটে গেল তিন তিনটা বছর।
এদিকে রাজার রাজ্যে ভয়াবহ মহামারী শুরু হল। চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। ঘোড়াশালে ঘোড়া মরতে লাগলো, হাতীশালে হাতী মরতে লাগলো, চোরের উৎপাত বাড়তে লাগলো। কিন্তু বড়রাণীর যেমন দুঃখ কষ্ট ছিল, তার কোনও পরিবর্তন হলনা। সেই একই তিমিরে নিমজ্জিত থাকলো তাঁর জীবন। তবুও তিনি খুব স্বপ্নের নির্দেশ মতো মা দুর্গার আরাধনা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
রাজপুরীতে ছোটরাণীর প্রতাপ খুব। তাঁর কঠিন অত্যাচারে সবাই বিরক্ত হয়ে উঠলো। দাস দাসীদের বেশিরভাগই কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেল। অবশেষে রাজ্যের প্রজারাও ক্ষেপে উঠলো। এহেন দুরাবস্থা দেখে রাজা একদিন মন্ত্রীকে নিয়ে প্রজাদের দেখতে বেরোলেন। তাঁরা যেদিকেই যান, সেদিকেই শোনেন যে, রাজ্যের লোকজন কেবল বড়রাণীর সুখ্যাতি করছে। তাঁর বিহনে সবাই মর্মাহত।কোথাও শুনলেন কেউ কেউ বলছে, “বড়রাণী রাজ্যের লক্ষ্মী ছিলেন। তিনি থাকলে এরকম পরিস্থিতি হতনা। যে রাজ্যের রাজা স্ত্রৈণ, সে রাজ্যে থাকা চলে না”। আবার কোথাও শুনলেন যে, ছোটরাণীকে সবাই গালাগাল করছে। কেউ তাঁকে 'অলক্ষ্মী' বলছে। এসব শুনে রাজার খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। মন্ত্রী মশাইও রাজাকে বুঝিয়ে বললেন, 'হুজুর, বড়রাণীমা ছিলেন রাজ্যের লক্ষ্মী। তাঁর দয়া, মমতা, গুণ এবং তাঁর মহিমা অসাধারণ। তিনি চলে যাওয়ার পর থেকেই রাজ্যজুড়ে যত অশান্তি ও অনিষ্টের পাহাড় জমছে'। তখন রাজা এসব ভাবতে ভাবতে ফিরে এলেন রাজপুরীতে।
আবারও আশ্বিন মাস চলে এল। বড়রাণীমা ভক্তিভরে সেই একই পদ্ধতিতে মা দুর্গার পূজা করে চলেছেন। গলায় আঁচল চাপিয়ে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে দুর্গাকে স্তব করে ভোগ দেওয়ার পর সেই প্রসাদ খেয়ে পুকুরে মানপাতা ভাসিয়ে হাত মুখ পা ধুয়ে উঠে আসতে আসতে দেখলেন যে রাজামশাই দু'হাত দিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর। চমকে উঠলেন তিনি। বড়রাণী তখন গলায় কাপড় জড়িয়ে রাজামশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলেন। রাজা খুব আদর করে দুয়োরাণীর হাত ধরে তুলে চোখের জল মুছিয়ে চুমু খেয়ে রাজপুরীতে নিয়ে গেলেন।
চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল। বড়রাণীমা ফিরে এসেছেন। একথা শুনে, আবার সবাই যে যাঁর কাজে ফিরে এল। দাস দাসীরা খুব আনন্দে মাতোয়ারা। রাজ্যের অন্ধকার দূর হতে লাগলো। সর্বত্র বড়রাণীমার জয় জয়কার শোনা গেল। ফের রাজ্যে শান্তি ফিরে এল। অভাব, অশান্তি, আপদ দূরীভূত হল। এরপর রাজা একদিন রাজসভায় বসে ছোটরাণীকে ডেকে বললেন, 'তুমি বড়রাণীকে রাজ্যছাড়া করতে চেয়েছিলে। বনবাসে পাঠাতে আমাকে দরবার করেছিলে। কিন্তু আমি তা করিনি। কিন্তু এখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাকেই এখন বনবাসে যেতে হবে। তুমি প্রস্তুত হয়ে যাও'।
ছোটরাণী কেঁদে সকলের কাছে ক্ষমা চাইল। রাজার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু তবুও কিছুই হল না। আর সেই দিনেই সৈন্যদের দিয়ে ছোটরাণীকে বনবাসে পাঠালেন। আর বড়রাণী আশ্বিন মাস আসতেই খুব ঘটা করে শুক্লা চতুর্থীতে দুর্গাপূজা করলেন আগের মতো। আর সৌভাগ্য চতুর্থী পূজার মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
🍂
0 Comments