জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২২বিজন সাহা

ফসলের জমি


ভোলগা নদীর খোঁজে – ২২
বিজন সাহা 

গল্প 

জানি না অপরিচিত জায়গা বলেই কিনা, নাকি কোথাও কোন কাকপক্ষীর দেখাটি পর্যন্ত নেই বলে – কেমন যেন একটা গা ছমছম করা ভাব। দেমিদ বা দিলীপ হয়তো এ নিয়ে ভাবে না, তবে অনিশ্চয়তা মানে যেকোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। কোয়ান্টাম তত্ত্ব সব জায়গায়ই কাজ করে, এখানেই বা করবে না কেন? শেষ পর্যন্ত দেমিদ একটা বাসা ঠিক করেছে, তবে মাত্র এক রাতের জন্য। ওখানে আগামীকাল থেকে অন্য কেউ বুকিং দিয়েছে। কী আর করা? অন্তত রাতটা তো কাটানো যাক। পরের দিন কিছু একটা ঠিকই খুঁজে বের করব। দেমিদের কথা আগেই বলেছি। ও রিস্ক নিতে পছন্দ করে। এখনও পর্যন্ত কোন কিছুতে স্থির ভাবে মন বসাতে পারেনি। কোথাও ভালো লাগলো, কাটিয়ে দিল কয়েক বছর। আবার হুট করেই ফিরে এল দুবনায়। ফ্রি ল্যান্সার। মানুষ এসব করতে পারে যখন কেউ নিজের উপর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী হয় আর যাদের উপর অন্য কারো ভালোমন্দ নির্ভর করে না। আমার ধারণা, যদি কোন কারণে রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, দেমিদ দিব্যি গাড়িতেই রাত কাটিয়ে দিতে পারবে। ও মাত্র কয়েকদিন আগে সেই ভ্লাদিভোস্তক থেকে পুরানো এক ভোলগা গাড়ি কিনে দুবনা পর্যন্ত ড্রাইভ করে চলে এসেছে বন্ধুদের সাথে। অ্যাডভেঞ্চার ওর রক্তে মিশে আছে। আমার মনে পড়ল প্রায় দশ বছর আগের কথা। তখন দেমিদ ওর বান্ধবীর সাথে ভ্লাদিভোস্তক যাবার প্ল্যান করছিল। এক রাতে দেমিদ ওকে বাসায় পৌঁছে দিতে কিম্রি গেল রাতের বেলায়, আমিও সাথে। ওকে রেখে আমরা বাসায় ফিরব। পূর্ণিমা রাত। আসলে আমাদের প্ল্যান ছিল কোন এক ফাঁকা জায়গায় পূর্ণিমা রাতের ছবি তোলা। বছরের এই সময়ে এসব জায়গা প্রায়ই কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। এক জায়গায় নেমে ছবি তুলে ফিরছি। দুই দিকে বন। হঠাৎ আমাদের সামনে দিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হল একটা এল্ক।  প্রায় ৪০০ কেজি ওজনের হরিণ জাতীয় প্রাণী। দেখে মনে হচ্ছিল ও যেন উড়ে চলে গেল। ভাগ্যিস সংঘর্ষ হয়নি। তাহলে কে যে মরত আর কে বেঁচে থাকত সেটা বলা কষ্ট। দেমিদ ভালো ড্রাইভ করে, তবে অনেক সময় বেপারোয়া ভাবে গাড়ি চালায়। তাই দিলীপ প্রথমেই বলে নিয়েছিল স্পীড কন্ট্রোলে রাখতে। অন্যদিকে দিলীপ বিভিন্ন সময়ে এমনকি দূরপাল্লার ট্রাকে করে বিভিন্ন স্পটে গেছে পত্রিকার জন্যে ছবি তুলতে। পেশাগত কারণেই দিলীপকে অনেক সময় অনিশ্চয়তার পথে হাঁটতে হয়। সেদিক থেকে আমি একেবারেই অন্য রকম। ঠিক রুটিন মাফিক না চললেও কমবেশি চেনা জানা বৃত্তের মধ্যেই আমার ঘোরাফেরা। আর তার বেশির ভাগই তত্ত্বীয়। আমি যতটা না বাস্তবে কিছু করি তার শতগুন বেশি করি কল্পনায়। এটাও মনে হয় কাজের কারণেই। আধা আলোয়, আধা অন্ধকারে কোথাও বন, কোথাও দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের উপর অলস ভাবে শুয়ে থাকা পিচ ঢালা পথের উপর দিয়ে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। আমি কখনও দেমিদকে টিপ্পনী কাটছি আমাদের এক কমন পরিচিত মেয়েকে নিয়ে। কখনও বা দিলীপের সাথে কথা বলছি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে। 

