জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—জাভা (এশিয়া)সোনালী রঙের শামুক /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস

দূরদেশের লোকগল্প—জাভা (এশিয়া)
সোনালী রঙের শামুক
চিন্ময় দাশ


এক দেশের রাজার দুই মেয়ে। বড় রাজকুমারী, আর ছোট রাজকুমারী। বড় রাজকুমারীর নাম চন্দ্রকিরণ। ছোট রাজকুমারীর নাম দেবীগালুহ।
দুই রাজকুমারীই ভারি সুন্দরী। দুই রাজকুমারীই রাজার ভারি প্রিয়। কিন্তু সুন্দরী হলে কী হবে, দুই রাজকুমারী স্বভাবে এক রকম নয়। দুই রাজকুমারী দু’রকম।
বড় রাজকুমারী যেমন দয়ালু, তেমনি স্বভাবে শান্ত। কখনও কোনও কারণে মাথা গরম করে না। প্রজারা খুব ভালোবাসে তাকে। অন্যদিকে, ছোট রাজকুমারী যেমন কুটিল, তেমনি উদ্ধত। প্রজারা কেউ তাকে পছন্দ করে না।
রাজকুমারীদের বিয়ের বয়স হয়েছে। একদিন রাজামশাই বড়মেয়েকে ডেকে বললেন—পাশের রাজ্যে একটি ভালো ছেলের খবর পেয়েছি। রুপ-গুণ শক্তি-সাহস সব দিক দিয়েই তোমার উপযুক্ত হবে ছেলেটি। তার সাথে তোমাকে বিয়ে দেব ঠিক করেছি। তোমার কিছু বলার থাকলে, বলো। মন খুলেই বলো আমাকে। 
বড় রাজকুমারী বলল—তোমার পছন্দ হয়েছে। এতেই আমি নিশ্চিন্ত। কিছু বলার থাকবে কেন, বাবা?
রাজামশাই ভারি খুশি এমন জবাব শুনে। বললেন—ঠিক আছে, মা। তাড়াতাড়িই বিয়ের আয়োজন করছি আমি।
বড়র বিয়ের কথা কানে যেতেই, আকাশের বাজ ভেঙে পড়ল ছোট রাজকুমারীর মাথায়। আসলে হয়েছে কী, ছোট রাজকুমারী ভালোবাসে পাশের রাজ্যের ঐ রাজকুমারকে। সে মনে মনে জানে, সেই ছেলের সাথেই বিয়ে হবে তার।
এখন তো শিয়রে সমন। দেরি করলে চলবে না। সব হাতছাড়া হয়ে যাবে। 
কী করা যায়, কী করা যায়? অনেক ভেবে ভেবে, এক বুড়ির কথা মনে পড়ল রাজকুমারীর। রাজধানির ঠিক বাইরে এক বুড়ি থাকে। অনেক রকমের যাদু জানে সেই বুড়ি। কিছু করতে হলে, সেই পারবে। 
এক থলে মোহর নিয়ে, বুড়ির বাড়ি গিয়ে হাজির হোল ছোট রাজকুমারী। বলল—কিছু একটা বিহিত করে দাও তুমি। এই বিয়ে হতে দেওয়া চলবে না। 
মোহর ভর্তি থলে বুড়ির হাতে। তার চোখ চকচক করছে। বুড়ি বলল—ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে তোমাকে। তাহলেই ব্যবস্থা করে দেব আমি। 
ছোট রাজকুমারী বলল—কী করতে হবে, বলো আমাকে।
--দিদিকে নিয়ে একদিন সাগরের পাড়ে চলে এসো। বুড়ি বলল—তার পরেরটা আমার হাতে ছেড়ে দাও। 
ছোট রাজকুমারী্র তো আনন্দ ধরে না শুনে। 
--দিদিকে সাগর পারে নিয়ে আসাটা কোন সমস্যাই নয়। কালই নিয়ে আসব আমি। বলে, রাজবাড়িতে ফিরে গেল সে।
সারাদিন বড় রাজকুমারী্র পিছন পিছন ঘুরল ছোট। যেন এই বিয়েতে সে ভারি খুশি হয়েছে। সাত বার ধরে বলতে লাগল দিদিকে। 
সকাল হলে, দিদিকে বলল—বিয়ে হলেই তো তুমি চলে যাবে এখান থেকে। একেবারে একা হয়ে যাব আমি। আজ চলো, একবার সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে আসি দুজনে।
চারদিকে গভীর সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দেশ জাভা। যেদিকে তাকাও, শুধু জল আর জল। রাজধানির বাইরেই সাগর। 
বেড়াতে যাওয়ায় আপত্তি করবার কী আছে? বড় রাজকুমারী তো আর জানে না, কী ফন্দী এঁটে এসেছে তার নিজেরই বোন। সে বলল-- গেলেই হয় সাগরের পাড়ে। 
বিকেলে দুই বোন সাগরের পাড়ে এসেছে বেড়াতে। হঠাৎই সেই বুড়ির উদয়। গটগট করে বড় রাজকুমারী্র সামনে এসে হাজির। ছোট রাজকুমারী বলল—এই হোল আমার দিদি। বাবা এর বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
খিল খিল করে হেসে উঠল বুড়ি। এমন বীভৎস হাসি, কানে যেতেই পিলে চমকে উঠল বড়র। সে কিছু বুঝে উঠবার আগেই, সুখী হও, মা। বলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বুড়ি।
তখন যা ঘটে গেল, একেবারে ভোজবাজির মত। কোথায় রাজকুমারি? চোখের পলক না ফেলতেই, আস্ত একটা মেয়ে একেবারে উধাও হয়ে গেছে কোথায়। আর, রাজকুমারীর জায়গায় একটা শামুক পড়ে আছে বালির উপর।
