জ্বলদর্চি

কবি ও সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্বজিৎ অধিকারী

কবি ও সম্পাদক শ্যামলকান্তি দাশের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্বজিৎ অধিকারী 


বিশ্বজিৎ অধিকারী: শ্যামলদা, প্রথমে আপনাকে জানাই আমাদের আন্তরিক শুভকামনা ও অভিনন্দন। আপনার ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস 'এরোপ্লেনের খাতা'-কে এবছর পুরস্কৃত করেছে সাহিত্য অকাদেমি। যদিও আমাদের কাছে আপনার পরিচয়—আপনি এই সময়ের একজন অন্যতম প্রধান কবি, যিনি ছোটদের সাহিত্য রচনাতেও সমান দক্ষ। মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আপনার জন্ম, সেখান থেকে নিজের সময়ের একজন প্রধান কবি হয়ে উঠলেন আপনি। এই অভিযাত্রা বিষয়ে কিছু বলুন।

শ্যামলকান্তি দাশ: কবিতা লিখব ছোটবেলায় এমন ভাবনা কখনও আসেনি মাথায়। আমি ভাবতাম পাইলট হব, উড়োজাহাজ চালিয়ে বিশ্বজয় করব। গ্রামের ছেলে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতাম, আর আকাশে উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন দেখতে পেলে দৌড়োতাম, যেন পাল্লা দিতে চাইতাম। আকাশের গায়ে কাল্পনিক রেখা টেনে ভাবতাম ওই পথ দিয়েই বিমান চালাবো আমি। ছেলেবেলায় সত্যি সত্যি একটা খাতা ছিল আমার, নাম ছিল উড়োজাহাজের খাতা। গ্রামে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিলে আমরা আমাদের বইখাতাগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতাম কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে। এবং অবশ্যই সঙ্গে থাকত সেই খাতাটি। একদিন নলিনী নামে এক বন্ধুর লেখা একটি কবিতা পড়ে আমার মাথা থেকে পাইলট হওয়ার পাগলামি দূর হয়ে যায়। ছবি আঁকতাম, একদিন বাবার নিদারুণ বেত্রাঘাতে সেই শখকেও বিদায় জানাতে হল। যে গ্রামে আমি বড় হয়েছি সেখানে কবিতার কোনও পরিবেশ ছিল না। তবে আমাদের বাড়িতে কবিতার একটা পরিমণ্ডল ছিল। ঠাকুরদা কবিতা লিখতেন, বাবা কবিতা লিখতেন, জ্যাঠামশাই কবিতা লিখতেন, এক জেঠতুতো দাদা কবিতা লিখতেন—তিনি পরবর্তী সময়ে খুব বিখ্যাত হন। সর্বোপরি ছিল ওই নলিনীর অবিরাম তাড়না। ১৩৭২ সালে আমার প্রথম কবিতা 'এই তো আমার পণ' কলকাতার একটি কাগজে ছাপা হল। বাবা কবিতা লেখা খুব একটা পছন্দ করতেন না, বলতেন কবির জীবন খুব দুঃখের জীবন। বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমি অধ্যাপক হই। তারপর তো স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ভরতি হলাম এবং ছোটবেলার গ্রাম ছেড়ে আমরা চলে এলাম বাবার পৈত্রিক ভিটেয়। সেটা হলদিয়ার কাছাকাছি একটি গ্রাম। কলেজে অনেক অধ্যাপককে পেলাম যাঁরা সাহিত্যমনষ্ক। এইসময় একজন কবির সঙ্গে আলাপ হল, তার নাম অমিতাভ দাস। অমিতাভদার সূত্রে আরও এক কবির সঙ্গে পরিচয়, তিনি বিশ্বেশ্বর সামন্ত। সেসময় বড়বড় কাগজে তাঁর লেখা ছাপা হত। আরও অনেক কবিলেখককে বন্ধু হিসেবে পেলাম। সিরিয়াসলি কবিতা লেখা শুরু হল। কবিতা প্রকাশিত হতে থাকল অনেক অনেক ছোটকাগজে। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রথম আমার কবিতা বেরোল—'ছেলেবেলার পদ্মবীজ'। মনে আছে, সে-সংখ্যার কবিতার পাতায় অন্য দুই কবি ছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং দেবারতি মিত্র।

বিশ্বজিৎ: আপনার প্রায় প্রতিটি কবিতাই যেন এক-এক খণ্ড জলকাদা বনবাদাড়ময় গ্রাম। কবিতায় ছায়া ফেলা আপনার এই অফুরান গ্রামজীবন নিয়ে কিছু শুনতে চাই।

শ্যামলকান্তি: এই সেদিন আমাদের সময়ের এক প্রতাপশালী কবি, আমার বন্ধুও বটে, বললেন, চল্লিশ বছর ধরে আপনি তো শুধু গ্রামের কথাই লিখলেন। আমি বললাম, আমি তো গ্রামেরই মানুষ, আমার গায়ে এখনও পানা পুকুরের গন্ধ, এখনও আমার গায়ে শ্যাওলা, আমি কী করে গ্রামকে অস্বীকার করব। এসব লিখে আমার কবিতায় কোনও উত্তরণ হয়েছে কিনা তা বিচার করবেন পাঠক।

