জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে/পঞ্চম পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
পঞ্চম পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী  

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব

            
আমাদের যাত্রা হল শুরু
ভগবানের চিত্রনাট্য অনুযায়ী আমরাও আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের তাঁর লীলাস্থলগুলি প্রত্যক্ষ করার মানসে প্রথমে মথুরা ও বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলাম। আমাদের দৃষ্টিতে তাঁর লীলাস্থলগুলি যেভাবে দেখেছি সেই কথাই কলমের আঁচড়ে এখানে পরিস্ফূট করছি। ২০২২ সালের অর্থাৎ এই বৎসরের ১২ই মার্চের বিকেল পাঁচটা চল্লিশ মিনিটে মেদিনীপুরের বাড়ি থেকে আমি ও আমার ভ্রমণসঙ্গী সুমিতা রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্টেশনে যেয়ে জানতে পারলাম ট্রেন কুড়ি মিনিট দেরিতে এসে পৌঁছাবে। ভারতীয় রেলের ট্রেন চালনার ব্যাপারে সুনাম সুবিদিত, এক্ষেত্রেও তা বাস্তবে উপলব্ধি হলো সেকথা পরে বলছি, কিন্তু তার পূর্বে আমার সহযাত্রীদের সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলছি। ট্রেনে ওঠার পরে প্রথম আলাপ হলো আমাদের এসি থ্রি টায়ার কামরার আমার সহযাত্রী জনৈক উড়িষ্যাবাসী খুরদা রোডের একটি নরম পানীয় কারখানার কর্মী শ্রী রমেশচন্দ্র সুতারের সঙ্গে। আমাদের দুটি আসনই ছিল লোয়ার বার্থে। মধ্য ও উপরের তিনটি বার্থ ওদের। ওদের সাথে ট্রেনে এতখানি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল যে পরের দিনে আনন্দ বিহার টার্মিনালে নামা পর্যন্ত সেই আলাপ পরিণত হলো নিবিড়ভাবে। যার পরিণতিতে ট্রেন থেকে নামার পূর্বে যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইল ফোনের নম্বর আদান-প্রদানে শেষ হলো। ওঁরা যাচ্ছেন তাদের একমাত্র ছেলে অতীশের কাছে, যে নতুন দিল্লি থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে হাপুর নামে একটি স্থানে কানাড়া ব্যাংকের প্রবেশনারী অফিসাররূপে কর্মরত। সঙ্গে আছেন স্ত্রী শ্রীমতী অনুপমা এবং কন্যা মোনালিসা। এঁরা দুজনেই স্বল্পভাষী, খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। শ্রীমতী অনুপমা গৃহবধূ আর কন্যা মোনালিসা সম্প্রতি স্নাতক স্তরে পাশ করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলের কাছে কয়েকদিন থেকে পুনরায় নিজভূমিতে ফিরে যাবেন, উদ্দেশ্য ছেলের কর্মস্থল নিজচক্ষে দেখা। আনন্দ বিহার টার্মিনালে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে আসতে ওদের ছেলে অতীশের সাথে আমাদের দেখা হতে সশ্রদ্ধ ভঙ্গিমায় আমাদের নমস্কার জানালো। বাবা-মা এবং বোনকে নিয়ে হাপুর থেকে সে গাড়ি ভাড়া করে এসেছে।  
এবারে ট্রেনের বিলম্বিত গতি সম্বন্ধে একটু জানিয়ে রাখি। আদ্রা স্টেশন পর্যন্ত এই বিলম্বিত যাত্রা এক ঘন্টার সীমা স্পর্শ করল। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম যথারীতি ট্রেন এক ঘন্টা বিলম্বেই যাচ্ছে। কিন্তু এরপরে দুপুর পর্যন্ত সময়ের মাঝে এক ঘন্টার বিলম্বিত যাত্রা পাঁচ ঘণ্টাতে এসে স্থির হল এবং নতুন দিল্লির আনন্দ বিহার টার্মিনাসে যেয়ে যখন পৌছালাম তখন নির্ধারিত সময় বিকেল তিনটে দশ মিনিটের পরিবর্তে রাত্রি আটটা পঁয়তাল্লিশে আমাদের যাত্রা পথের পরিসমাপ্তি ঘটলো। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটি অটো করে আমাদের রাত্রের সরাইখানা নতুন দিল্লি স্টেশনের সন্নিকটে পাহাড়গঞ্জ এলাকার 'কিরণ গেস্টহাউসে' যেয়ে যখন পৌছালাম তখন রাত্রি ৯-৪৫। রাতটুকু হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন সকাল ছটায় নতুন দিল্লি-ভূপাল শতাব্দী এক্সপ্রেসে মথুরাতে এসে পৌছালাম সকাল সাড়ে সাতটায়। আমরা গেছি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে শ্রীরাধিকা এবং গোপীগনের দোলযাত্রা উৎসব প্রত্যক্ষ করার জন্য। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বৃন্দাবনে যাব বলে একটি অটোতে উঠলাম।
