দূরদেশের লোকগল্প—ঘানা (পশ্চিম আফ্রিকা)
কচ্ছপ কেন বুক চাপড়ায়
চিন্ময় দাশ
[ কখনও কখনও জেলেদের জালে কচ্ছপও উঠে আসে সমুদ্র থেকে। কচ্ছপ ধরবার কায়দা আলাদা। ধরেই তাকে উলটে দিতে হয়। মানে চিত করে দিতে হয়। তখন দেখা যায়, কচ্ছপটা তার সামনের পা দুটো খুব নাড়াচাড়া করছে। যেন দু’হাত দিয়ে বুক চাপড়াচ্ছে সে।
কেন এমনটা করে কচ্ছপরা? তাই নিয়ে সুন্দর একটা গল্প বলেন উপকূল এলাকার মানুষজন। সেই গল্পটাই এখন শোনাব আমরা।]
শত শত বছর আগের কথা। বন্যা নিয়ে তখন ভারি দুঃখ ছিল ঘানার মানুষজনের। বিশেষ করে, যাদের বাস সমুদ্রের কাছে, হয়রাণির শেষ ছিল না তাদের। বর্ষার দিন এলো, তো দুর্ভাবনা শুরু হয়ে যেত মানুষদের। ভয়াণক গর্জন করতে করতে, প্রতি বছর সমুদ্র উঠে আসবে ডাঙায়। পাড় ভাঙবে সমুদ্রের। ঘরবাড়ি ভাঙবে। খেতের ফসল সাফ করে নিয়ে যাবে। প্রাণও যাবে কতো মানুষের। কতো কিছু যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, তার ইয়ত্তা নাই।
একদিন এক কচ্ছপ জল ছেড়ে উঠে এসেছে পাড়ে। এ সময়টা তাদের ডিম পাড়বার সময় কি না, তাই। ডিম পাড়বার সময় হোল কী, যত কচ্ছপ আছে সমুদ্রের, সব ডাঙায় উঠে আসবে। বালিতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পেড়ে, আবার সমুদ্রে ফিরে যাবে। সময় হলে, ডিম ফুটে, সমুদ্রের জলে ফিরে যাবে বাচ্চার দল।
যাইহোক, একটা কচ্ছপ উঠেছে ডাঙায়। এবার, ডিম পাড়া যায়, এমন নিরাপদ যুৎসই একটা জায়গা খুঁজতে হবে তাকে। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় দেখল, বুড়ো মতন একটা মানুষ বসে আছে একটা ঝাউগাছের তলায়।
গালে হাত। মনে আকাশ-পাতাল ভাবনা। আস্ত একটা কচ্ছপ একেবারে পায়ের কাছটিতে এসে হাজির—সে হুঁশও নাই বুড়োর।
কচ্ছপ হাঁক পেড়ে বলল—কীগো বুড়ো, কিসের এত ভাবনা তোমার?
বুড়ো তাকিয়ে দেখল জলের জীবটাকে। বলল—ভাবনা কি আর একটা, বাছা? কথায় বলে না-- সাগর পাড়ে বাস, ভাবনা বারো মাস। আমাদের ভাবনার কী আর শেষ আছে গো?
--তা একটা ভাবনা তো শোনাও দেখি। জেনে রাখি ব্যাপারটা।
--সবার বড় ভাবনা হোল বন্যা। ফি-বছর এই বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের। অন্য কথা কী বলব, বাছা? গেল বছরের আগের বছর। জোয়ান-মদ্দ ছেলে আমার। জমির আল দেখতে গিয়েছিল। আমরা মা-বাপ পইপই করে মানা করছি। কিন্তু শুনলে তো। সেই যা গেল, আর ফেরেনি।
কচ্ছপ বলল- যে যায়, সে কি আর ফেরে গো? তাছাড়া, মনে দুঃখ পুষে রাখতে নাই। তাতে জীবন সামনে এগোতে পারে না। বরং বিপদের বিহিত করতে হয়। বাঁচা যায় তাতেই।
বুড়ো বলল-- এই রাক্ষসী সমুদ্রের আমরা আর কী বিহিত করতে পারি? পিঁপড়ের মত ছোট্ট জীব আমরা।
কচ্ছপ বলল—নিজেকে ছোট ভেবে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটা আদৌ কাজের কথা নয়। সকল জীবকে একটা করে মাথা দিয়েছে বিধাতা। সেটাকে খাটাতে হয়। মাথা না খাটিয়ে, হা-হুতাশ করলে কি বিপদ তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে?