বিশ্বজিৎ: শ্যামলদা, আপনার কবিতায় ছড়ানো থাকে এক ধরনের রম্য দুরূহতা। যেন একটা রূপকথার আবেশ। অথচ আপনি রূপকথা লেখেন না, লেখেন সাধারণ মানুষের ক্লিষ্ট সমস্যাসঙ্কুল জীবনের কথা।

শ্যামলকান্তি: রম্য কিনা জানি না, তবে দুরূহতা হয়তো আছে আমার লেখায়। ছোটবেলায় আমি খুব রূপকথার গল্প পড়তে ভালোবাসতাম। সেসবের প্রভাব আমার লেখায় পড়ে থাকতে পারে। সাতের দশকে আমার এই ধরনের লেখা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল—এ কথা বলতে পারি।

বিশ্বজিৎ: আমাদের মাঝেমাঝে মনে হয় আপনার কবি-চেতনায় শৈশবের এক সুগভীর প্রভাব রয়েছে। তা যেন ধরা পড়ে আপনার শব্দ উপমা বা প্রতীক ব্যবহারের প্রবণতায়।

শ্যামলকান্তি: হ্যাঁ, শৈশব-কৈশোরের প্রভাব আছে আমার লেখায়। যে গ্রামে বড় হয়েছি তা দুর্গম হলেও আশ্চর্য সুন্দর, সুজলা-সুফলা। একটা মস্ত বড় ভীমমেলা বসত সেই গ্রামে। মেলায় এক ম্যাজিকের দলে দেখেছিলাম নররাক্ষস। সে এক বীভৎস ব্যাপার। এরকম নানা বিষয়ের উল্লেখ আমার অনেক লেখাতেই রয়েছে।

বিশ্বজিৎ: পূর্ববর্তী সময়ের কয়েকজন কবির নাম বলুন যাঁদের রচনা আপনাকে প্রাণিত করেছে।

শ্যামলকান্তি: একেবারে প্রথমের দিকে আমার পাঠ্য তালিকায় ছিলেন সুনির্মল বসু। বাবা আমার জন্মদিনে একবার কবির 'রাজভোগ' নামে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর লেখার প্রতি আমার অনুরাগ, সেসময় তাঁর লেখাই আমার মনে সবচেয়ে বেশি দোলা দিয়েছে। পরবর্তী কালে অবশ্য সব কবির লেখাই আমি পড়েছি। তবে আমাকে সবচেয়ে প্রাণিত করেছেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মণীন্দ্র গুপ্ত এবং প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।

বিশ্বজিৎ: শ্যামলদা, ছন্দের একজন সিদ্ধ-পুরুষ আপনি। ছন্দ যেন আপনার বাধ্য অনুগত অশ্ব। অনেক তরুণ ছন্দের আঠায় আটকে গিয়ে কবিতার নামে ছড়া লিখে বসেন।

শ্যামলকান্তি: সিদ্ধ-পুরুষ নই, ছন্দের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যে ব্যাকরণ আমি তা জানি না, তবে আমার ছন্দে কোনও ভুল থাকে না। আগেই বললাম যে আমার বাবা কবিতা লিখতেন, ছন্দোবদ্ধ কবিতা। আমি একটি সভায় একবার বলেছিলাম—বাবা কবিতা লিখলে অনেক কবিকেই কলম ফেলে দিতে হত। তাই ছন্দের দোলাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একটা কথা বলতেন—ছন্দটাকে প্রথমে ভালো করে জেনে নাও, তারপর ভুলে যাও। ভুলতে না পারলে ছন্দের একটা ধাঁধা বা আবর্ত আছে, যার মধ্যে তুমি আটকা পড়ে যাবে। এ শিক্ষা আমি নীরেনদার কাছ থেকে পেয়েছি।

বিশ্বজিৎ: আপনার কবিতা তো সেভাবে কেউ আবৃত্তি করেন না।

শ্যামলকান্তি:  ওঁরা বলেন আবৃত্তি-শিল্প, আমার ওই শিল্পের প্রতি কিছুমাত্র অনুরাগ নেই, কোনও আগ্রহ বা দুর্বলতাও নেই। তবে অনেকের কাজ আমার ভালো লেগেছে, তাঁরা কবিতা ঠিকঠাক উপলব্ধি করে পরিবেশন করতে পেরেছেন। যেমন প্রদীপ ঘোষ, পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ, নীলাদ্রিশেখর বসু, উৎপল কুণ্ডু, রত্না মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

