জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯৪
ডাকাত রাজা থেকে চৈতন্য দাস(২য় পর্ব)
সূর্যকান্ত মাহাতো
গুরু যদি শিষ্যের মন ছুঁতে পারে, শিষ্যের মনে অনুরণন জাগাতে পারে, তার চিন্তা ও চেতনার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, তবেই তিনি স্বার্থক গুরু হয়ে ওঠেন। বৈষ্ণব সাধক 'শ্রীনিবাস আচার্য' ঠিক সেটাই করতে পেরেছিলেন। রাজা বীর হাম্বীরের হৃদয়ে তিনিও সেরকমই এক আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন বলেই তিনি 'ডাকাত রাজা' থেকে সাধক 'চৈতন্য দাসে' রূপান্তরিত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু লুণ্ঠন প্রবৃত্তিকে তিনি কি জয় করতে পেরেছিলেন? বোধ হয় না। কারণ রাজ ঐশ্বর্যের মোহ ত্যাগ করতে পারলেও কিন্তু বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পর "তিনি বর্ধমান জেলার বীরসিংহ গ্রামের ধরনি ব্রাহ্মণের মন্দির থেকে মদনমোহন বিগ্রহ চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন।" (বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ৬৯)
রাজা 'বীরহাম্বীর', শ্রীনিবাস আচার্যের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই যে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এটা সত্যি, তবে সেটা আকস্মিক কোনও ঘটনা ছিল না। বরং রাজার দীক্ষা গ্রহণের সেই প্রেক্ষাপটটা শ্রীনিবাসের আগমনের পূর্বকাল থেকেই একটু একটু করে রাজার মনে তৈরি হয়েছিল। কারণ বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি প্রীতি রাজার হৃদয়ে জাগরিত হয়েছিল শ্রীনিবাস আচার্যের বিষ্ণুপুরে আগমনের আগে থেকেই। কারণ শ্রীজীব গোস্বামীর এক আত্মীয় 'মথুরেশ সার্বভৌম' অনেক আগেই সেটার বীজ রোপণ করেছিলেন বলা যেতে পারে। কারণ তিনি বিষ্ণুপুরের এই রাজসভাতেই বসবাস করছিলেন। তাকে ঘিরে একটি ভক্তমন্ডলও গড়ে উঠেছিল। তবে তার প্রভাব ততটা ছিল না। তবুও রাজসভার কিছু কিছু ব্যক্তি অবশ্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন। (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, তৃতীয় সংখ্যা, তরুনদেব ভট্টাচার্য)
একজন ডাকাত রাজা, দস্যু ধর্ম ছেড়ে, রাজধর্ম ছেড়ে গ্রহণ করে ফেলেছিলেন বৈষ্ণব ধর্ম। রাজ ঐশ্বর্যের মোহ ত্যাগ করে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে বরাবরের জন্য চলে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনে। সর্বদায় যার হাতে ধরা থাকত 'অসি', সেটাই তিনি ত্যাগ করেছিলেন। আর হাতে তুলে ফেলেছিলেন 'মসি'। লিখে ফেলেছিলেন 'বৈষ্ণব পদাবলী'-র মতো পদ। পদগুলো দেখলেই বোঝা যাবে যে, সেগুলো কোন কাঁচা হাতের লেখা নয়। প্রকৃত লেখনী ক্ষমতা না থাকলে, এই ধরণের পদ রচনা সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই তার অবচেতন মনে সেই প্রতিভা রক্ষিত ছিল। 'ভক্তিরত্নাকর' গ্রন্থে রাজা বীর হাম্বীর রচিত যে দুটি পদের উল্লেখ পাই তা হল--
১
"প্রভু মোর শ্রীনিবাস পোড়াইলে মনের আশ
তোয়া বিনে গতি নাহি আর।
আছিনু বিষয় কীট বড়ই লাগিত মিট
ঘুচাইলা রাজ অহংকার।।
করিতু গরল পান সে ভেল ডাহিন বাম
দেখাইলা অমিয়ার ধার।
পিব পিব করে মন সব ভেল উচাটন
এসব তোমার ব্যবহার।।
রাধা পদে সুধা রাশি সে পদে করিলা দাসী
গোরা পদে বাঁধি দিলা চিত।।
শ্রী রাধিকা গণ সহ দেখাইলা কুঞ্জ গেহ
জানাইলা দুহু প্রেম রীত।
যমুনার কুলে যাই তীরে সখি ধাওয়া ধাই
রাধা কানু বিলসয়ে সুখে।
এ বীর হাম্বির হিয়া ব্রজপুর সদা ধিয়া
যাহা অলি উড়ে লাখে লাখে।।"
২
"শুনগো মরম সখী কালিয়া কমল আঁখি
কিবা কৈল কিছুই না জানি।
কেমন করয়ে মন সব ভাল উচাটন
প্রেম বিনা খোয়াইনু পরাণি।।
শুনিয়া দেখিনু কালা দেখিয়া পাইনু জ্বালা
নিবাইতে নাহি পাই পানি।
অগুরু চন্দন আনি দেহেতে লেপিনু ছানি
না নিভায় হিয়ার আগুনি।।
বসিয়া থাকিয়া যবে আসিয়া উঠায় তবে
লৈয়া যায় যমুনার তীর।
কি করিতে কিনা করি সদাই ঝুরিয়া মরি
তিলক নাহিক রহি ধীর।।
শাশুড়ী ননদ মোর সদাই বাসয়ে চোর
গৃহপতি ফিরিয়া না চায়।
