কালের অতল তলে কলোরাডো
পর্ব ২০
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
নীলদিগন্ত জুড়ে আকাশ ময় ভেসে বেড়ানো মেঘের সাদা পরী দের এখন আর নেই কোনো ভাবনা। বৃষ্টি ভেজা গাছ গাছালির পাতা থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে এখনো। যদিও কোথাও একফোঁটাও জল জমে নেই তবুও ভেজা পথের চিহ্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ অঞ্চল বর্ষণ ক্লান্ত সিক্ত। সৃষ্টি ছাড়া আকাশ এখন কালো মেঘ মুক্ত। নেভাদার সীমানা ছাড়িয়ে 'ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রবেশের পর তুমুল জোরে বৃষ্টি নামায় পথের ধারে রেষ্ট রুমে বসে অনেক টা সময় কাটিয়ে দিলাম। কালো উড়ো মেঘের দল ভেসে যায় আকাশ পাড়ে , অতনু ওর দরাজ গলায় গেয়ে ওঠে ''মেঘ বলেছে যাবো যাবো রাত বলেছে যা--ই '' বিদেশের অমন বৃষ্টি মুখর শেষ বেলায় ভেজা পরিবেশে এমন গান শুনে সময় কাটাতে বেশ লাগছিল। দেখি আশেপাশের অপেক্ষমান বিদেশী মুখ গুলো ও স্বকর্ণে উদগ্রীব হয়ে ওর গান শুনছে। অবশেষে বৃষ্টি থামলে 'inter state 15 road ধরে গাড়ির চাকায় ঝড় তুলে জোরদার গতিতে রওনা দিলাম লস গ্যাটোসের দিকে। অতনু প্রমাদ গুনে ব্রতীন কে সাবধান করে -- দূরের গাড়িটির মাথায় লাল নীল আলো জ্বলছে ,নিশ্চয়ই পুলিশের চেক ভ্যানের সঙ্কেত ,স্পীড না কমালে এক্ষুণি ঝামেলায় পড়তে হবে। ঠিক ফাইনের টিকিট ধরিয়ে দেবে ,ব্রতীন সতর্ক হয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে সামনে এলে দেখি সত্যি পুলিশের গাড়ি কাউকে ধরেছে। ইয়াম বলে Thank God , এ যাত্রায় আগেই সাবধান হয়ে যাওয়ায় ফাইন এড়ানো গেল।
রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড ফলো করছি আপাততঃ Barstow, CA পেরিয়ে চলেছি আবার শুধুই ধুধু তৃণ ভূমি অঞ্চল ,ঘাস গুলো প্রখর খরার তাপে শুকিয়ে হলদে হয়ে গিয়েছে। Bakersfield CA এর ওপর দিয়ে যাবার সময় রাস্তার ওপর এক সাইনবোর্ডে চোখ আটকে গেলো। ''NEWSOM STOP WESTING OUR DAM WATER'' ., ,,আমি অতনু কে গভীর বিস্ময়ান্বিত হয়ে প্রশ্ন করি NEWSOM লোকটি কি কোনো VIP PERSON ? কে তিনি ? জল সে যে জীবন দাত্রী। নিত্য প্রয়োজনীয় প্রাণ ধারণের মহার্ঘ্য বস্তু ,জাতীয় সম্পদ কে এতো অপচয় করে নষ্ট করছেন ? অতনু বলে খুব বেশী কিছুই জানিনা। শুধু জানি তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বর্তমান গভর্নর GAVIN NEWSOM ,.খুব নিজের মর্জিতে চলেন। মনে হয় জনস্বার্থে উদাসীন এক আত্মসুখী রাজনৈতিক চরিত্র। ব্রতীন বলে আমি অল্প স্বল্প গল্প হ্যারি গ্র্যান্ডপার কাছে শুনেছিলাম। ''এই বর্তমান গভর্নরের অবিবেচকের মতো রাজ্য পরিচালনার কর্ম দক্ষতায় এদিকের কৃষি নির্ভর ভিলেজারস প্রজারা মোটেই খুশি নয়। এতো যে মুষলধারায় ক্যালিফোর্নিয়াতে পুরো শীত কাল ধরে বৃষ্টি হয় ,তার হাজার হাজার গ্যালন গ্যালন জল যদি তিনি সমুদ্রে প্রবাহিত হতে না দিয়ে অতিরিক্ত রিজার্ভারের ব্যাবস্থা করে স্টোর