আহা, কী রঙ শামুকের! পুরোটাই যেন সোনা দিয়ে মোড়া। বুড়ির মুখে হাসি ধরে না। শামুকটা তুলে নিয়েছে হাতে। শামুককে বলল—তোমার ভালোবাসা যদি খাঁটি হয়, তাহলে নিশ্চয় আবার রাজকুমারি হতে পারবে। বলেই সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল শামুকটাকে। 
ছোট রাজকুমারী্র আনন্দ ধরে না। নিজের চোখের সামনে শত্রু বিনাশ। ফূর্তিতে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরে এল মেয়ে। 
রাজধানির বাইরে, সমুদ্রের তীরে এক গ্রাম। জেলেদের পাড়া আছে সেই গ্রামে। এক জেলেনী প্রতিদিন মাছ ধরতে যায় সাগরে। সেই মাছ বেচে যা দু-চার টাকা পায়, তাতেই দিন চলে তার। 
একদিনএকটা শামুক উঠে এল তার জালে। ফেলে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু শামুকটার বাহারি রঙ দেখে, বেশ পছন্দ হয়ে গেল জেলেনীর। ফেলে না দিয়ে, মাছের ঝুড়িতে রেখে দিল শামুকটাকে। বিকেলে ঘরে ফিরে, উঠোনে ছেড়ে দিয়ে বলল—এইখানে থাক তুই। 
পরদিন মেয়েটি আবার গিয়েছে সমুদ্রে জাল ফেলতে। ঘর খালি। শামুকের খোল ছেড়ে, বেরিয়ে এলো বড় রাজকুমারী। জল থেকে তুলে এনে, নতুন জীবন দিয়েছে তাকে এই জেলেনী। কিছু হলেও তার প্রতিদান তো দেওয়া উচিত।
ঘরদোর পরিষ্কার করল রাজকুমারী। ঝাঁট দিয়ে উঠোন সাফ করল। তারপর ঢুকল রান্নাঘরে, ভাত রাঁধা হোল। এবার বসে বসে পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধল গুণে গুণে। সব কাজ শেষ হল যখন, সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। আবার শামুকের খোলে ঢুকে পড়ল টুক করে।  
 দূপুর গড়িয়ে বিকেল হয় হয়, ঘরে ফিরে এলো জেলেনী। ঘর ঢুকে তো তার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। নিজের সেই অগোছালো, ঝাঁটপাট না দেওয়া ঘরটা গেল কোথায়? নিজের এই ঘর তো নিজেই চিনতে পারছে না সে। 
রান্নাঘরে ঢুকে তো থ’ হয়ে গিয়েছে বউটি। রানাবান্নাও সেরে রাখা হয়েছে। আর খাবার-দাবার? খাওয়া তো দূরের কথা, এমন খাবার সে স্বপ্নেও দেখেনি কখনও। 
একদিন নয়, নিত্যদিন একই ঘটনা ঘটে চলেছে। ঘরদোর সাফসুতরো, খাবার টেবিলে রাজকীয় খাবার সাজানো। কিন্তু করছে কে এসব? ভারি কৌতুহল হোল তার। 
পরদিন জাল আর মাঝের ঝুড়ি নিয়ে ঘর থেকে বের হোল জেলেনী। প্রতিদিন যেমন যায়, একেবারে তেমন। তবে, সেদিন ঘর থেকে কিছুটা পথ গিয়ে, আবার ফিরে এলো। এবারে ঘরে না ঢুকে, খিড়কির দিকে গিয়ে লুকিয়ে রইল। 
খানিক বাদে নিজের চোখেই দেখল পুরো ঘটনা। একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো জল থেকে তুলে আনা শামুক থেকে। অপরূপ সুন্দরী সেই মেয়ে। সেই মেয়েই সব কাজ করে গেল এক এক করে। অমনি বউটি খিড়কি ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকে পড়ল। 
ধরা পড়ে গিয়ে রাজকুমারীর তো তটস্থ অবস্থা। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এক এক করে তার এই দশার কথা সব জেনে নিল বউটি। এবার তাড়াতাড়ি, শামুকের খোলটা তুলে নিয়ে বলল—আর লুকোচুরি খেলতে হবে না তোমাকে। রাজকুমারী হিসাবেই থাকো এখানে দু-চার দিন। আমি তোমাকে রাজবাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসবার কী ব্যবস্থা করা যায় দেখছি । চিন্তা কোর না।
এদিকে রাজবাড়িতে হুলুস্থুল অবস্থা। আস্ত একটা মেয়ে কোথায় উবে গেল কর্পুরের মত। দেশ জুড়ে খোঁজখবর করা চলছে। কিন্তু কোন পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না।
পাশের রাজবাড়িতেও দেওয়া হয়েছে দুঃসংবাদটা। বিয়ের আয়োজন থেমে গিয়েছে সেই বাড়িতেও। রাজকুমার নিজে এসে উঠেছে এই রাজবাড়িতে। সেও নিয়মিত রাজকুমারীর খোঁজ করতে বেরোয়।
একদিন রাজকুমার খোঁজ করতে বেরিয়ে, সমুদ্রের ধারে এসে পৌঁছেছে। পিপাসা পাওয়ায় জলের খোজে ঢুকেছে জেলেদের গ্রামে। প্রথম বাড়িতে গিয়ে জানতে চাইল—বাড়িতে কেউ আছো? একটু জল দেবে আমাকে?