বিশ্বজিৎ: অনেকেই বলেন আপনার 'ছোট শহরের হাওয়া', 'সরল কবিতা', এবং অবশ্যই 'রাক্ষস'-এর কথা। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত 'ভাঙা বাড়ির জানালা' অথবা 'ডাইনোসরের অমর কাহিনি'ও আমাদের প্রিয় বই। আপনাকে যদি বলা হয় নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুটি বই বেছে নিতে –

শ্যামলকান্তি: এইটা তো খুব কঠিন ব্যাপার (সহাস্যে)। আমি বলব, আমার দুটো পছন্দের বই—'আমাদের কবিজন্ম' এবং 'রাক্ষস'।

বিশ্বজিৎ: এই শতকের প্রথম দশকে আপনি এক আশ্চর্য পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করলেন, যা প্রকৃত অর্থেই একটি উদার কবিসম্মেলনের চেহারা নিল। এই কাজে হাত দিলেন কার প্ররোচনায়?

শ্যামলকান্তি: নিজেরই অন্তরের তাড়নায়। এমন একটি কাগজের কথা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম যা হবে শুধু কবিতারই কাগজ, যেখানে কবিতার সমস্ত দিকের ওপর আলোকপাত করা হবে। কোনও গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা নয়, নির্ভার অন্তরঙ্গ গদ্যলেখা থাকবে কবিতার পাশাপাশি। সে কাগজে কোনও ছুতমার্গ থাকবে না দলাদলি থাকবে না। এই শুনে প্রথমে কেউই আমাকে খুব একটা উৎসাহ দেয়নি, বরং অনেকে নিরুৎসাহিতই করেছে। শেষমেশ আমারই জেদে এবং দুচারজন বন্ধুর সাহচর্যে 'কবিসম্মেলন' প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, হাতে মাত্র দু’হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে। আপনাদের বয়সীরা হয়তো জানেন না, আগেও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছি, নাম ছিল 'বররুচি'।

বিশ্বজিৎ: “এত কবি কেন?” এমন প্রশ্ন করার মানুষ আপনি নন। যেকোনো গাঁগঞ্জ-মফস্‌সলের কবি-সভায় গিয়ে আপনি অতি সাধারণ সব কবি-লেখকদের সঙ্গেও আড্ডা জমান। এতে আপনার আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ হয় না?

শ্যামলকান্তি:  আমি খুব সাধারণ ছাপোষা মানুষ। অভিজাত নই, আভিজাত্যের প্রতি কোনও মোহও নেই আমার। তাই ভিড়ের মধ্যে আমার কোনও অস্বস্তি হয় না, সমস্ত কবিকেই আমার আপন বলে মনে হয়, তাদের সঙ্গ আমি উপভোগ করি।

বিশ্বজিৎ: শ্যামলদা, আপনার গদ্য মনোরম, ছন্দ নির্ভুল ও সাবলীল, হস্তাক্ষর মুক্তোর মতো। এই পারিপাট্য কি শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অধীনে দীর্ঘকাল কাজ করার সুফল?

শ্যামলকান্তি: হাতের লেখাটা আমার বরাবরই ভালো, সে-জন্য আমি স্কুলে পুরস্কারও পেয়েছি। হ্যাঁ অবশ্যই নীরেনদার কথা বলতে হবে। তিনি আমার কাছে শুধু কবি নন, একজন মস্তবড় শিক্ষক। তিনি যে আমার কত দোষত্রুটি সংশোধন করে দিয়েছেন তা বলার নয়।

বিশ্বজিৎ: এখন কবিতার প্রকাশ প্রসার বা প্রচারের সুযোগ সুলভ এবং অবাধ। সম্পাদকের মনোনয়ন বা অনুমোদনকে তোয়াক্কা না করে অনেকেই যা খুশি তাই লিখছেন, প্রকাশ করছেন, কেউ কেউ পুরস্কৃতও হচ্ছেন।

শ্যামলকান্তি: এটা একটা বিশেষ ধরনের সংকট, অস্তিত্বের সংকট। তবে আমি মনে করি পরিশ্রমের বিকল্প নেই, সততার বিকল্প নেই। একটা পুরস্কার অকবিকে কবি করে দিতে পারে না। প্রকৃত ভালো লেখা থেকে যাবে।

বিশ্বজিৎ: লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে জ্বলদর্চি তিরিশ বছর পেরুলো। পত্রিকাটির এগিয়ে যাওয়ার পথে আপনার কী পরামর্শ?

শ্যামলকান্তি: যে কাগজের সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী তার জন্য আমার পরামর্শের কোনও প্রয়োজন নেই। জ্বলদর্চি অত্যন্ত উন্নত ও সম্ভ্রান্ত একটি কাগজ, সে নিজের গতিতেই আগামীদিনের পথে এগিয়ে যাবে।

বিশ্বজিৎ: আপনাকে জানাই শ্রদ্ধা ও শুভকামনা। আপনি খুব ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

শ্যামলকান্তি: আপনারাও খুব ভালো থাকুন।

🍂
----

Post a Comment

0 Comments