করতেন তাহলে খরার সময় ক্ষেত গুলো এমন জ্বলে শুকিয়ে হলুদ বরণ হতো না। ফার্মার দের ফার্মিংয়ে অনেক বেশী সাহায্য হতো। উনি কেমন সচেতন মানব দরদী ? যিনি খেটে খাওয়া গরীব প্রজাদের কথা বিশেষ ভাবেন না বলে এদিকের CA মানুষ জন তার প্রতিমোটেই সদয় নন। ওরা রাস্তার সাইনবোর্ডে লিখে তাই প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি প্রশান্ত মহাসাগরের তরঙ্গ রাশি তে উত্তাল সী বীচ উথালপাথাল। রক্তের প্রবাহে শিরার শিরায় তোলপাড় তুলে চলেছে এত দিন পর ঘর ছাড়া দের ঘরে ফেরার আনন্দ। এ যেন বহুদিন পর ,বহুক্রোশ ঘুরে , নিজের চেনা জায়গাটিতে পৌঁছলাম। অতনু কর গুনে বলে বহুদিন বলছো ?, মাত্র তো ১৫দিন ! আমি হেসে উঠে বলি হায় রে পাগল ! তবুও তোদের বেড়ানোর নেশা মিটলো না। আর কত দিন এমন করে আমি নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরবো তোদের সাথে ?
এখানে এসেই জানুয়ারীর শেষের সান্ধ্য কফির আড্ডায় মিঃ হ্যারি বলেছিলেন , লস্গাটস মানে স্পেনীয় ভাষায় ''ঐ বিড়ালরা '' ! অবাক চোখে তাকিয়ে বলি সে আবার কেমন ? ''ঐ বিড়ালরা '' আবার কোনো জায়গার নাম হতে পারে নাকি ? কোনো আধুনিক বর্ধিষ্ণু শহরের এমন নাম ! তাও আবার আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির মত জায়গায় ? ভাবছি উনি বোধহয় মজা করছেন। হ্যারি সাহেব সেই আগের মতই মেদিনী কাঁপিয়ে হো-- হো করে হেসে উঠেছিলেন। সাদা ধবধবে এক গুচ্ছ চুল কপালের ওপর থেকে সরিয়ে মাথার ওপর ঠেলে তুলে তার শ্বেতশুভ্র বহু চর্চিত দাঁড়িতে সযত্নে হাত বুলিয়ে বলেন হয় গো হয় ! সেই কবে ১৮৪০-৫০ খ্রিষ্টাব্দে এর নামকরণ হয়েছিল ,তারপর কালের স্রোতে কত পরিবর্তন এসেছে কিন্তু উন্নতির প্রবাহে সাবেকী নামকরণের পরিবর্তন হয়নি।
ভাবছি তা হবে, বিদেশী ভাষা তাও আবার স্প্যানিশ। গ্যাটস মানে সত্যি কি বিড়াল ? মিঃ হ্যারি বল্লেন হ্যাঁ একশ ভাগ সত্যি তবে বিড়ালরা , plural number হবে । তিনি বলেছিলেন ,অনেক কাল আগে এখানের এই পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ বন্য প্রাণী বিড়াল বংশ উদ্ভুত ববক্যাট ,কুগার , বিশেষ করে অনেক মাউন্টেন লায়ন দের আবাস স্থল ছিল। এরা রাতের বেলায় শিকার সংগ্রহে খুব বেশী উৎপাত করে বেড়াত। বেশ আতঙ্ক ছড়িয়ে নিরীহ জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলতো। কিন্তু মানব সভ্যতা যেখানে তার প্রয়োজন মেটাতে ,স্বার্থ সিদ্ধিতে হাত লাগিয়েছে সেখান থেকেই প্রকৃতির প্রাকৃতিক সম্পদ নীরবে বিদায় নিয়েছে। স্প্যানিশ ভাষায় লস মানে ঐ,এবং গাতোস বা গাটোস মানে বিড়ালরা। সেই থেকে স্থানীয় জনগণের কাছে এই জায়গাটি লসগাটোস বা গাতোস নামে আজো পরিচিত হয়ে আছে ।