এ বীরহাম্বিরচিত শ্রীনিবাস অনুগত
মজি গেল কালাচাঁদের পায়।"
🍂
রাজা বীর হাম্বীরের বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণের পর বিষ্ণুপুরের এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছিল। রাজা বিষ্ণুপুরকে দ্বিতীয় বৃন্দাবন রূপে গড়ে তুলেছিলেন। তার জন্য তিনি বৃন্দাবনের অনুরূপ চার পাশের গ্রামগুলোকে ব্রজ মন্ডলের অনুকরণে নামকরণ করেছিলেন। যেমন- মথুরা, অবন্তী, দ্বারকা, অযোধ্যা প্রভৃতি। শুধু তাই নয় একাধিক বাঁধ কেটে তাদের নাম দিয়েছিলেন যমুনাবাঁধ, কালিন্দী বাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, শ্যাম বাঁধ ইত্যাদি। (সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, তৃতীয় সংখ্যা, তরুণ দেব ভট্টাচার্য) শুধু কি তাই! লেখক ফকির নারায়ণ কর্মকার বলেছেন, "যেখানে অস্ত্রের ঝঞ্জনা হ্রস্বের হ্রেষা, হস্তির বৃংহিত ও কামানের গর্জন শোনা যেত সেখানেই জেগে উঠে কীর্তনের কল্লোল। (বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী, ফকির নারায়ন কর্মকার, পৃষ্ঠা- ৫২)
সমগ্র বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণব ধর্ম তিনটি ধারায় প্রচারিত হয়েছিল। "এক. রাজার সাহায্যে প্রত্যক্ষভাবে দীক্ষাদান। দুই. রাজার অনুগ্রহপুষ্ট প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অনুকরণে স্বেচ্ছায় দীক্ষা গ্রহণ, এবং তিন. হরিনাম ও ঘরে ঘরে সংকীর্তন প্রচারের ফলে উদ্বুদ্ধ জনসাধারণের ধর্মান্তর গ্রহণ।" সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, তৃতীয় সংখ্যা, তরুনদেব ভট্টাচার্য) বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণব ধর্মের নবনির্মিত রীতির প্রচলন শুরু হয়েছিল। ঐ রীতির প্রধান উৎসব ছিল রাস। সুরুচি আর সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস উৎসবকে রাজকীয় করে গড়ে তোলার জন্য বিখ্যাত রাসমঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন রাজা বীর হাম্বীর। রাসের সময় অন্যান্য সমস্ত জায়গা থেকে বিগ্রহগুলো এখানে এনে মহা ধুমধাম করে উৎসব পালন করা হত।
বৈষ্ণব ধর্মের যে চারা গাছটি রাজা বীর হাম্বীর রোপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে রাজা গোপাল সিংহদেব তাকেই মহীরুহে পরিণত করেছিলেন। তার সময়ে নাকি বহু বৈষ্ণব ও ভক্তিমান পুরুষ বিষ্ণুপুরে এসেছিলেন। তাদের কীর্তনের রোলে বিষ্ণুপুরের আকাশ বাতাস সর্বদাই মুখরিত হয়ে থাকত। (বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী/ শ্রী ফকির নারায়ন কর্মকার, পৃষ্ঠা- ৮৫) শুধু তাই নয় রাজা গোপাল সিংহদেব প্রজাদের হরিনাম সংকীর্তন এর পাশাপাশি ভগবত প্রেমেও উৎসাহিত করতেন। তবে প্রতিটি ঘরে সন্ধ্যাবেলা হরিনাম সংকীর্তনকে তিনি এক রকম বাধ্যতামূলক করে তুলেছিলেন। প্রজাদের কেউ কেউ রাজার এমন জবরদস্তি প্রথাতে অসন্তুষ্ট ও বিরক্তিও হয়ে উঠতেন। তাই এই প্রথাকে 'গোপাল সিংহের বেগার' বলেও মনে করতন। (বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/ রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ৮৪) বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত জোড় বাংলা মন্দির রাজা গোপালসিংহদেবই নির্মাণ করেছিলেন। বিষ্ণুপুরকে বৃন্দাবনে পরিণত করতে পরবর্তী রাজা গোপাল সিংহেরও বিরাট অবদান ছিল।
সেই রেশ এখনো বর্তমান। পাঁচমুড়ায় নির্মিত হয়েছে 'ত্রিধারা মিলন মন্দির'। প্রচুর পর্যটক ও ভক্তদের কাছে বিষ্ণুপুরের পাশাপাশি নব নির্মিত এই মন্দির অন্যতম মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
তথ্যসূত্র: ১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম পর্ব/ বিনয় ঘোষ
২) বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী/ শ্রী ফকির নারায়ণ কর্মকার
৩) বাঁকুড়া জনের ইতিহাস সংস্কৃতি/ রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী
৪) মল্লভূম বিষ্ণুপুর/ মনোরঞ্জন চন্দ্র
৫) ভক্তিরত্নাকর/ নরহরি চক্রবর্তী
0 Comments