কথাগুলো বুড়োর আঁতে লেগেছে। বিরক্তির সুরে বলল—উপদেশ দেওয়া খুবই সোজা কথা, বাছা। তাতে কি আর বিপদকে রোখা যায়?
কাজে নেমে পড়ো। চেষ্টা করে দেখো, রুখতে পারো কি না।
বুড়ো বলল—তখন থেকে বকর-বকর করে যাচ্ছো। এবার তোমার পরামর্শটা বলো তো দেখি।
--শোন বুড়ো। আমরা জলের জীব। জলের হালচাল, জলের কেরামতি ভালোই বুঝি আমরা। ফি বছর বন্যা হবে। সে তুমি আটকাতে পারবে না। তাছাড়া, বন্যা তোমার কোন ক্ষতি করে না।
বুড়ো ভুরু কুঁচকে বলল—বলো কী তুমি? বন্যা ক্ষতি করে না?
--ঠিকই বলছি গো, ভালো মানুষের পো। শোন, মন দিয়ে। বন্যা নয়, ডাঙায় এসে ক্ষতি করে যে, সে হোল জলের তোড়। সব তছনছ করে দিয়ে যায়। তা, তোমরা জলের তোড়টাকে আটকাও।
বুড়ো বলল—তা কখনও পারা যায়? জলের তলায় থাকো তোমরা। দেখোনি তার ভয়ঙ্কর চেহারা। আমরা ভালো মতন চিনি তাকে।
কচ্ছপের মুখে হাসি—বলেছিলাম না, মাথা খাটাও। কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। এদিকে আমারও কাজ আছে। এক কাজ করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তোমাদের।
বুড়োর এবার কৌতুহল হয়েছে। হোলই বা জলের একটা পুঁচকে বিদ্ঘুটে জীব। পরামর্শটা শুনতে ক্ষতি কী? বলল—বলো, কী কাজের কথা বলছো।
কচ্ছপ বলল—জলের পাড় বরাবর গাছ লাগিয়ে দাও না কেন? বেশ ঘণ করে লাগাবে। পাঁচ-সাত বছর পরে দেখবে, বেশ একটা পাঁচিল গড়ে উঠেছে পাড় বরাবর। যত বছর গড়াবে, গাছ বড় হবে। গায়ে-গতরেও বাড়বে গাছগুলো। পাঁচিল মজবুত হবে তাতে। তখন থেকে দেখবে, জলের তোড় আর তেমন ক্ষতি করতে পারছে না তোমাদের। গাছে ধাক্কা খেয়ে, দম ফুরিয়ে যাবে জলের তোড়ের। মুখ গোমড়া করে ঘরে ফিরে যেতে হবে। খলখল হাসি আর ফুটবে না জলের মুখে।
বুড়োর মুখে কথা নাই। আসলে, কচ্ছপের কথাগুলো মনে ধরেছে বুড়োর। নেহাত মন্দ নয় তো পরামর্শটা। তেমন তেমন বাধা পেলে, যত বড় শক্তিই হোক, হার মানতেই হয়।
🍂
কচ্ছপ বলল—শোন বুড়ো, এখন হয়ত ভাবছো, অসম্ভব কথা বলছি আমি। কিন্তু কাজে নেমে দ্যাখোই না, সম্ভব হয় কিনা। তবে বাপু, এ কোন একা মানুষের কাজ নয়। অনেকের হাতে-হাত লাগিয়ে, কাজে নামবার ব্যাপার। তোমাকে কঠিন যে কাজটা করতে হবে, তা হোল, লোক জড়ো করা। আমি তো আর সবাইকে ডেকে ডেকে বোঝাতে যেতে পারব না।
বুড়ো বলে উঠল—পারব আমি এটা। আমি হোলাম গিয়ে পাঁচ গাঁয়ের মোড়ল। সবাই মাথা নেড়ে শোনে আমার কথা। শুনবেও তারা। যে কাজে সবার ভালো, কেন শুনবে না? সবাই শুনবে সে কথা।