কথায় গল্পে অন্যমনস্ক ছিলাম ,হঠাৎ দেখলাম গাড়ির জানলায় তীব্র আলোর ঝলক পড়েছে , লাল যোগ চিহ্ন সহ রেডক্রসের আম্বুলেন্স লাইন দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে দ্রূত এগিয়ে চলেছে। সপ্রশ্নের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইয়ামের দিকে তাকাই ,ওর ধারণা কোথাও নির্ঘাৎ বড়ো রকমের এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাই এমন আম্বুলেন্সের সার বেঁধে হস্পিটালে চলার তাড়া। সামনে তাকিয়ে দেখি সবুজ সাইন বোর্ডের ওপর CA র ম্যাপ সহ বড়ো করে সাদা দিয়ে ১৭ নম্বর লেখা। পরিচিত সেই হাইওয়ের ওপর দিয়ে এক ঝাঁক গাড়ির সাথে বর্ষণ সিক্ত কুয়াশা ভরা সাঁঝের আলোয় আমাদের প্রিয় রথ -- ট্যাকোমা পিক আপ ট্রাক ও নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে স্বগর্বে ছুটে চলেছে। ঢুকে পড়েছি লস গ্যাটসের নাগরিক জীবনের কাউন্টিতে। বেশ কিছুটা সময় পার করে পাহাড়ের গা বেয়ে বনের পথে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে উঁচু থেকে আরো উঁচুতে উঠে চলেছি। আমি অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাই শুধু গাছের সারি ঘন বন পাথুরে পাহাড়ের গা বেঁয়ে আবার আমাদের পথ এগিয়ে চলেছে। পিচ ঢালা ঢালু পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে কোথায় যে মিলেছে কে জানে ? ভাবছি এ আবার কোন পথে চলেছি ? গাড়ির হেড লাইটের আলোয় দেখছি দুপাশে ঘন জঙ্গল। আরো কত উঁচুতে উঠতে হবে এই অচেনা পথে কে জানে ?
ব্রতীনের মুখে সেই অকৃত্রিম হাসি ,বলে এই ঢালাই রাস্তাটির নাম Bay laurel road মানে তেজপাতার নামে রাস্তা। খুব বেশী নয় গো ঘাবড়ে যেওনা। আমরা প্রায় এসে গিয়েছি এই বুনো পথ ধরে ও লস গ্যাটোসের বাড়ি পৌঁছোনো যাবে। আসলে সোজা রাস্তা টি ঝড় বৃষ্টিতে গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আরো কিছুটা ঘুরে পথের ঢাল বেয়ে এগিয়ে গিয়ে পেলাম তেজপাতার বন , গাছ গুলো সার সার কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তার ধার ঘেঁষে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় সুগন্ধি তেজপাতার মোহিত করা গন্ধ। অবাক লাগে ভাবতে ,বাঙালী রান্নার ফোড়নের প্রধান উপকরণ তেজপাতার এখানে এমন সুদূর প্রসারিত বন হেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। সেদিন ইন্ডিয়ান স্টোরে গিয়ে এক প্যাকেট তেজপাতা সাকুল্যে পঁচিশ টা পাতাও ছিল না তিন ডলার দিয়ে কিনেছিলাম মনে পড়লো। আমেরিকান রান্নার রেসিপিতে তেজপাতার কোনো ব্যবহার কোথাও দেখিনি।
🍂
এর আগে সকাল বেলায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে আমার পরিচিত শ্বেতকরবী ,ও রক্ত করবীর ফুলের গাছ, বিরাটাকারের অঢেল ফলন্ত আমলা গাছের সারির সাথে দুই একটা তেজপাতার গাছ ও দেখে ছিলাম। ডগলাস ,রেডউড বা ইনল্যান্ড রেড উডের ও অবাধ স্বাধীনতায় গভীর ঘন বনের মাঝে একাএকা বুনো গন্ধ শুঁকে পথ হারিয়ে ফেলার মজাই আলাদা।একদিন সকাল বেলায় হেঁটে বনের অনেকটা ভিতরে ঢুকে এক পরিত্যাক্ত ভাঙা বাড়ি দেখতে পেয়েছিলাম। সেখানের বাগানের মধ্যে দুটি গাছের ডালে মোটা দড়ির হ্যামক টাঙানো ছিল। কৌতূহল দমন করতে না পেরে একটি উঁচু পাথরের টিলার ওপর উঠে উঁকি মেরে দেখি এক সাহেব ভদ্রলোক তার বছর পাঁচের শিশু পুত্রটিকে বুকের ওপর নিয়ে অকাতরে ঘুমিয়ে আছে। সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তাদের মুখের ওপর পড়েছে তবুও হুঁশ নেই। আমি চুপি সারে পালিয়ে এসেছিলাম।এখানে যে কারোর ব্যক্তিগত জীবনে এমন নাক গলানো বা উঁকিঝুঁকি মারা ভীষণ গর্হিত অপরাধ।