এর মধ্যেই আমার আর দিলীপের কিছু কমন পরিচিত লোকজন বেড়িয়ে গেছে। প্রথম আলোর আমার বন্ধুদের কথা আগে কোন এক সময় বলেছি। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং সত্তরের দশকের পশ্চিম বঙ্গের ঘটনা। যদিও এর আগেও কিছু কিছু এসেছে ওদের কথা, তবে এসব গল্পের মনে হয় শেষ নেই। আমার দাদা যখন পলাতক ছিল মা বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করতেন ওর খবর জানার। সেই সূত্রে দাদার অনেক ক্লাসমেট (ও আর জি কর এ পড়ত) বিভিন্ন সময় চিঠিপত্র লিখত। কিছু দিন আগে ফেসবুকে আমার দাদার আরেক বন্ধু কৃষ্ণলাল সরকারের সাথে আমার আলাপ হয়। সেখানেও কিছু খবর পাই। আমি দিলীপকে এসব কথা বলতাম ওদের সাথে কোন রকমের লিংক বের করার জন্য। তবে ও এড়িয়ে যেত বা বলত ও তেমন সক্রিয় ভাবে এসব আন্দোলনে ছিল না, ছিল পেছনের সারিতে। তারপরেও আমি ওকে স্বপন দার গল্প বলে শোনাতাম। তার কারণ আমি ওকে ছোটবেলায় না দেখলেও আমার ছোটবেলা ওর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।   

ফসল তোলার পর

আমার বয়েস যখন ছয় মাস আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। মারধোরের পর বাবা মা অজ্ঞান। আসলে ওরা বাবার কাছে আলমারির চাবি চাইছিল। বাবা সেটা না দেয়ায় মনে হয় চাকু দিয়ে আঘাত করে। সে সময় মা সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁর থুৎনি কেটে যায়। এরপর ওরা আমাকে নাকি পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। স্বপন দা তখন ডাকাতদের কাছ থেকে নাকি আমার প্রাণভিক্ষা করে। ও তখন ক্লাস এইটে পড়ে। বাবা মার পরে ঘরে থাকা ভাইবোনদের মধ্যে ওই সবার বড়। এ ঘটনায় এতটাই ভয় পায় যে ইন্ডিয়া চলে যায়। এই কথা আমি জন্মের পর থেকেই শুনে এসেছি। এটাই ছিল ঐ ঘটনা সম্পর্কে আমার কাছে একমাত্র ভার্সন। আমি দিলীপকে সেই গল্প শোনালাম। আর তখন আমার মাথায় এলো, আচ্ছা, এত কষ্ট করার কি আছে? আমি তো চাইলেই স্বপন দাকে ফোন করতে পারি আর ওরা নিজেরাই কথা বলে জেনে নিতে পারে চেনে কি না বা ওদের কমন পরিচিত কেউ আছে কিনা। 

🍂

সেই গল্পে যাবার আগে আমরা চলে যাব বছর দেড়েক পরে। মানে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে। আমার অন্য এক দাদাকে নিয়ে লেখার সময় আমি বাড়িতে সেই ডাকাত পড়ার কথা উল্লেখ করি। তার কয়েক দিন পরে স্বপন দা ফোন করল। আমরা যে ফোনে খুব একটা কথা বলি তা নয়, আসলে আমি খুব কমই কাউকে ফোন করি। এটা সেটা নিয়ে বিভিন্ন কথা বলার পর বলল

