মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭৫
সুকুমার রায় (নট নাট্যকার, হাউর, পূর্ব মেদিনীপুর)
ভাস্করব্রত পতি
খুব ছোটবেলার কথা। প্রথম থেকেই যাত্রা, নাটক দেখার প্রতি একটা ঝোঁক ছিল তাঁর। তখন এতো টিভি, মোবাইলের দাপট ছিলনা। কিন্তু তাই বলে তো ভালোবাসার জিনিসগুলো উপেক্ষিত রাখা চলেনা! যাত্রার প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। তাই মন উড়ে চলে যেত যাত্রার বাঁশির শব্দ, ভিলেনের হাসি, নায়িকার চোখের জল আর নায়কের আবেগী গান শোনার জন্য। বাবার চোখ এড়িয়ে ইতিউতি ঢুঁ মারতেন শ্বাপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে যাত্রার আসরগুলোতে। আর গালে টালিগুঁড়ো মেখে সঙ সেজে কাল্পনিক ডায়লগ আওড়াতেন। হয়ে উঠতেন রাজা, উজির, পেয়াদা কিংবা সাধারণ জনগণ।
সেসময় খুব জনপ্রিয় ছিল স্বপন কুমার অভিনীত 'দেবদাস', নিউ প্রভাস অপেরার অভয় হালদার অভিনীত ‘বিপ্লবী ভিয়েতনাম', মোহন চ্যাটার্জীর 'ভুলি নাই’, শান্তি গোপালের 'হিটলার' এবং আরও নানা যাত্রাপালা। এসব তাঁকে টানতো খুব। মনের মধ্যে ঠাঁই পেয়েছিল ঐসব যাত্রার চরিত্রগুলো। নিজেকেই মনে হত তখন 'শার্দুল জারাখ্খান'! যাইহোক, আজকের মেদিনীপুরের মানুষ রতন সেই ব্যক্তিকে নিয়ে আলোকপাত করছি, যে কিনা বসবাস করতেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হাউরে। ইনিও সুকুমার রায়। তবে আবোল তাবোলের স্রষ্টা নন। অসংখ্য যাত্রা পালার স্রষ্টা সুকুমার রায়। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে যিনি প্রথম অভিনয় শুরু করেন (বাচ্চার রোল), তিনিই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন যাত্রা জগতের এক অন্যতম নাম। মেদিনীপুরের গর্বের নট ও নাট্যকার।
পূর্ব মেদিনীপুরের হাউরের নট ও নাট্যকার সুকুমার রায় এরাজ্যের যাত্রামােদী দর্শকের কাছে অতি পরিচিত নাম। প্রায় ৭০ টির বেশি পালাগান লিখেছেন তিনি। ১৯৮১ তে 'রাজা সাহেব' পালার জন্য বিহার সরকার থেকে সম্মানিত হন। মহাজাতি সদনে ১৪১১ তে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা উৎসব থেকে দেওয়া হয় তাঁকে স্বর্ণপদক। ১৯৭৬ এ তাঁর লেখা প্রথম যাত্রাপালা 'নতুন সূর্য' মঞ্চস্থ হয় হাউর রাইস মিলে। পাঁচ ঘন্টা ধরে অভিনয় হয়েছিল। হাউরের কার্তিক মাইতি ভীষণ সাহায্য করেন সেসময়। এরপর তিনি লিখেছেন 'আমি সীতা হতে চাইনা' (যাত্রাদূত), সাতদিনের স্বামী (তারা মা অপেরা), মানুষকে বিশ্বাস নেই (দিগ্বিজয়ী অপেরা), পাপের আগুনে জ্বলছে প্রতিমা (ইষ্টবেঙ্গল), কলির পরের ষ্টেশন, কোন সে আলাের স্বপ্ন নিয়ে, বিয়ের নামে ব্যবসা (তারা মা অপেরা), কমলা কেমন আছাে, আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না, চাকরি করা বউমা (চন্দ্রলােক অপেরা), ওগাে বাংলার বধূ, কলির কৃষ্ণ কাঁদছে (শ্ৰীদুর্গা), বাঘিনী বউ নাগিনী শাশুড়ি (শিল্পাঞ্জলী), পতি পত্নী পতিতা (দিগ্বিজয়ী অপেরা), ভদ্রলােকের কথার দাম নেই (কল্যানী অপেরা), ভােটে দাঁড়াচ্ছে বউ (গন্ধর্ব অপেরা), কাজলা দিঘির কালো বউ (গন্ধর্ব অপেরা), আমি সীতা হতে চাইনা, প্রেম করব পুরুষ চাই (যাত্রাদূত), মেয়েরা মেয়েদের শত্রু, সাত দিনের স্বামী (তারামা), ময়লা কাগজের মল্লিকা (বিষ্ণুলোক), আমি যে মন্দ মেয়ে মন্দিরা (মা করুণাময়ী) ইত্যাদি।
