জ্বলদর্চি

প্রতিবিম্ব /মিলি ঘোষ


 প্রতিবিম্ব
 মিলি ঘোষ

দিনে দিনে যেন গরমটা বাড়ছে। এত গরম কি আগে পড়ত ? ঘাম যে খুব হচ্ছে, তা নয়। একদম জ্বালাপোড়া ধরা গরম। 
   প্রবাল, রাকা'র দিকে ঘুরে বলল, "বাবাই বেঁচে গেল, বুঝলে ? ব্যাঙ্গালোরের ওয়েদার একদম অন্যরকম।"
    রাকা নি ক্যাপটা পায়ে গলিয়ে বলল, "না পরলেও হাঁটতে পারব না। আবার এই গরমে এগুলো পরে থাকা যে কী কষ্ট!"
   "চলো, গরমকালটা বাবাইয়ের ওখানে কাটিয়ে আসি। ও তো মাঝেমাঝেই বলে।"

এটা ঠিক, ছেলে অনেকবার ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে থাকার কথা বলেছে বাবা-মা'কে। রাকা স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে। কিন্তু বাবাই এড়িয়ে যায়। রাতে ফোন করলে এই নিয়ে রাকার সঙ্গে লাগে প্রায়ই।
আজকাল সন্দেহ হয় রাকার। 
    প্রবালকে বলেওছে, "বাবাই চুপি চুপি বিয়ে সেরে নেয়নি তো! বিয়ের প্রসঙ্গ এভয়েড করে কেন ? বললেই চোটে যায়।"
    "যদি করেও থাকে, মেনে নাও। তবে, একটু জানালে আমাদের দিক থেকে কিছু কর্তব্য তো আছে, সেটুকু আমরা করে দিয়ে আসতে পারি।"
    রাকা চিন্তিত মুখে বলল, "কিন্তু, না জানানোর কী আছে ? মেয়েটা কি অবাঙালি ?"
    জোরেই হাসল প্রবাল, "তুমি সিওর, যে বাবাই বিয়েটা সেরেই ফেলেছে ?"
   "কে জানে বাবা, কিছুই বিশ্বাস নেই।" কাঁধ ঝাঁকাল রাকা। 

সব ক্ষেত্রেই নিজেকে সেরা বা জয়ী দেখানোর প্রবণতা প্রবালের চিরকালই। বন্ধু মহলে এই নিয়ে চাপা হাসি থাকলেও প্রবালের তাতে কিছু এসে যায় না। মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ছেলের সাফল্যের কথা সাতকাহন করে বলতে তার জুড়ি নেই। বন্ধুদের মধ্যে অঞ্জনের ছেলেই একমাত্র স্কুল শিক্ষক। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই অঞ্জনের কানেই এ'সব ঢালে বেশি। জ্ঞান ট্যান দিতেও ছাড়ে না। তবু অঞ্জনের সঙ্গেই প্রবালের বন্ধুত্ব অন্যদের থেকে একটু বেশির দিকে। সেই স্কুল জীবন থেকে। 

আজ চৈত্রের রোদ আভিজাত্যহীন। যেন স্নেহের পরশ দিতেই আজ তার পৃথিবীতে আসা। এমন সোহাগী আলোয় বসন্তের বাতাস গায় মেখে অঞ্জন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিল।
মোবাইলে রিং হতে প্রবালের নামটা ভেসে উঠল।
   "হ্যাঁ, বল।"
   "একটু দেখা করব। বাইরে।"
   "মানে ? ব্যাঙ্গালোর থেকে কবে ফিরলি ?"
   "সাক্ষাতে বলব।"

শ্রেয়া কাছাকাছিই ছিল।
   চোখ কপালে তুলে বলল, "ফিরে এল!"
   "বলছে তো।"
   "বাড়িতে আসতে বলো। এই দুপুরে কোথায় মিট করবে।"
   "মনে হয় তোমাকে ফেস করতে চাইছে না। যাই দেখি। কী বলে।" 

চাকরি থেকে অবসর নেবার পর থেকে দুপুরের ভাত ঘুমটা অভ্যেসে পরিণত করেছে অঞ্জন। আধ ঘণ্টা কী কুড়ি মিনিট। তবে এটুকু না হলে কোথায় একটা অপূর্ণতার ইঙ্গিত পায় অঞ্জন। ঠিকঠাক প্ল্যাটফর্মে প্রথাগত জীবনের বয়সোচিত অপূর্ণতা। যাওয়ার ইচ্ছা তাই খুব একটা ছিল না অঞ্জনের। তবু, প্রবালের ডাক ফেরাতে পারল না। 
       
প্রবাল দু'টোর আগেই পৌঁছে গেছিল সাউথ সিটি মলের গেটে। অঞ্জন এল মিনিট কুড়ি পরে। 
ফুড কোর্টে বসে প্রবালই শুরু করল।
     বলল, "মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক।"
    অঞ্জন মুখের দিকে তাকাতেই একটু উদাস স্বরে
বলল প্রবাল, "রাকা, আমি কেউই ভালো নেই। বাবাইয়ের হাল ফ্যাশনের বিশাল ফ্ল্যাট। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু ...."
অঞ্জন তাও কিছু বলল না। শুধু প্রবালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
     প্রবাল একটু সময় নিয়ে বলল, "বাবাইয়ের সঙ্গে একটা মেয়ে থাকে। ওই ফ্ল্যাটেই। বাঙালি। বাবাইয়ের থেকে মিনিমাম দশ বছরের বড়ো। ডিভোর্সি। একটা ছেলে আছে, সিক্সে পড়ে। হস্টেলে থাকে।  
আমাদের সঙ্গে ইন্ট্রোডিউস করাল। ওদিকের কোন্ একটা কলেজের প্রফেসর মেয়েটি।"
অঞ্জন ঠোঁটের ফাঁকে হাসছে দেখেও না দেখার ভাণ করল প্রবাল। 

