জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নির্মলকুমার বসু/ নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নির্মলকুমার বসু 
নির্মল বর্মন 

প্রাবন্ধিক নির্মলকুমার বসু গান্ধীবাদী দর্শনে বিশ্বাসী, বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ, গবেষক, ও   প্রাবন্ধিক।সারাবছরভোর, সারাজীবন  নানা গবেষণা কর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে দেশ সমাজ সংস্কৃতিজগতে পাক্কা আসন করে নিয়ে ছিলেন। গ্ৰাম ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতি, সাহিত্যে পরিবর্তনের ধারা, ভারতের দেবদেবী,মন্দির-স্থাপত্য, লোকসংস্কৃতি, লোককথা, লোকগান,গ্রামজীবন ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা শুধু বিদগ্ধমহলে নয় দেশ বিদেশের বহু ভক্তের হৃদয়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। মানুষের জীবনধারাকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করার জন্য তিনি সমগ্র ভারত পদব্রজে ভ্রমণ করে ভারতবাসীর মন জয় করেছিলেন। শুধু গবেষণাই নয়, সাহিত্যকর্মে উৎসাহী এক সেবক ছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদকের দায়িত্ব  নিষ্ঠা ও  যত্নসহকারে পালন করেছেন এবং সাহিত্য পরিষদ-এর 'ভারতকোষ' ভাবনার তিনি অন্যতম স্রষ্টা ও পথিকৃৎ।

 সাহিত্যিক নির্মলকুমার বসু ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বি. এস. সি. তে ভূতত্ত্ব বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স এবং ১৯২৫-এ নৃতত্ত্ব বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে এম.এস.সি পাশ করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রনেতা সুভাষচন্দ্র বসু'র সংস্পর্শে এসে নানাবিধ  ও বিশেষ ধরনের সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত লাভ করেন। ১৯৩০-এ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব শাখার রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্ম  করার সময় গান্ধীজীর বলিষ্ঠ আহ্বানে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ গ্ৰহন করেন। ১৯৪২-এর "ভারত ছাড়ো" আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয়বার কারাদণ্ড ভোগ ও মানসিক চাপ সহ্য করেন। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময়  নির্মলকুমার গান্ধীজীর একান্ত সচিবেরগুরুদায়িত্ব পালন করেন। গান্ধীজী সম্পর্কে নির্মলকুমারের মূল্যায়ন সম্পর্কিত গ্রন্থ হল "মাই ডেজ উইথ গান্ধীজী"।
🍂
প্রাবন্ধিক নির্মলকুমার বসু'র প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গ্ৰাম ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের ধারাকে নিখুঁতভাবে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করা। এজন্য তিনি নৃতত্ত্বের পদ্ধতির সঙ্গে হিউম্যান জিওগ্রাফি, মানবপ্রকৃতি বিজ্ঞানের সামাজিক ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে বিদগ্ধমহলে সুনাম অর্জন করতে পেরেছেন।
ড.নির্মলকুমার বসু'র উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল : "পরিব্রাজকের ডায়েরি", "বিদেশের চিঠি", "নবীন ও প্রাচীন", "হিন্দু সমাজের গড়ন" ইত্যাদি।
সাহিত্যিক নির্মলকুমারের বিজ্ঞানী চেতনার অন্তরালে যে কবিপ্রাণতা ও দার্শনিক উপলব্ধির স্রোত লুক্কায়িত ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর রচিত ‘পরিব্রাজকের ডায়েরী' গ্রন্থে। শরৎচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত 'ম্যান ইন ইন্ডিয়া' পত্রিকাখানির সম্পাদকরূপে বসুসাহেব প্রায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন।
প্রাবন্ধিক নির্মলকুমার বসু মহাত্মা গান্ধীর "বর্ণাশ্রম এবং কমিউনিজম" প্রবন্ধে রাশিয়া ও গ্রাম ভারত সমাজের তুলনামূলক সমালোচনা করে উভয়ের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য ভাবনা সামনে নিয়ে এসেছেন। এই ভাবনার মূল সূত্র গুলি হল:-
১."উভয় দেশেই সকল জাতিই স্বীয় ধর্ম, আচার অথবা মোটের উপর তাহাদের সংস্কৃতির বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করে।”

২.উভয়ের প্রভেদ সম্পর্কে সমালোচনা : ক.“অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্যের আদর্শের কোনো প্রমাণ না থাকিলেও প্রাচীন ভারতবর্ষে ধন-বৈষম্যের দোষকে পুণ্যবুদ্ধি জাগ্রত করিয়া খানিকটা উপশম করিবার ব্যবস্থা ছিল।” অন্যদিকে রাশিয়ায় “ব্যক্তিবিশেষের ভোগসামগ্রীর উপর মালিকানা স্বত্ব স্বীকার করিলেও ধনোৎপাদনের সাধনের উপর তাহার কোনো স্বত্ব স্বীকৃত হয় না।” খ. “প্রাচীন ভারতবর্ষে এবং বর্তমান রাশিয়ার মধ্যে ধনবন্টনের আদর্শের বিষয়ে যেমন প্রভেদ ছিল, রাষ্ট্র শাসনের অধিকার বিষয়েও তেমনই আছে। সেইজন্য রাশিয়াতে রাষ্ট্রের প্রকৃত অধিকার সংখ্যালঘিষ্ঠ ধনিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির হাত হইতে ধনোৎপাদক শূদ্রশ্রেণির হাতে পরোক্ষভাবে পর্যবসিত হইয়াছে।” গ.গান্ধীজীর আদর্শের সঙ্গে কমিউনিস্টদের আদর্শের যে অমিল তাও দ্বার্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন —“কমিউনিস্ট গণের সহিত আদর্শ হিসাবে ধনসাম্যে বিশ্বাসী হইলেও গান্ধীজী শুধু শূদ্রগণের স্বার্থপুষ্টির চেষ্টাকে কর মনে করেন না। তিনি সর্বদাই সমগ্র মানবসমাজের কল্যাণের দৃষ্টিতে কাজ করিতে চান ।  ইহা বলশেভিকগণের সহিত তাঁহার একটি বড়ো প্রভেদ। আরও একটি প্রভেদ আছে, তাহা সাধনোপায় লইয়া।”

প্রাবন্ধিক নির্মলকুমার বসু'র তথ্য ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ এধরনের সমস্যা মূলক ও তুলনামূলক সমালোচনা বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের  বিশেষ সম্পদে পরিণত হলেও কালের নির্মম পরিহাসে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ।

Post a Comment

0 Comments