বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে -৪
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
এরপরে বসুদের অবাক হয়ে দেখলেন শ্রীহরি শিশুরূপ ধারণ করেছেন। তিনি এখন - " নগ্নং ভূমৌ শয়ানঞ্চ দদর্শশ্যামলং সুতম্। দৃশ্যতা স বালকং তত্র মোহি তো বিষ্ণুমায়য়া"।। বসুদেব ভাবলেন আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? শ্যামসুন্দর পুতুলের মতো এতোটুকু এক শিশুর রূপ ধরে নগ্ন অবস্থায় ভূমিতে শয়ান করে হাত পা ছুঁড়ে খেলা করছে। বেশী সময় চিন্তা করার সময় নেই। মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত। বসুদেব শিশু কৃষ্ণকে কোলে নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন। যোগমায়ার প্রভাবে কারাগারের সমস্ত দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে লেখা হল - " তাঃ কৃষ্ণবাহে বসুদেব আগতে। স্বয়ং ব্যবর্যন্ত যথা তমো রবেঃ। ববর্ষ পর্যন্য উপাংসুগর্জিতঃ। শেষোয়ন্যগাদ বারি নিবারয়ন ফনৈঃ।" বসুদেব কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতেই তুমুল বৃষ্টিপাত ও মেঘগর্জন শুরু হল। বিস্তৃত যমুনাতীরে আসতেই স্বয়ং অনন্তদেব সহস্র ফণা বিস্তার করে বৃষ্টি নিবারণের জন্য বসুদেবের পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। শ্রীরামচন্দ্রকে যেভাবে সমুদ্র দেবতা দুস্তর পারাপারের পথ দেখিয়েছিলেন যমুনাও তেমনি বসুদেবকে পথ দেখালেন। এদিকে যমুনার বিস্তৃত রূপ দেখে বসুদেবের মন ভারাক্রান্ত হল। তিনি একবার ছেলের মুখ দেখেন আর ভাবছেন গৃহশত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করেও বুঝি শেষ রক্ষা হবে না। শান্তস্বভাবা যমুনার আজ একি রূপ! কৃষ্ণ বসুদেবের মনের কথা বুঝতে পেরে একবার শুধু যমুনার দিকে তাকাতেই যমুনা তাঁর বিস্তৃত রূপ ত্যাগ করে ক্ষীনা জানুবহ হলেন। বসুদেব দেখলেন যমুনার জল কমে গিয়ে হাঁটু জল হয়ে গেল এবং একটি শৃগাল তাঁর সামনে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁর মনে হলো না যে যাঁকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি তো স্বয়ং ভগবান। আর সম্মুখের শৃগালটি তো তারই মায়াশক্তি। বসুদেব নিঃশঙ্কচিত্তে এগিয়ে চললেন। এদিকে যমুনার মনে পড়ে গেল গোলকধামের পূর্বকথা। সেখানে যে তিনিই ছিলেন কৃষ্ণের প্রিয়তমা সখী বিরজা। গোলকধাম থেকে আসার সময় কৃষ্ণ বলেছিলেন " সখী, পৃথিবীতে আমি আবির্ভূত হয়ে প্রথমে তোমার সাথে মিলিত হব"। পূর্বস্মৃতি স্মরণ করে যমুনা আনন্দে উথলে উঠলেন। যমুনা তাঁর প্রিয়তমের স্পর্শ চাইলেন। প্রিয়তমার মনের কথা বুঝতে পেরে কৃষ্ণ বসুদেবের কোল থেকে হঠাৎ করে যমুনার জলে পড়ে গেলেন। বসুদেবের কোল থেকে কৃষ্ণ যমুনার জলে পড়ে যেতে বসুদেব হায় হায় করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্নায় ভগবানের হৃদয় করুণায় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। যমুনার সাথে জলক্রীড়া শেষ করে পুনরায় বসুদেবের হাতে ধরা দিলেন। এই সময়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সৃষ্টির প্রারম্ভে বটপত্রশায়ী হয়েছিলেন যে রূপে, সেই রূপ ঝড়ের রাতে বসুদেবকে একটুখানি দেখিয়ে দিলেন। আনন্দ ফিরে এলো। নরম গোলাপী পদ্মের মতো তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, পদ্মের মত নরম হাতের আঙুল দিয়ে তিনি তখন লাল ঠোঁটের মধ্যে চুষছেন। সদ্যোজাত জন্মহীন ত্রিভূবনেশ্বরের একি লীলা!