এখন পাহাড়ের উঁচু নীচু পথে গাড়ির চাকা ঘুরছে বেশ ধীর গতিতে। একটা বাঁক ঘুরতেই পাশের বন তল দেখিয়ে ব্রতীন বলে সামনেই লক্ষ্য করে দেখো এই যে সারিবদ্ধ লম্বা গাছ গুলো দেখা যাচ্ছে ,ওরা সব সুগন্ধ যুক্ত পিনাসেই পরিবারের সিডার। আকাশের সীমানা ছুঁয়ে অফুরন্ত গাছগাছালির সাথে পাখ পাখালির অন্তহীন আহ্বান। সমুদ্র তল থেকে মাত্র ছয় শত ফিট উঁচুতে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তাক্রুজ পাহাড়ে এক চমৎকার নির্জন তায় ব্রতীনের এই নতুন আস্তানাটি লোকালয় থেকে বেশ দূরে অবশেষে সেখানে নির্বিঘ্নে এসে পৌঁছলাম ।
ইয়াম কে আগেই সান্হোসের ক্যাম্পবেলে ওর এপার্টমেন্টের কাছে নামিয়ে এখন অতনু কে নিয়ে আমরা তিন জন বাড়ি পৌঁছতে অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলো। চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখি শহরের ব্যস্ত তম রাস্তাটা কি অসম্ভব ফাঁকা। যেখানে মিনিটে হাজার গাড়ির লাইন লেগে যায় সেখানে দশ টা গাড়ি ও যেন নেই। কোন বিপদের আশঙ্কায় নিস্তদ্ধ পরিবেশ। বাতাসে প্রমাদ গুনছে জনজীবন। এক প্রলয়ঙ্কর ঝড় ওঠার আগের পূর্বাভাস ,থমথমে আকাশের মত দমবন্ধ করা গুমোট বিশ্ব চরাচর।
পাহাড়ের কোলে শত শত বর্ষ পুরানো আকাশ ছোঁয়া রেডউড সিডারের গাছের সাথে ডেক চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছি। বিরাট সাহেবী ঢঙে বানানো ' মাউন্টেন হাউজ' বাড়ি টা ভারী মায়াময় আমার চমৎকার লাগে। ঘরের লাগোয়া অনেকটা জায়গা জুড়ে বেশ পোক্ত পালিশ করা কাঠের পাটাতন টি যেমন লম্বা তেমনি চওড়া ঠিক যেন জাহাজের ডেকের মত। কাঠের মজবুত রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমার কল্পনারা দূরদূরান্তে পাখা মেলে দেয়। মনের ক্যানভাসে আপন মনে রং তুলি দিয়ে ছবি এঁকে যাই। যেন উত্তাল জলরাশির অগুনিত ঢেউ গুনতে গুনতে দিকভ্রান্ত নাবিক অজানা সমুদ্দুরের রাশি রাশি ঢেউয়ের দোলায় ভাঙা কাঠের ভেলা খানি সম্বল করে ভাবীকালের পাড়ানি নৌকায় ভেসে এখানে ডাঙ্গা খুঁজে পেয়েছে।
পাহাড়ের উপত্যকায় ধাঁপে ধাঁপে যেখানেই সমতল পাওয়া গিয়েছে সেখানেই মানুষের ঘরবাড়ি বাসস্থান গড়ে ওঠায় চারদিকে ঘিরে আছে রেড উড আর পাইনের ঘন বন জঙ্গলে। মাঝখানে এ বাড়ি টি যেন একাকী একটি নির্জন দ্বীপ।এ পাহাড়ের শুরু বা শেষ কোথায় জানিনা এক আদি অন্তহীন অচলায়তনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হয়ে অনন্ত কালের অপেক্ষায়। তার সারা শরীর জুড়ে শতাব্দী প্রাচীন বিশাল বিশাল আয়তনের বহু পুরোনো আকাশ ছোঁয়া লম্বা চওড়া গাছে দের জটলা। বিচিত্র সবুজের সাথে আকাশের ঘন নীল ,নানাজাতের ছোটো বড় গাছ তাদের বংশ বৃদ্ধির গল্প এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যের পরিচয় দিয়ে যায়। মানুষের দল রবাহূত হয়ে প্রকৃতির দরবারে তার আগ্রাসী নীতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা কিছু সুন্দর তাই অপহরণের চেষ্টায় দিবা নিশী মতলব আঁটে ।