আমাদের যেহেতু যথেষ্ট বয়স হয়েছে সেজন্য আমরা স্থির করেছি শরীরের প্রতি যত্ন রেখে ধীরভাবে প্রত্যেকটি দর্শনীয় মন্দির ও স্থান দেখে উপলব্ধি করার চেষ্টা করব বৃন্দাবনের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য। আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বৎসরেরও পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মর্ত্যভূমিতে তাঁর প্রথম নরলীলা প্রদর্শন করেছিলেন বৃন্দাবনে ও মথুরায়। এছাড়াও বৃন্দাবন ও সন্নিহিত অঞ্চলের অধিবাসীরা কিভাবে সুপ্রাচীন দোল উৎসবের রীতিকে বজায় রেখে বর্তমান সময়ে আনন্দে মেতে উঠেন। এই বৃন্দাবন ও মথুরায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাল্যলীলা করেছিলেন। যতদূর জানা যায় তিনি ১৪ বছর বয়সের পরে গোপভূমি পরিত্যাগ করে দ্বারকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করব। শতাব্দী এক্সপ্রেসে যেতে যেতে সুমিতা জানতে চাইল মথুরার অতীত ও বর্তমান ইতিহাস। তার উত্তরে আমি বললাম " আমার যতটুকু জানা আছে সেকথা তোমাকে বলছি। 
🍂
ত্রেতাযুগে মধু দৈত্য নামে এক অসুর ছিল যে মহাদেবের একান্ত ভক্ত। দীর্ঘ তপস্যার পরে শিবের কাছ থেকে সে আশীর্বাদপুত ত্রিশূল লাভ করেছিল। এই মধু দৈত্য দেব, দ্বিজ, মুনি-ঋষি সকলকে শ্রদ্ধা করত। তার রাজত্বে সকলেই শান্তিতে বাস করতেন। মধুদৈত্যের নামানুসারে তার রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল মধুপুরী। কথায় আছে একজন মানুষ সব সুখ কখনোই পায় না। তার এই শান্তির রাজত্বে অশান্তির কারণ ছিল তার পুত্র লবণাসুর। মধু দৈত্যের মৃত্যুর পরে তার পুত্র লবণাসুর রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে মুণি-ঋষিদের প্রতি অত্যাচার শুরু করল। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুনি-ঋষিরা অযোধ্যার প্রজানুরঞ্জক রাজা শ্রীরামচন্দ্রের কাছে যেয়ে লবনাসুরের অত্যাচারের কথা বলায় শ্রীরামচন্দ্র তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শত্রুঘ্নকে পাঠালেন লবনাসুরের বিরূদ্ধে যুদ্ধযাত্রায়। শত্রুঘ্ন লবনাসুরকে বধ করে এই মধুপুরীর রাজা হলেন। সেই সময় মধুপুরী ঘন জঙ্গলে আবৃত বলে তার আর এক নাম ছিল মধুবন। মধুপুরী থেকে মধুবন এবং পরবর্তীকালে মধুবন থেকে মথুরা নামে এই জনপদ খ্যাত হল। মথুরাতে ১২ বৎসর রাজত্ব করার পরে শত্রুঘ্ন তাঁর পুত্র সুরসেনকে রাজ্যভার দিয়ে অযোধ্যা চলে যান। কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে এই সুরসেনের নাম থেকে এই জনপদের নাম হয় শূরসেনা বা শূরসেন দেশ। সুরসেনের পরে তার ভাই সুবাহুর রাজত্বকালে লবনাসুরের পৌত্র ভীম সৎবত সুবাহুকে পরাজিত করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করেন। এই ভীম সৎবতের চার ছেলে- ধজমান্না, দেববৃদ্ধ, অন্ধক ও বিষ্ণু। ভীমের মৃত্যুর পরে অন্ধকের ভাগে পড়লো মথুরা রাজ্য। অন্ধকের ছোট ছেলের নাম ছিল বৃষ্টিনি এবং তার বংশধরবন বৃষ্ণিনামে পরিচিত হলেন। এই বংশে কয়েক পুরুষ পরে শূরসেন নামে এক রাজা জন্মগ্রহণ করেন। ভীমের বড় ছেলের বংশের কয়েক পুরুষ পরে আহুক রাজা হয়। আহুকের দুই ছেলে উগ্রসেন ও দেবক। আহুকের মৃত্যুর পরে উগ্রসেন মথুরার রাজা হয়। আর কংস উগ্রসেনের প্রথম সন্তান। শূরসেনের পুত্রের নাম বসুদেব ও কন্যার নাম কুন্তী। বসুদেব উগ্রসেনের ভাই দেবকের কন্যা দেবকীকে বিবাহ করেন। বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ। সংক্ষেপে এই হল মথুরার অতীত ইতিহাস।                                  
নতুন দিল্লির ১৬৬ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে, আগ্রার ৫৭ কিলোমিটার উত্তরে, বৃন্দাবন থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মথুরার অবস্থান। ৩৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় শহর পরিব্যপ্ত। ২০১১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী মথুরার লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লক্ষ। সড়ক পথে নতুন দিল্লির সাথে ছয় রাস্তার ‘যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে’ দ্বারা যুক্ত। এছাড়াও NH-19 দ্বারা কলকাতার সাথে যুক্ত। রেলপথে সারা ভারতের সাথে যুক্ত। নিকটবর্তী বিমানবন্দর নতুন দিল্লি। গ্রীষ্মে এখানের তাপমাত্রা ৪২ থেকে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বর্ষাকালে গড় বৃষ্টিপাত ১৭৫ মিলিমিটার। মথুরা জেলায় বড় জঙ্গল প্রায় নেই। যমুনার তীরগুলিতে কাঁটাগাছ ও বড় বড় ঘাসের ঝোপ দেখা যায়। বর্তমানে সেনাবাহিনীর এক বিরাট ইউনিট এখানে আছে যেখান থেকে ভারতের পশ্চিম সীমান্তের উপর সদাসর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে মথুরার অবদান উল্লেখযোগ্য। এশিয়ার বৃহত্তম তৈল শোধনাগার এই মথুরাতে যেখানে প্রতি বৎসর ৮ মিলিয়ন টন খনিজ তৈল শোধন করা হয়।                                                                                          
পরবর্তী অংশ ষষ্ঠ পর্বে

Post a Comment

0 Comments