জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —১৯/সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —১৯
সুমিত্রা ঘোষ

রানি গৃহী জীবন যাপন করতেন অথচ রঘুনাথ জীউ এবং শ্রীশ্রী জগন্মাতার উপর তাঁর অচলা ভক্তি ছিল। নিয়মিত দেবার্চনা, জপ-তপ, শাস্ত্র ও পুরাণাদি পাঠ শোনা এসব তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। ধর্মপরায়ণতার পাশাপাশি তাঁর অন্তরে ছিল দুঃস্থ ও আর্তের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ, অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করার সাহস, ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে রানি তাঁর জমিদারির প্রজাদের স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন একবার।
একসময় তদানীন্তন সরকার গঙ্গায় মাছ ধরার উপর কর বসালেন। অর্থাৎ ধীবররা বিনা পয়সায় মাছ ধরতে পারবেন না। গরীব ধীরবরা প্রথমে সরকার পক্ষের লোকদের কাছে আবেদন রাখলেন যাতে তাদের মাছ ধরতে বাধার সৃষ্টি না করা হয়। কারণ মাছ ধরার বিনিময়ে তাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা অত্যন্ত গরীব জেলে। অগত্যা ধীবরগণ যখন দেখল সরকারপক্ষের লোকের কাছে আবেদন-নিবেদন করে কোন লাভ হবে না তখন ধীবররা রানির কাছে অভিযোগ জানাল। রানি তাদের কাছে সাক্ষাৎ মাতৃস্বরূপা। রানি প্রজাদের কথা শুনে, তাদের কিছু না বলে কিভাবে ধীবরদের উপর ধার্য জলকর বন্ধ করা যায় সেই চিন্তা করতে লাগলেন। চিন্তা ভাবনার পর রানি দশ হাজার টাকায় সরকারের কাছ থেকে ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গার পুরো অংশটি জমা নিলেন। তখন জমা নেওয়া অংশে ইংরেজ সরকারের আধিপত্য রইল না। ঘুসুরি থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত গঙ্গার পুরো অংশটি জমা নিয়েই শান্ত থাকেননি, যখন তিনি দেখলেন দশ হাজার টাকার বিনিময়ে  ইংরেজ সরকার ইজারা পত্র দিয়ে দিয়েছেন, তখন রানি কৌশল করে বাঁশ ও লোহার শেকল দিয়ে গঙ্গার ওই অংশটুকু এমন কায়দায় ঘিরে দিলেন—যার ফলে ঐ অংশে জাহাজ ও নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল।
এদিকে গঙ্গার খানিকটা অংশ ঘিরে দেওয়ায় রানির প্রজারা  (ধীবররা) স্বচ্ছন্দে মাছ ধরতে লাগল বিনা জল করে । অন্যদিকে সরকার পক্ষ চরম বিপদের সম্মুখীন হল কারণ গঙ্গার ঐ অংশ ঘিরে দেওয়ার ফলে জাহাজ নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হতে লাগল সরকার পক্ষের। এই ব্যাপারে সরকারপক্ষের বোকামী হয়েছিল কারণ দশ হাজার টাকার ইজারাপত্র দেওয়ায় ঐ অঞ্চলের উপর আর অধিকার রইল না। রানি ঐ সুযোগের সদব্যবহার করে ধীবরদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। রানি সর্বদা অনাথ- আতুর-গরীবদের সাহায্য করতেন। এই সমস্ত লোকদের সেবা করার জন্যই তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়েছেন। সেজন্য রানি রাসমণির নামের পূর্বে করুণাময়ী এই বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে। তাঁর করুণার সীমা- পরিসীমা ছিল না। যাই হোক গঙ্গার খানিকটা অঞ্চলে জাহাজ নৌকো চলাচল বন্ধ হওয়ায় সরকার পক্ষ বিষম সমস্যায় পড়ে রানিকে ইজারার টাকা ফেরৎ দিলেন এবং জলকর বাবদ ধীবরদের কাছে কোন অর্থ নেবেন না বলে চুক্তি করলেন রানির সঙ্গে। গঙ্গার ভেতর থেকে বাঁশ লোহার শেকল তুলে দেওয়া হল । মা গঙ্গা শৃঙ্খলমুক্ত হলেন। রানি রাসমণি ছিলেন প্রজাবৎসল, সেবাপরায়ণা রানি। সেবার ইংরেজ সরকারের এভাবে হার স্বীকার করে নেওয়ায় দেশবাসী যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলেন, রানিকে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন বাংলার মানুষ। কেউ কেউ রানিকে নিয়ে গানও বেঁধেছিল।
সামান্য লেখাপড়া জানা গ্রাম্য মেয়ে হলে কি হবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানির প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় নানান কাজের মধ্য দিয়ে। জানবাজারের জমিদারবাড়ির পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন এবং রাজরানী হয়ে বিষয়জ্ঞানে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে সকলকে অবাক করে দিয়েছেন। সেই সময় বিদেশী শাসনে ভারতে শান্তি শৃঙ্খলা ছিল না।
ক্রমশ
🍂

Post a Comment

0 Comments