--তাহলে, আর কী? কাজ শুরু করে দাও। কচ্ছপ বলল—যদি করে উঠতে পারো, তাতে আমাদেরও উপকার হবে।
বুড়ো বলল—তোমাদের আবার কী উপকার হবে গাছ লাগালে? বুঝলাম না কিছু।
মুখে হাসি কচ্ছপের—গাছগুলো যখন বড় হবে, শেকড় মোটা আর পোক্ত হবে তাদের। সেই শেকড়ই তো জলের তোড় আটকাবে। বালি ধুয়ে যেতে দেবে না। পাড় ভাঙতে দেবে না। তখন সেই শক্তপোক্ত শেকড়ের তলায় এসে, ডিম পেড়ে যেতে পারব আমরা। ডিম আমাদের নিরাপদ থাকবে শেকড়ে খোঁদলে।
অনেক সময় কেটে গিয়েছে। কচ্ছপ চলে গেলে ডিম পাড়বার জায়গা খুঁজতে। বুড়োও ফিরে চলল ঘরমুখো হয়ে।
পরামর্শটা ছোট্ট এক জীব কচ্ছপের। কিন্তু কাজটা আসলে অনেকই বড়। তবে, পেরেছিল বুড়ো মোড়ল। তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল সবাই। সব্বাই হাত লাগিয়েছিল কাজে।
কয়েকটা বছরের কিছু মেহনত। তাতে ফল ফলেছিল খুব। সত্যিই শেকড়ের বাঁধ আটকে দিতে পেরেছিল বাহুবলী জলকে। জলের তোড় বছর বছর লম্বা জিভ বের করে কামড় দিতে এসেছে। গাছের পায়ে মাথা খুঁড়ে, ফিরেও গিয়েছে নিজের জায়গায়। পাড়ের বালি গিলে খাওয়া আর সাধ্যে কুলোয়নি সাগরের।
অনেক নিশ্চিন্ত হয়েছে গাঁয়ের মানুষজন। সমুদ্রের পাড় ভাঙে না আর। ঘরবাড়ি ভেসে যায় না। খেতখামার সাফ হয়ে যায় না। জোয়ানমদ্দ ছেলে মারা যায় না কারও। ছোট্ট একটা জীব অনেক বড় উপকার করে গিয়েছে মানুষের।
কিন্তু গল্পের মত এ ঘটনা তো অনেক অনেক কাল আগের। ভুলেও গিয়েছে মানুষজন। সামান্য কৃতজ্ঞতাও আজ আর নাই মানুষের। তাই তো, একটা কচ্ছপকেও যদি পাড়ে উঠছে দেখতে পায়, আর রেহাই নাই। দৌড়ে এসে, খপ করে ধরে ফেলবে। কেন না, নরম মাংসা আছে যে, কচ্ছপের শক্ত খোলটার ভেতরে!
দুর্বল, আসহায় পুঁচকে একটা জীব কচ্ছপ। ধরা পড়ে গেলে, কী আর করতে পারে সে। ছুটে পালাবার সাধ্য নাই তার পায়ে। তাছাড়া, পালাবে কোথায়? পালাবার কি জো আছে তার? তখন যে ডিম পাড়বার সময় কচ্ছপদের।
দৌড় লাগাবার সুযোগটাও থাকে না আদৌ। লোকেরা ধরেই, উলটে চিৎ করে দেয় কচ্ছপকে। তার সব কেরামতি শেষ হয়ে যায় তখন।
বিধাতা পুরুষের বাস নাকি আকাশে। সেই দিকে তাকিয়ে, কচ্ছপ তখন বুক চাপড়াতে থাকে সামনের দুটো পা দিয়ে। আর বলতে থাকে—হায় ঠাকুর, একদিন সুপরামর্শ দিয়েছিলাম আমরা মানুষকে। এই কি তার প্রতিদান? জীবন রক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলাম আমরা মানুষকে। প্রতিদান হিসাবে, মৃত্যু দিচ্ছে তারা আমাদের। এই তোমার বিচার, ঠাকুর?
0 Comments