- তুই যে তোকে পুড়িয়ে মারার কথা বলেছিস সেটা ঠিক নয়।
- বারে, তা আমি কোত্থেকে জানব। মা থেকে শুরু করে সবাই আমাকে এ গল্পই শুনিয়েছে। তুমি তো কিছু বলনি।
- আসলে আমি একটু বোকা বোকা ছিলাম। কি যে হতে পারে সে নিয়ে ভাবতাম না। ডাকাতরা প্রথমে মেজো জ্যাঠামশাইয়ের ঘরের দরজা ভাঙে। সেখানে ছিল সিন্দুক। সেই সিন্দুকের চাবি মনে হয় থাকত বাবার কাছে। ওরা ঐ চাবির জন্যেই আমাদের দরজা ভাঙে। বাবা মা অজ্ঞান। তুই ঘুমিয়েছিলি। আর ওরা বিছানার নীচে চাবি খুঁজতে গিয়ে লেপ তোষক সব তোর উপরে রাখছিল। আমি তাই ওদের বলি তোর উপর থেকে ওসব সরাতে। না হলে লেপ তোষক চাপা পরেই মারা পড়তিস। আর আমি বাড়ির সবার বই গোছাতাম। ওরা বই এলোমেলো করলে আমি ওদের বইয়েও হাত দিতে না করছিলাম। সে সময় শ্যামল দার কোলকাতা যাবার কথা হচ্ছিল। ও যেতে চাইছিল না। আর পুলিশ এলে আমিও ডাকাতদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দিতে শুরু করেছিলাম। বাড়িতে প্রমাদ গুনল এ নিয়ে আমি আবার বিপদে না পড়ি। তাই জিজ্ঞেস করল আমি কোলকাতা যাব কি না পড়াশুনা করতে। চলে এলাম। তখন তো আমার ডকুমেন্টস ছিল না, ছোট কাকা রেখে এল। এক সময় দেখা গেল আমি ইলিগ্যাল যে কারণে সরকারি চাকরি পেয়েও বাদ দিতে হয়েছে। আর আমি ভয় পেয়ে আসি নি, ভয় যে কি সেটা বোঝার মত বুদ্ধি ছিল না।

 মেঘের খেলা

সে সব ঘটনা যখন ঘটে আমার বয়স ছিল ছয় মাস। এখন ষাটের দ্বারপ্রান্তে। যাক মরার আগে সঠিক কারণ জানা গেল, নয়তো যমরাজ আবার ওঁর সভায় মিথ্যে বলার অভিযোগ আনত। তবে ছয় মাস বয়সে আগুনে পুড়ে অথবা কম্বল চাপা পড়ে মরার মধ্যে পার্থক্য বোঝার বুদ্ধি আমার হয়েছিল কিনা সেটা আর জানা হল না এই যা দুঃখ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এরপর আমি যখন কল্যাণ দাকে এই নতুন ভার্সনের কথা বললাম, ও বলল, না স্বপনদা ভুলে গেছে। সে সময় কল্যাণ দা ওখানে ছিল, ওর বয়স তখন মনে হয় ৬-৭ হবে। আসলে একটা সময় পেরিয়ে গেলে নিজেদের জীবনের ঘটনার সত্য মিথ্যাও মিলিয়ে নেয়া কঠিন। আমার তো বাচ্চাদের ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে স্ত্রীর সাথে প্রায়ই মতভেদ দেখা দেয়। কোনটা যে বাস্তব আর কোনটা যে কল্পনাপ্রসূত কে জানে? 

নিঝনি নভগোরাদে এসে আমি স্বপন দাকে ফোন করে দিলীপের সাথে কথা বলিয়ে দিলাম। কথা শুনে বুঝলাম ওরা পরস্পরকে না চিনলেও ওদের অনেক কমন পরিচিত আছে। দিলীপ বলল দেশে ফিরে কোলকাতায় গেলে যোগাযোগ করবে। 

রাস্তার ছবি পাবেন এখানে 

Bijan Saha Photo Gallery 

সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪



Post a Comment

0 Comments