জেলেনী তো বেরিয়ে গিয়েছে। বাড়িতে ছিল বড় রাজকুমারী। সে বেরিয়ে এসেছে। তাকে দেখে, রাজকুমার তো অবাক। গরীব জেলের বাড়িতে কে এই মেয়ে? 
এক এক করে সব কথা বলে গেল রাজকুমারী। বুঝতে কিছু বাকি রইল না রাজকুমারের। শামুকটা আর রাজকুমারীকে সাথে নিয়ে, রাজবাড়িতে ফিরে চলল রাজকুমার।
🍂
যা শুনে এসেছে, নিজের চোখে দেখে এসেছে, সব খুলে বলল রাজাকে। রাজা দরবার ডেকে দিলেন। 
ভরা দরবার বসেছে রাজবাড়িতে। সেই বুড়িকে ডেকে আনা হয়েছে। দরবারে হাজির করা হয়েছে ছোট রাজকুমারীকেও। রাজামশাই দুজনকে জানতে চাইলেন—বড় রাজকুমারীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তোমরা জানো কিছু এ সম্পর্কে?
দুজনেই বলল—আমরা জানব কী করে? আমরা কিছু জানি না।
তখন রাজকুমার শামুকটা বের করল। বুড়ি আর ছোট রাজকুমারীকে দেখিয়ে বলল— বড় রাজকুমারীর কথা তোমরা কিছু জানো না। কিন্তু তোমরা এই শামুকটা সম্পর্কে কিছু জানো? 
দুজনেই চমকে গিয়েছে। শামুক দেখে, বাজ পড়েছে দুজনেরই মাথায়। মাথা তুলবে, সে ক্ষমতাও নাই। কথা বেরোচ্ছে না তাদের মুখ দিয়ে।
রাজকুমার রাজাকে বলল—কথা বাড়িয়ে লাভ নাই। আপনি এদের বিচার করুন। ভরা দরবার শুনবে আপনার বিচার। 
রাজা সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন— শামুকটা নিয়ে সমুদ্রে যাও। গভীর জলে পৌঁছে, এটা ফেলে দিও। সাথে এই বুড়ি আর ছোট রাজকুমারিকেও নিয়ে যাও। এই দুজনকেও জলে ফেলে দিও শামুকের সাথে। 
গোটা দরবার স্তব্ধ। কারও মুখে কথা নাই। হায় হায় করবে না কি ধন্য ধন্য করবে, বুঝতে পারছে না কেউ।
বুড়ো মন্ত্রী বসে ছিল রাজার পাশে। সে বলল—রাজামশাই, এই দুজনের মধ্যে একজন যে আপনার মেয়ে। সেটা ভুলে গেলেন?
রাজা বললেন—দরবারে বসে বিচার করে একজন রাজা। সে কারও বাবা নয়, শুধুই একজন বিচারক। 
তারপর? বুড়ি আর ছোট রাজকুমারীর সলিল সমাধি হয়েছে সেদিনই। বিয়ের যোগাড়যন্ত্র করা হোল তড়িঘড়ি। মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল বড় রাজকুমারীর।
রাজামশাই জামাইকে কী যৌতুক দিয়েছিলেন, তার হিসাব করে আমাদের লাভ নাই। তবে সেই গরীব জেলেনীকে বহু মূল্যবান উপহার দেওয়া হয়েছিল—রাজ্যশুদ্ধ লোক এটা দেখেছে।

Post a Comment

0 Comments