আপন মনে একাকী সময় কাটাতে ডেক চেয়ারের ওপর সকালের ভেজা চুল এলিয়ে পরম নিশ্চিন্তে বসে সোনালী রোদ্দুরের আরাম দায়ক স্পর্শ উপভোগ করছি। দক্ষিন খোলা বসন্তের বাতাস হাল্কা উষ্ণতার সাথে আমায় পরশ করে প্রাণে সুধা ঢেলে আবার ফেরত যাচ্ছে দূর পাহাড়ের চূড়ায়। কলোরাডোর রাজ্যের স্বপ্ন ময় দৃশ্য গুলো চোখের পাতায় লেপ্টে আছে। দূর আকাশের ঘন নীলে ডানা মেলে ভেসে চলেছে শঙ্খ্চিলের দল। উঁচু উঁচু আকাশ ছোঁয়া গাছ গুলোয় বাসা বেঁধেছে প্রাত্যহিক অতিথি পাখিরা। গাছেরা .মাথায় মাথা ঠেকিয়ে কত কথা বলে , আড়ালে কান পেতে থাকলেও কখোনো শুনতে পাই না সে নৈস্বর্গিক আলাপন।জোরালো হাওয়ায় ঝুরঝুর পাতা অবিরত ঝরে পরে। গাঢ় সবুজের অবগুন্ঠনে ঢাকা পাহাড়ের ঢেউ খেলানো শী র্ষ দেশে দিগদিগন্ত প্লাবিত করে ঘুরে বেড়ায় চিরন্তন অব্যক্ত বিপুল শব্দ রাশির পুঞ্জ।
ব্রতীন ডাউন টাউনে শপিং সেন্টারে ওয়ালমার্টে গিয়েছিল, সেখান থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো খালি হাতে। চোখে মুখে একরাশ আতঙ্কের ছাপ নিয়ে এসে জানালো কি এক মারাত্মক অসুখ ''করোনা ভাইরাস ,বা কোভিড 19 '' ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র যেখানে নিশ্বাসে প্রশ্বাসে বিপদ,মানুষ মানুষের সংস্পর্শে এলেই জীবন বিপন্ন। ইতিমধ্যেই চীনে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা ও গিয়েছে। আমেরিকাতে ও ইতিমধ্যেই অনেকে আক্রান্ত এবং বেশ মরক লেগেছে। তাই বাজার দোকান স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি অফিস হোটেল রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। লক ডাউন হয়ে যাচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। যথেষ্ট পরিমানে দোকান বাজার না সেরে রাখলে ভবিষ্যতে অসুবিধায় পড়তে হবে।
এমনিতেই এতদিন বাড়ি ছিলাম না সুতরাং কাব্যিক বিলাস ময় নিস্বর্গের জগৎ ছেড়ে এক নিমেষে দৌড়লাম বাস্তবের ভাঁড়ারে। স্টোর রুম হাতড়ে বিরাট এক ফর্দ তৈরী হলো যদিও ব্রতীন জানে সব এক সাথে পাওয়া যাবে না কারণ ও দেখে এসেছে ছয় ফুটের ব্যবধানে লোকের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে লম্বা লাইন। শপিং সেন্টারের সামনে মুখে মাক্স লাগিয়ে প্রায় ১৫০ জন গম্ভীর মুখে অপেক্ষমান। গোল গোল করে সাদা পেন্ট দিয়ে গন্ডি কাটা তারই মধ্যে বাধ্য ছেলে হয়ে মূক বধিরের মত দাঁড়িয়ে আছে। নারী পুরুষ সবার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। ছয় জনের বেশী একসাথে কারোর শপিং মলের অন্দরে প্রবেশ নিষেধ। জনসাধারণের এমন লম্বা লাইন কখন শেষ হবে কে জানে ?