এর মধ্যে ১৯৭ এর বেশি রজনী অভিনীত হয়েছিল 'ভোটে দাঁড়াচ্ছে বউ' পালাটি। মহিলাদের ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার জোটায়, সেই বিষয়কে সামনে রেখেই এগিয়েছে এই পালা। 'বউ কিনেছি রথের মেলায়' যাত্রাপালার জন্য ১৯৯৯ সালে সুকুমার রায়কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর কর্তৃক শ্রেষ্ঠ পালাকার হিসেবে সম্মানিত করে। এতে অভিনয় করেছিলেন সন্ধ্যা রায়, তাপস কুমার এবং স্বয়ং সুকুমার রায়। সন্ধ্যা রায় পেয়েছিলেন সেরা অভিনেত্রীর সম্মান। তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ পালাগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'মায়ের চোখে ঘুম নেই' এবং 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী'। 'মায়ের চোখে ঘুম নেই' এর বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ নানা জ্বলন্ত বিষয়। অভিনয় করেছিলেন রুমা দাশগুপ্ত।
তাঁর নিজের লেখা শ্রেষ্ঠ পালা হল 'মায়ের চোখে ঘুম নেই' (নাট্যধারা)। আর তাঁর অভিনীত যে পালায় তিনি সেরা অভিনয় করেছেন তা হল 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী'। এখানে তিনি নায়ক ‘সুমন্ত’-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই ‘মায়ের চোখে ঘুম নেই' পালায় শ্ৰেষ্ঠ নির্দেশনার জন্য সেরা নির্দেশকের পুরস্কার পান উজ্জ্বল সেনগুপ্ত।
কথায় বলে, উঠন্তি মূলোর পত্তনেই চেনা যায়। যাত্রামোদী সুকুমার রায়ের রক্তেই ছিল যাত্রার বীজ। পাড়ায় যখন নাটক অনুশীলন হত, তখন তিনি বসে বসে দেখতেন। কোনও অভিনেতা না এলেই তাঁর হয়ে প্রক্সি দিতেন। অনিল পণ্ডিত তখন মেদিনীপুরের বিখ্যাত যাত্রা শিল্পী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে অভিনয় করার জন্য দশম শ্রেণী তে পড়তে পড়তেই বাড়ি থেকে চলে যান হুগলি। সেসময় ট্রেনে কাটা হতে হতেও বেঁচে যান। অভিনয়ের নেশায় ছাগলের খোঁয়াড়েও রাত কাটিয়েছেন অবলীলায়। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে খুলে ফেললেন 'শুকতারা' ক্লাব। যাঁদের কাজ ছিল নাটকের মহড়া দেওয়া। তখন তিনি গান লেখেন -- 'ইয়া হিয়া খান / তুমি বড়ই বেইমান'। এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেসময়। মঞ্চস্থ করলেন নাটক 'সারথী থামাও রথ'। তখন তিনি ঘোষপুর হাইস্কুলের ছাত্র। স্কুলের বার্ষিক পত্রিকাতে লিখে ফেললেন নাটক -- 'নায়িকা নিহত'। ভবিষ্যতের নাট্যকারের বীজ পোঁতা হয়ে গেল ওখানেই। অঙ্কুরিত হতে লাগলো কিশোর সুকুমার রায়ের কলমের ডোগা। ভবিষ্যতের সফল নাট্যকার হওয়ার জরায়ুজ অঙ্কুরোদগমের সফল প্রয়াস ঐ স্কুল ম্যাগাজিন।
