জ্বলদর্চি

বিদ্যুৎলতা সামন্ত (রামায়ণ গানের শিল্পী, পাঁশকুড়া)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭৭
বিদ্যুৎলতা সামন্ত (রামায়ণ গানের শিল্পী, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন পড়তেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। কিন্তু পড়াশুনায় আগ্রহ ছিল ব্যাপক। অথচ উপায় নেই। সংসারের জটিল আবর্তে মাথা গলানো সেই মেয়েটি অবশ্য মনের কোণে অবদমিত রেখেছিল সেই আশা। রক্ষণশীল সমাজে তখন মেয়েদের পড়াশুনা করাটা ‘অনৈতিক’।

অবশেষে সন্তানাদি হলো। এবার হাতে সময় পেয়েই পড়তে লাগলেন বাড়িতে। সেকেলে শাশুড়ির রক্তচক্ষুর বেড়া ডিঙিয়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ফেললেন বিদ্যুৎলতা সামন্ত। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থানার কাঁসাই নদীর পাড়ের হরিনারায়ণচক গ্রামের গৃহবধূ এই বর্ষীয়ান মহিলার এখন ৭৫ এর দোরগোড়ায়। শুধু পড়াশুনা নয়। আট বছর বয়স থেকে নিজের মনে পরম লালিত্যে বেড়ে ওঠা গানের প্রতি ভালোবাসাকেও সার্থক রূপ দিতে পেরেছিলেন যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে। আজ তিনি সারা পশ্চিমবঙ্গে এক বিশেষ লোকআঙ্গিক ‘কথকতা'র প্রবাদপ্রতিম মহিলা শিল্পী হিসেবে পরিচিত। একজন মহিলা হয়েও সামাজিক বাধা অতিক্রম করে তিনি যে উত্তরণ ঘটিয়েছেন তা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা।

অনাথবন্ধু দাস অধিকারী। ভগবানপুরের পোড়াচিংড়া গ্রামে বাড়ি। অসাধারণ কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। ১৯৯৮ তে প্রয়াত হয়েছিলেন। অনেকটা ঠিক একলব্যের মতো গানের গুরুদেব হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন এই অনাথবন্ধুকে। মেদিনীপুর সহ আশেপাশের এলাকার মানুষ অনাথবন্ধুর গান শোনেননি -- এরকম ঘটেনি। সেই অনাথবন্ধুর মতো গান গাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেন ছোট্ট বিদ্যুৎলতা। কিন্তু কখনো তাঁকে সরাসরি গুরু হিসেবে পাননি। বাড়ির পাশে যোগীখোপ গ্রামে একবার এসেছিলেন অনাথবন্ধু। তাঁর গান শুনে রামায়ণ গানের প্রতি অনুপ্রাণিত হন তিনি। টানা তিনদিন নিজের বাড়িতেই ফেরেননি। আসলে গান গাওয়ার প্রবল ইচ্ছা। গান শেখার প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু বাড়িতে 'নুন আনতে পানতা ফুরায়' অবস্থা। অত্যন্ত গরিব বাড়ির মহিলা। গান শেখার পয়সা কোথায়? 

রক্ষণশীল শাশুড়ি রাইমণি সামন্তের অনুমোদন জোগাড় হলো অবশেষে। কিন্তু গান শেখাবে কে? প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক স্বামী দেবেন্দ্রনাথ সামন্তই লিখলেন বিভিন্ন পালাগান। ছোট বয়স থেকে শুনে শুনে শেখা গানের 'অ-আ-ক-খ'কে পুঁজি করে স্বামী স্ত্রী বসে পড়লেন রেওয়াজে। নিজেরাই সুর তৈরি করলেন। লেখা হলো পালা রামের বনবাস, সীতাহরণ পালা ইত্যাদি। ঘরের যাবতীয় কাজ সামলে মুখস্থ করলেন সেইসব পালা গান। রাতে চলতো মহড়া। ১৯৭১ সালে গৌরাঙ্গপুর গ্রামে প্রথম গাইলেন 'রামের বনবাস'। অথচ কোনওরকম প্রথাগত তালিম ছিলনা গানের। তারপর সে বছরই ২৮ আসরে রামায়ণ গান গাইলেন বিদ্যুৎলতা সামস্ত!
সীতাহরণ, ভক্ত তরণীসেন, রামসীতার বিবাহ, রামসীতার জন্ম, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, রাবণবধ, সীতা উদ্ধার, সীতার বনবাস, সহস্রস্কন্ধ, রাবণ বধ, হরিশচন্দ্র, সীতার পাতাল প্রবেশ, বিভীষণ বিদায়, সীতা অন্বেষণ, রামভক্ত হনুমান ইত্যাদি পালাগান মুখস্থ করলেন তিনি। ইতিমধ্যে জন্ম দিয়েছেন দুই ছেলে ও এক মেয়ে। একদিকে তাঁদের দেখভাল করা, অন্যদিকে রামায়ণ গান গেয়ে যাওয়া। স্বামী সব মিলিয়ে লিখে দিয়েছিলেন রামায়ণের ১৫ টি বড় পালা এবং ১০ টি ছোট পালা। সেগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইতেন বিভিন্ন আসরে। 

