জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল ও জঙ্গলমহল
সূর্যকান্ত মাহাতো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জঙ্গলমহলের বেশ কিছু জায়গায় 'এয়ার ফিল্ড' গড়ে তোলা হয়েছিল। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও গবেষক 'অনিল ধীর' এপ্রসঙ্গে বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শেষ দু বছরে মিত্র বাহিনী উত্তর-পূর্ব দিক থেকে জাপানি আক্রমণের একটা পূর্বাভাস পেয়েছিল। সেই আক্রমন প্রতিরোধেই এই অঞ্চলে একটি স্ট্রিং 'এয়ার ফিল্ড' তৈরি করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল, ঝাড়সুগুড়া, অমরদা রোড, চরবাটিয়া, হিজলি, দুধকুন্ডি, দিগরি, চাকুলিয়া, কলাইকুন্ডা এবং বিষ্ণুপুর বিমান ঘাঁটি। এছাড়াও ছিল 'শালবনি এয়ার ফিল্ড' এবং 'পিয়ারডোবা এয়ার ফিল্ড'। এদের মধ্যে বর্তমানে কেবল 'কলাইকুন্ডা এয়ার ফিল্ড' সক্রিয় আছে। বাকিগুলো বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালেই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে সেগুলো একরকম পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। আমাদের জঙ্গলমহলের শালবনি, পিয়ারডোবা, চাকুলিয়া এবং উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের অমরদা রোড এয়ার ফিল্ডও এখন বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কেবল অতীতের স্মৃতি বহন করছে। অব্যবহৃত হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও উড়িষ্যার 'অমরদা রোড এয়ার ফিল্ড', ঝাড়খণ্ডের 'চাকুলিয়া এয়ার ফিল্ড', এবং বাঁকুড়ার 'পিয়ারডোবা এয়ার ফিল্ড' নিয়ে গঠিত অঞ্চলটি বরং অন্য একটি কারণে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। শিরোনামটি এরকম, "উধাও হয় বিমান, আকছার ঘটে দুর্ঘটনা, ওড়িশার 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল'"(আনন্দবাজার পত্রিকার হেডলাইন, ২৫শে জুন ২০২১) কেন এমন শিরোনাম? কারণ, এই তিনটি এয়ার ফিল্ডকে বিন্দু হিসাবে ধরে তাদেরকে একটি করে কাল্পনিক রেখা টেনে যদি যোগ করা যায় তাহলেই একটি 'ত্রিভুজ' গড়ে ওঠে। এই কল্পিত ত্রিভুজকেই 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল' এর সঙ্গে তুলনা টেনে 'উড়িষ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল' বলা হয়েছে। এমনকি একে ভারতের 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল'ও বলা হয়। "The Times of India" লিখেছে, "according to military historians, at least a dozen aircraft have crashed in the small triangle formed by Piardoba (Bankura) in West Bengal, Chakulia in Jharkhand and Amarda Road Airfield in Odisha." (The Times of India, 4 June, 2015)
এখন প্রশ্ন হল, কেন এই অঞ্চলকে 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল' বলে মনে করা হয়ে থাকে? কারণ, ১৯৪৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই চুয়াত্তর বছরে এখানে ১৬ টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এবং প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৫ জন। (আনন্দবাজার পত্রিকা ২৫ শে জুন, ২০২১)
আমরদা রোড, চাকুলিয়া, এবং পিয়ারডোবাকে নিয়ে গঠিত এই ত্রিভুজ অঞ্চলে যে সমস্ত বিমান দুর্ঘটনাগুলো রহস্যজনক ভাবে ঘটেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল---
১৯৪৪ সালের ৪ মে এখানে প্রথম দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। আমেরিকান লিবারেটর এবং হার্ভার্ড ডে হেভিলেন্ড নামে দুটি বিমানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। ১০ জন ক্রিউ ঐ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।
🍂
প্রথম ঘটনার ঠিক তিন দিন পর অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের ৭ মে একটি লিবারেটর বিমান 'দিগরি এয়ার ফিল্ড' থেকে উড়ে যাওয়ার মাত্র কুড়ি মিনিটের মধ্যেই আছড়ে পড়েছিল। এতেও ১০ জন মারা গিয়েছিলেন।
ঘটনার ৬ দিন পর অর্থাৎ ১৯৪৪ সালের ১৩ মে আরও একটি হেভিলেন্ড বিমান অমরদা স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার পরপরই আছড়ে পড়েছিল।