   বলল, "প্রথমে ভেবেছি, পরিচিত তাই আসে। কিন্তু একই রুম শেয়ার করছে দেখে তো আমাদের হাল খারাপ। 
পরে একদিন বলল, ঐ মেয়েটিই নাকি ওর লাইফ পার্টনার।"
     "সে'জন্য চলে এলি ?" হাসতে হাসতেই বলল অঞ্জন। 
🍂

এবারে প্রবাল বেশ একটু বিরক্ত হলো।
    বলল, "তোরা হলে কী করতি ? একটা দিদির বয়সী মহিলাকে ছেলের বৌ করে ঘরে তুলতি ?" 
     "অসুবিধা কোথায় ? আর যাই হোক, ওদের অসম্মান করতাম না। আর বাবাইয়ের থেকে দশ বছরের বড়ো বলছিস। সে তোদের দিদি ?"
প্রবাল বিরক্ত হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে পা নাচাতে লাগল। 
     অঞ্জন আবার বলল, "সমস্যাটা কোন্ জায়গায় ? মেয়েটার বয়স বেশি বলে ? না, ওর ছেলে আছে সে'জন্য ? না কি, ডিভোর্সি বলে ?"
    "ও মেয়ে বাবাইয়ের লাইফ হেল করে ছেড়ে দেবে। বাবাইও যে কী পেল ওর মধ্যে ..."
    অঞ্জন একটু ঝাঁজিয়েই বলল এবার, "থাকতে দে না, ওদের নিজেদের মতো করে। ওদের লাইফ ওরা বুঝে নেবে।"
    "হ্যাঁ, আর আমরা বাবা মা হয়ে সব বুঝেও হাত গুটিয়ে বসে থাকি।" 
     অঞ্জন আবার বলল, "ওদের এই সম্পর্কটা তোরা মানতে পারছিস না, তাই তো ?
প্রবাল উত্তর না দিয়ে বসে থাকে।
অঞ্জন আর বসেনি। 
   বাড়ি যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "এখনও সময় আছে। একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখা। তোর আর রাকার কাউন্সিলিং দরকার।" 

অঞ্জন চলে গেল। প্রবাল একা বসে ভাবতে লাগল। কোথায় যেন সুর নড়ে গেছে। অথচ, সম্পর্কের এই চোরা স্রোত ওপর থেকে কেউ বুঝবে না। 
বাবাই মাস গেলে টাকা পাঠায়। রোজকার মতো রাতে একবার করে বাড়িতে ফোন করে। ওই, কেমন আছ ? ভালো আছি। ব্যাস। 
রাকার চোখের জল, চোখেই শুকিয়ে যায়। 

প্রবাল উঠে টয়লেটে গিয়ে আয়ানায় নিজের মুখ দেখে চমকে উঠল। এ কাকে দেখছে সে ? এ কি সেই আধুনিক মনস্ক প্রবাল সেন ? যে, যুক্তি পাল্টা যুক্তি দিয়ে কফি হাউসের টেবিলে ঝড় তোলে ? বিজ্ঞান মঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে তালি কুড়োয় ? সেই প্রবাল সেন ? 
মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল প্রবালের। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল প্রবাল। 
এবার একটু ফ্রেশ লাগছে। কিন্তু আয়নার দিকে তাকাতেই, এ কী! এত মুখ কেন ? সত্যিই ভয় পেল এবার প্রবাল। আয়নার কাচে শত শত প্রবালের মুখ। কেউ চোখের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল তুলছে, কেউ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। 
প্রবাল আর দাঁড়াতে পারল না। বাইরে বেরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বাবাইয়ের নম্বর সার্চ করল। 
      "এই সময় করলে ? বিজি আছি। আর্জেন্ট কিছু ?"
      "না না। এমনি।"
      "এমনি আবার কী ? মা ঠিক আছে তো ?"
      "হ্যাঁ, হ্যাঁ। সবাই ঠিক আছে। তুই কাজ কর।"
লাইন কেটে দিল বাবাই। 

ফেরার সময় উবারের সিটে হেলান দিয়ে বসে প্রবাল তার এতদিনের পরিচিত কলকাতাকে নতুন করে দেখছিল। ব্যস্ত শহর। সবাই দৌড়চ্ছে। তবু, আপাত কঠোর কলকাতার অলিতে গলিতে কত প্রাণ লুকিয়ে আছে। ভালোবাসার শহর কলকাতা। এখনও বহু জায়গায় পাড়া কালচার টিকে আছে। মানুষের বিপদে এখনও মানুষ ঝাঁপায়। 
কিন্তু প্রবাল ? রাকা ? ওরা তো হেরে গেল  ভালোবাসার কাছে।   
ফোন করেও প্রবাল বলতে পারল না ছেলেকে, "তোরা ভালো থাকিস। আমরা আছি তোদের পাশে।"

Post a Comment

0 Comments