দৌড়ে এসে টিভি চালু করে নিউজ চ্যানেল খুলে দেখি এ কী দুঃসংবাদ। এতদিন পথে পথে ঘুরলাম এতো নানা রকম হোটেলে থাকলাম , রেস্তোরাঁয় খেলাম তেমন কিছুই তো বুঝিনি। মার্কিন নিউজ চ্যানেল বলছে ' - এক ভয়ঙ্কর মারণ রোগ দেখা দিয়েছে ,সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে তড়িৎ গতিতে। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়েছে 'কোভিড ১৯ '' যে করোনা ভাইরাস নামে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯ যা 'করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব জুড়ে সমগ্র গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এই রোগ। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত পৃথিবীর আপামর মানুষ গুলোর মনের শান্তি রাত্রির নিশ্চিন্ত ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই অসুখ।
মাত্র তিন মাস আগে ,অর্থাৎ গত বছর ২০১৯ এর ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনার রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে। গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুড়ের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। যদিও বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী করোনাভাইরাস বহন করতে পারে। চীনের বাজারটি থেকে অনেক জীবন্ত প্রাণী ,মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, সাপ- এসব প্রাণী করোনা ভাইরাসের উৎস হতে পারে। এশিয়ার বিভিন্ন অংশ এবং এর বাইরে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানী দের ধারণা সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করে এই মারাত্মক ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমানো যায়। কিন্তু এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে করোনা ভাইরাস এক দুঃস্বপ্নের নাম।
ইতিমধ্যেই পৃথিবীর করোনা আক্রান্ত দের সাথে এই মহাদেশের নানা রাজ্য থেকে 'কোভিড 19 'এ আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়ে নিউজে বুলেটিনে আসছে । স্তদ্ধ হয়ে টিভি স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছি ''এই ভাইরাস যা মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে- যা পূর্বে বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল। ' 'শুরুর দিকের উপসর্গ সাধারণ সর্দিজ্বর এবং ফ্লু'য়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া স্বাভাবিক। এ অসুখে রোগীর জ্বর ,অবসাদ ,শুকনো কাশি ,বমি হওয়া শ্বাসকষ্ট গলা ব্যথা মাথা ব্যাথা ,পেটের সমস্যা মুখের স্বাদ হারিয়ে যাওয়া ,কোনো আঘ্রাণ না পাওয়া শরীর দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাওয়ার উপসর্গ প্রকট রূপে দেখা দেয়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর থাকেনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। জনগণের মধ্যে যখন ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেবে তখন অনেক বেশী মানুষকে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে তাদের।''
আমার শুধু পারভীনের মায়ের কথা মনে পড়ছে। পারভীনের মুখে শুনেছিলাম রাবেয়ার শরীরেও শুকনো কাশি ,বমি হওয়া শ্বাসকষ্ট গলা ব্যথা মাথা ব্যাথা ,পেটের সমস্যা মুখের স্বাদ হারিয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ গুলোদেখা দিয়েছে। ব্রতীনের লিভিং রুমে ভিডিও কনফারেন্সে করোনা নিয়ে তথ্য আদান প্রদান চলছে। আমি এক কোণে নীরবে বসে ওদের আলোচনা শুনছি। আজ আমার মনে রান্না করা খাওয়া বা খাওয়ানোর কোনো রুচি নেই। স্থবিরের মত বসে থেকে ,মনে হচ্ছে যেন ঐ মৃত্যুর মিছিলে আমার পরিচিত কত মুখ পলিথিন প্যাকেটের কভারে মুড়ে সারে সারে মিছিল হয়ে চলেছে কবর স্থানে। এ পৃথিবীর সমস্ত চাওয়া পাওয়া মিটিয়ে ,শরীরের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা জুড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবীর ট্রলিতে চেপে কফিন বন্দী হয়ে পাড়ি দিয়েছে কোন অতলান্ত ঘুমের দেশের নীরব কঠিন শীতলতায়।
0 Comments