ওই বছরই ১৯৪৪ সালের ২৮ অক্টোবর আরো একটি বিমান আছড়ে পড়েছিল শালবনির কাছে। সেখানেও ৮ জন মারা গিয়েছিলেন।
তবে ১৯৪৫ সালের ২৬ শে জুলাই এর দুর্ঘটনা ছিল সবথেকে বেশি মারাত্মক। দুটি ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্স B-24 লিবারেটর চার ইঞ্জিন বোমারু বিমান EW225 এবংEW247 এর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল আমরদা রোড এয়ার ফিল্ডে। একেবারে কম উচ্চতায়। ঐ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১৪ জন।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২০শে মার্চ 'হক ফাইটার' নামে একটি বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। যদিও পাইলট কোনক্রমে এই ঘটনায় বেঁচে গিয়েছিলেন।
এখন প্রশ্ন হল, ৭৪ বছরে ঘটে যাওয়া ১৬টি বিমান দুর্ঘটনাকে কেন 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল' এর সঙ্গে কল্পনা করা হল? সেগুলো যে স্বাভাবিক দুর্ঘটনা ছিল না, কে বলতে পারে? তাহলে কেন এই অঞ্চলটি 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের' মতোই 'শয়তানের ত্রিকোণ' নামকরণ করা হল? দুর্ঘটনা তো ঘটতেই পারে! বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে কিংবা চালকের ভুলে দুর্ঘটনা ঘটাই তো স্বাভাবিক! তাই বলে এই অঞ্চলকে বারমুডার সঙ্গে তুলনা টানা কতটা যুক্তিসঙ্গত? তার কারণ হিসাবে 'আনন্দবাজার পত্রিকায়' উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিক্ষেত্রেই "প্রথমত বিমানগুলির মধ্যে কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ ছিল না এবং দ্বিতীয়ত, আবহাওয়াও পরিষ্কার ছিল।(আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫শে জুন, ২০২১) এই অঞ্চল যদি এমন রহস্যজনক হয়েই থাকে তাহলে বাঁকুড়া সংলগ্ন কোথাও তো এমন দুর্ঘটনা ঘটেনি? কিংবা চাকুলিয়া সংলগ্ন কোথাও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে এমনটাও তো জানা নেই। এখানকার বিমান দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে 'অমরদা এয়ারফিল্ডের' কাছাকাছি অঞ্চলে। দুর্ঘটনাগুলোর কারণ হিসেবে ইউরেনিয়াম খনিকে পরোক্ষ ভাবে অন্যতম একটা কারণ বলে মনে করা হয়েছে। কারণ আমরদা বিমান ঘাঁটির খুব কাছেই ঝাড়খণ্ডের 'জাদুগোড়ার' কাছে একটি ইউরেনিয়াম খনি রয়েছে। তার তেজস্ক্রিয়তার ফলেও বৈদ্যুতিন যন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে বলে মনে করা হয়। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫/৬/২০২১) বিমান দুর্ঘটনার সেটাই যদি একটা কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটাই তো প্রকৃত কারণ। তবে কেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর প্রসঙ্গ তোলা? বারমুডার মতো রহস্যই বা কীভাবে হতে পারে?
প্রতিটি ঘটনারই নাকি বিমান প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে অনুসন্ধান করা হয়েছিল। সেই অনুসন্ধানের তারা একটি রিপোর্টও তৈরি করেছিল। কিন্তু সেগুলো গোপনীয়তার কারণে প্রকাশ্যে আনেননি। তাই আমরাও সেই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণটি জানিনা। তবে কি আমাদের এই অজ্ঞতা থেকেই আমরা একে 'বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল' এর সঙ্গে তুলনা টেনেছি? বিশিষ্ট গবেষক 'অনিল ধীর' যেমন বলেছেন, আসলে এমন কোন একক তথ্য নেই যা সমস্ত অন্তর্ধানকে ব্যাখ্যা করতে পারে। ত্রিভুজ এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বিধ্বস্ত হওয়া বিমানগুলো বিভিন্ন পরিস্থিতি ও পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। ক্রাশের অর্ধেক এভাবেই অব্যক্ত রয়ে গেছে। যার ফলেই জল্পনা। (The Asian Age, Akshay Kumar Sahoo, 31st March, 2018)
যাইহোক, পরিত্যক্ত এই এয়ার ফিল্ডগুলোর সামনে দাঁড়ালেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে পড়ে যাবে। এক লহমায় আপনার মন সত্তর থেকে আশি বছর পিছিয়ে যাবে। নিশ্চল নিস্তব্ধ ফাঁকা পড়ে থাকা এয়ার ফিল্ডটার মতো আপনার মনও অতীতের সেই ছবি বা ইতিহাসে পড়া যুদ্ধের কাহিনী মনে পড়বে এবং মনটাও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।
তথ্যসূত্র: ১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫/৬/২০২১
২) The Asian Age, 31/3/2018
0 Comments