সুকুমার রায় শুধু প্রতিভাবান নাট্যকার নন, সুঅভিনেতা ও দক্ষ নির্দেশক হিসাবেও তাঁর উজ্জ্বল কৃতিত্বের সাক্ষর তিনি রেখেছেন। সহজ সরল অনাড়ম্বর নিরহঙ্কারী আপাদমস্তক ভদ্র এই নাট্যব্যক্তিত্বের জীবনরেখায় অনেক ওঠা নামার চিহ্ন রয়েছে। বয়স মাত্র ৫৩। বাবা ক্ষুদিরাম রায় ও মা সোনারানীর দারিদ্র-সিক্ত পরিবারে সুকুমারের জন্ম। আদি বাড়ি মেচেদার শান্তিপুরে। পরে জীবনযুদ্ধের পথ ধরে বাবা চলে আসেন। হাউরে। সেই থেকে পরিবারের সবাই হাউরে। হাউর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষারম্ভ। ১৯৭৬ সালে ঘোষপুর হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৯৭৭ সালে নাটক নিয়ে পড়ার জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ২ বছর পড়ার পর তা আর সম্পূর্ণ করতে পারেননি দারিদ্রতার জন্য। নাটক নিয়ে পড়ার সময় তিনি কুমার রায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত প্রমুখ দিক্ পাল নাট্যব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে ছাত্র হিসাবে এসেছিলেন। সুকুমার রায়কে দেখে একদিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন 'এই ছেলেটা একদিন পারবে'।
অত্যন্ত সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন ছিল তাঁর। হাউরের মতো প্রত্যন্ত অপরিচিত এলাকায় থাকতেন। যাত্রা দলের ম্যানেজাররা বিভিন্ন সময়ে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতেন সেখানে। যাত্রার সিজন শুরুর আগেই অর্ডার পড়ে যেত পালাগান লেখার জন্য। আর এই নিরহঙ্কারী আপাদমস্তক ভদ্র এই নাট্যব্যক্তিত্বটি সুবিধামতো সকলের চাহিদা পূরণ করতেন হাসিমুখে।
যাত্রাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে উৎসাহ পেয়েছেন হরিপদ সামন্ত, বলাই দাস, লক্ষ্মীকান্ত সামন্ত, অনস্ত সামন্ত, শশাঙ্ক শেখর সামন্তদের কাছ থেকে। সেইসাথে সাহচর্য পেয়েছেন অজিত লাল, কার্তিক মাইতি নগেন্দ্রনাথ রানা লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডলদের থেকে। সকলের মিলিত ভালোবাসায় জীবনের নানা বাঁকে পেয়েছেন বটপাতার ছাতার মতো আশ্রয়। কলকাতাতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে বাবু ঘোষ, নিমাই রায়, গোপাল পাত্রদের। বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করার পর অবশেষে অভিনয় করলেন 'জালিম খাঁ' পালায়। জীবনের প্রথম। আর থেমে থাকার উপায় নেই। যাত্রার রোমাঞ্চ যে তাঁকে ডাকছে।
যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন তিনি লেখার অনুপ্রেরণা বেশি পেতেন। আর গভীর রাতে তাঁর কলম সৃষ্টি করতো অসাধারণ সব চরিত্র এবং ডায়লগ। মুড়ি তেলেভাজা খেয়েই তাঁর লেখা খোলতাই হত। প্রথমে একটি প্লাটফর্ম ভেবে নেন যাত্রার। তারপর চলতে শুরু করে নাটক লেখার গতি। যাত্রা সূত্রে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও গিয়েছেন আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, মনিপুর, ওড়িশা ইত্যাদি।
তাঁর নাট্য জীবনে বিভিন্ন সময়ে সংস্পর্শ পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ভৈরব গাঙ্গুলী, প্রসাদ ভট্টাচার্য, ব্রজেন দে, কাকলী চৌধুরী, কৃষ্ণা চক্রবর্তী, ত্রিদিব ঘোষ, পল্লব মুখোপাধ্যায়, চাঁদ চক্রবর্তী, গুরুদাস ধাড়া, জ্যোৎস্না দত্ত, বীণা দাশগুপ্ত প্রমুখ যাত্রা জগতের রথী মহারথীদের সাথে। আজ সুকুমার রায়রা নেই। যাত্রার সেই ঐতিহ্যবাহী পরিবেশও আজ আর নেই। নেই সেই টানটান উত্তেজনার পালাগান। নেই দর্শক।
0 Comments