১৯৮১ তে প্রথম সুযোগ পেলেন আকাশবাণীতে গান গাওয়ার। যা ছিল তাঁর গানের জগতে অন্যতম মাইলস্টোন। সেই থেকে ২০১৪ পর্যন্ত টানা প্রায় ৩৩ বছর এখানে রামায়ণ গান গেয়েছেন। মেদিনীপুরের বুক থেকে উঠে এসে অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে গান গাওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা এবং যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছিলেন নিজের কন্ঠে ভর দিয়ে। ১৯৮৯ তে পেলেন দূরদর্শনে গান গাওয়ার অমূল্য সুযোগ। জাতীয় শিক্ষক নির্মল মাইতির সহযোগিতায় এই সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। দূরদর্শনের 'পল্লীকথা' তে রামায়ণ গান পরিবেশন করেন তিনি। যা ছিল সেসময়ের নিরিখে অভূতপূর্ব ঘটনা। আজও এই অশীতিপর বয়সেও সমানে গান গাইতে পারেন লড়াকু বিদ্যুৎলতা সামন্ত। যদিও এখন থাকেন প্রতাপপুরে। বছর কয়েক আগে মারা গিয়েছেন স্বামী। ছেলে তাপস সামন্ত মায়ের গানের সাথেই তবলায় সঙ্গত করেন। এখনও অবশ্য ধরে রেখেছেন সেই মহিমাময় কন্ঠ। 

রামায়ণ গানকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন নিজের গলার স্বর এবং সুরের মাধ্যমে। রামায়ণের আদিকাণ্ড থেকে উত্তরাকাণ্ড পর্যন্ত যাবতীয় ঘটনাবলী দেবেন্দ্রনাথ সামন্ত লিখে ফেললেন। বিদ্যুৎলতা তাইই হারমোনিয়াম, তবলা আর ঢোলের সাহচর্যে শোনাতে শুরু করলেন পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাতে। ১৯৯০ তে 'সহস্র স্কন্ধ রাবণ' নামে রামায়ণ গানের ক্যাসেট রেকর্ডিং করেন তিনি। দারুন জনপ্রিয় হয়েছিল তা। একসময় যখন এতো বাড়বাড়ন্ত হয়নি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তখন গ্রামে গঞ্জে  মানুষের মনোরঞ্জন হত বিদ্যুৎলতার গান শুনে। আগে রামায়ণ গানের জন্য প্রায়ই ছুটতেন বিভিন্ন গ্রামে। এখন মানুষের রুচি বদলেছে। তেমন একটা ডাক পাননা। অথচ প্রথাসিদ্ধ প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও এই গান গেয়েই সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। 
'কথকতা' আজ ক্রমবিলীয়মান একটি লোকআঙ্গিক। একসময় তথা স্বাধীনতা পূর্বোত্তর যুগে এর কদর ছিল যথেষ্ট। গবেষক ড. শ্যামল বেরা জানান, তখন কথকতাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য কোনও কোনও কথক পয়ার, জাতগান এবং ঢেউয়া ব্যবহার করতেন। বলতে গেলে কথকতার একটি আঙ্গিক হলো এই রামায়ণ গান। সেই গানের শিল্পী হিসেবে পাঁশকুড়ার বিদ্যুৎলতা সামন্ত যে কীর্তি গড়েছেন তা ‘কথকতা'কে অন্য মার্গে তুলে দিয়েছেন। পেয়েছেন ‘সহজিয়া' সম্মান। গানের আসরে একাই রামায়ণের সব চরিত্রের ডায়লগ বলতেন আর গাইতেন। কথকতার ঘরানাই হলো সংস্কৃত শ্লোক পাঠ করে সেই শ্লোকের অর্থ ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণ এবং কাহিনীর পূর্ব সূত্র স্মরণ করানো। একটি প্রসঙ্গের ভাব পরিস্ফুটন করতে গিয়ে আরও নানা শাখা প্রশাখায় অন্য কাহিনী টেনে আনাই কথকতা। বাচনভঙ্গিকে পাথেয় করেই সেযুগে বিদ্যুৎলতা সামন্ত মহিলা হয়েও গানের একটি পৃথক ঘরানাকে সামনে রেখে স্থাপন করেছিলেন দৃষ্টান্ত।
🍂

Post a Comment

0 Comments