বসুদেব নির্বিঘ্নে যমুনা পেরিয়ে নন্দালয়ে যেয়ে দেখলেন যোগমায়ার প্রভাবে ব্রজবাসীগণ গভীর নিদ্রায় মগ্ন। বসুদেব সুতিকাগারে সন্তর্পনে যশোদার শয্যায় নিজের পুত্রকে রেখে যশোদার কন্যাকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে চললেন। এ তো যে সে মেয়ে নয়, মহামায়া স্বয়ং যশোদার গর্ভে আবিভূতা। তিনি অঘটন ঘঠন পটিয়সী। তাঁরই মায়ায় মুগ্ধ জীব, সকল সংসারমুখীকে স্বরূপ ভুলিয়ে রাখেন তিনি। যশোদা ও তাই তাঁকে টের পেলেন না। এবারে যশোদার ঘুম ভাঙলো, ঘর আলো করে নবনীরদবরণ পুত্রের মুখ দেখে তাঁর সে কি আনন্দ। লোকে জানলো নন্দ রাজার ছেলে হয়েছে, ব্রজে আনন্দের হাট বসলো।
বসুদেবের মন খারাপ। নিজের ছেলেকে রেখে এলেন নন্দ রাজার বাড়িতে আর তার মেয়েকেই কিনা তুলে দিতে হবে জল্লাদ কৃষ্ণের হাতে। জল্লাদের যে অকার্য কিছু নেই। মহামায়ারূপী যশোদার কন্যাকে তিনি দেবকীর কোলের কাছে না রেখে দেবকীর পাশে রাখতেই পূর্বের ন্যায় কারাগারের লৌহ কপাট বন্ধ হয়ে গেল। তাদের হাত পা পূর্বের ন্যায় শিকলে বাঁধা পড়ল। নবজাতিকার ক্রন্দনে প্রহরীদের তন্দ্রা কেটে গেল। তারা কংসের কাছে খবর পাঠালেন। ভোজরাজ কংস বিছানায় শুয়ে আছেন। চারপাশে সজাগ প্রহরী। দেবকীর সন্তানের কান্না শোনা গেছে। সেই কান্না শুনে কংসের বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। ভয়ে তিনি ঘামতে লাগলেন। হাত পা চঞ্চল হয়ে উঠল। তাঁর তখন বড় অস্বস্তি হচ্ছে। এই সেই দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান - তাঁর নিয়তি। বিভ্রান্ত স্থলিত পদক্ষেপে যমের মত উগ্র মূর্তি নিয়ে কংস ছুটে এলেন কারাগারে। কংস এসে দেখলেন দেবকীর পাশে এক নবজাতিকা হাত-পা নেড়ে খেলা করছে। কংস শিশু কন্যাটিকে ধরতে যেতে বসুদেব ও দেবকী বললেন " মহারাজ, এবারে তো পুত্র হয়নি, কন্যা হয়েছে। আর কন্যার থেকে তো আপনার মৃত্যুভয় নেই। আপনি একে মেরে ফেলবেন না। আমাদের কাছে কন্যাকে থাকতে দিন"। কংস তাঁদের কথায় কর্ণপাত না করে শিশুকন্যাকে হাতের মুঠিতে ধরে যে মুহূর্তে শিলাখন্ডের উপরে আছাড় মারতে গেলেন সেই মুহূর্তে সেই কন্যা শিলাখণ্ডে পড়ার আগেই আকাশে উঠে গেল। শিশুকন্যা তখন রূপ পরিগ্রহ করে অষ্টমহাভূজা দেবীরূপ ধারণ করলেন। সিদ্ধাচরণ, গন্ধর্ব সব চারিদিকে ঘিরে দেবীর স্তব করছেন। কংস ঊর্দ্ধাকাশে চেয়ে দেখলেন চতুর্দিক অগ্নিময়। এই দৃশ্য দেখে কংস ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। এমন সময়ে দৈববানী হল " রে দুরাচার কংস, তুমি আমাকে ধ্বংস করতে চাইছ! তোমাকে যে হত্যা করবে সে ইতিমধ্যেই গোকুলে জন্মগ্রহণ করেছে। তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে"। এই দৈববাণী শুনে কংস হতবুদ্ধি হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে তাঁর প্রাসাদে চলে গেলেন। মানবজাতির মুক্তিদূত অধর্ম ও অসাধু সংহারক জন্ম নিলেন কংসের কারাগারে আর পালিত হতে লাগলেন অন্য মায়ের কোলে। ধর্ম স্থাপনার্থে অতীতের মতো আরও একবার তিনি এলেন মায়ার পৃথিবীতে মাটির ধরাধামে শ্রীকৃষ্ণ রূপে। ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রইল জন্মাষ্টমী নামে।
🍂
পরের দিন সকালে নন্দভবনে গর্গমুণি সশিষ্য এলেন। তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে নন্দরাজা গর্গমুণিকে প্রণাম করে নন্দভবনের অন্তঃপুরে মুণিকে নিয়ে গেলেন। গর্গমুণি দেখলেন মা যশোদা শিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। মা যশোদা গর্গমুনিকে বললেন "আপনি আমার সন্তানকে আশীর্বাদ করুন"। গর্গমুণি শিশু কৃষ্ণের রূপ দেখে হতবাক। সকলে আসন গ্রহণ করার পরে তিনি বললেন " আমি যদুবংশের বহুকালের পুরোহিত। বসুদেব আমাকে পাঠিয়েছেন গোপনে এই শিশুর নামকরণ করার জন্য। এই শিশুর প্রকৃত পরিচয় আমি তোমাদের দিচ্ছি। ইনি গোলকের অধীশ্বর রাধিকাপতি শ্রীকৃষ্ণ। বৈকুন্ঠের কমলাকান্ত নারায়ন, শ্বেতদ্বীপনিবাসী বিষ্ণু। তিনিই অজ, কপিল ও নর-নারায়ণ ঋষির অংশ। সকলের তেজোরাশি এই শিশুর মধ্যে একত্রিত। ইনি অযোনিসম্ভব হয়ে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। ধরাধামে অনেক পাপ জমেছে, বসুন্ধরাকে পাপ মুক্ত করার জন্যই তিনি এসেছেন। এই শিশু পরিপূর্ণতম ব্রহ্ম বলে এর নাম কৃষ্ণ। কৃষ্ণ নামের 'ক'কার ব্রহ্মবাচক, 'স্ব'কার অনন্ত বাচক, 'ষ'কার শিববাচক, 'ণ'কার ধর্মবাচক, 'অ'কার শ্বেত দ্বীপনিবাসী বিষ্ণুকে ও বিসর্গে নরনারায়নকে বোঝায়। ভগবানের অসংখ্য নাম। কিন্তু এই কৃষ্ণ নাম একবার স্মরণ করলে কোটি নামের ফল লাভ হয়। সংক্ষেপে এই হল শ্রীকৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত।
পরবর্তী অংশ পঞ্চম পর্বে
0 Comments