শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৬ / সালেহা খাতুন
কিন্তু যার উপর পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপা থাকে আর পরিশ্রমকে যারা সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি বলে মানে তাদের গতি রুদ্ধ করার ক্ষমতা কারোর থাকে না। শুধু আমি একা নই, আমরা অর্থাৎ আমাদের সব বন্ধুরা একজন মসীহা রূপে পেয়েছিলাম অধ্যাপক ড . শ্যামল সেনগুপ্ত মহাশয়কে। আমরা যখন প্রভু জগবন্ধু কলেজে পড়ছি তখন স্যার ওখানকার বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং পরে টিচার ইন চার্জের দায়িত্বভারও সামলেছেন। তিনি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা দুর্বার গতি এনে দেন। পড়াশোনার সাথে সাথে বাইরের জগতকে চেনার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।
শুধু বাড়ি নয় কলেজের চার দেওয়ালের বাইরেও বেরোনোর পরামর্শ দেন। বিরানব্বইয়ে বন্ধুরা মিলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ছাব্বিশে আগস্ট স্যারের নির্দেশ মতো চলে গেলাম শিশু সাহিত্যের অন্যতম স্রষ্টা সুকবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বাড়ি। হাওড়া জেলার নারিটে। দেখে এলাম নারিট ভট্টাচার্য বংশের উত্তরসূরিরা এবং নবকৃষ্ণ সাধারণ পাঠাগার কবির মূর্তি স্থাপন করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন। ১৯৯০ সালের তেইশ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী সরল দেব এটির উদ্বোধন করেন।
আনন্দ নিকেতন
নারিট ভ্রমণ করে বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করে ব্রজবুলিতে নারিট ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখে ফেললাম ---
আজু দিবস হাম ভাগে পোহায়লুঁ
পেঁখলু নবকৃষ্ণ-মুখ-চন্দ্রা।
দিবস রজনী হাম সফল করি মানলু
সব দুখ আজ দূর হয়ে গেলু।
সখী দলবলসহ মোরা আজ ভ্রমণ করিনু
বাস অটোতে চাপিনু।
গাহিনু গীত সব কলকল রবে ,
তালি দিয়ে নাচিনু।
পৌঁছিনু নারিটে যাত্রা শুভ হোয়লু
পেঁখলু নবকৃষ্ণ গেহ।
আজু মঝু গেহ গেহ না বলি মানিলু
ভাবিনু কুঁড়ে গেহ।
আজ বিহি মোহে অনুকূল হোয়ল
পেঁখলু ন্যায়রত্ন বিদ্যাপীঠ।
ভাবিনু মনে না ছাড়িব এ স্থানো
রহিব এই বিদ্যামঠ তলে।
বিশ্বনাথ হাজরা দান করোলু সবে
এক পত্রিকা।
তা পেয়ে মোরা ধন্য ধন্য করলু
মানলু আজু সফল দিন।
…. …. …..
লেখাটা বেশ দীর্ঘ ছিল। আরো অনেক তথ্য ভরে দেওয়া ছিল। স্যারের এক ছাত্র মানসের বাড়িতে আমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। মানসের বাবা খুব আশা করেছিলেন স্যারও আসবেন। কিন্তু স্যার না যাওয়ায় তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।
🍂
একুশে সেপ্টেম্বর বন্দনাসহ আমরা চলে গেলাম শরৎচন্দ্রের সামতাবেড়ের বাড়িতে। মাঝখানে ট্রেন অবরোধ হয়ে যাওয়ায় অভিজ্ঞতার ঝুলি আরো বেশি করে পূর্ণ হয়েছিল।
ওখান থেকে গেলাম আনন্দ নিকেতন। হাওড়া জেলার একটি অন্যতম সংগ্রহশালা। পয়সা দিয়ে তৈরি দুর্গা ঠাকুরের একটি মূর্তি আছে ওখানে। তারাপদ সাঁতরার নানান কীর্তি ও বইপত্র দেখলাম। কিছু বইও কিনেছিলাম।
সবথেকে বড়ো কথা ঐ বছর দশ অক্টোবর দ্বিতীয় হুগলি সেতুর উদ্বোধন হয়। আমাদের তখন অনন্ত উৎসাহ। দ্বিতীয় হুগলি সেতু ভ্রমণ করতে হবে। কিন্তু সেতুতে পায়ে হাঁটা যাবে না। আঠাশে অক্টোবর আমরা বন্ধুরা চলে গেলাম দ্বিতীয় হুগলি সেতু ভ্রমণে। শিবপুর থেকে হলুদ ট্যাক্সি ধরে গেলাম। মাথাপিছু দশটাকা করে পড়লো।
তখন তো সব কিছু কাব্যে প্রকাশের চেষ্টা চলছে। এই ভ্রমণের কথাও কবিতার আকারে লিখে ফেললাম। আসলে কবিতায় থাকে প্রিসিশন। বাহুল্য আমার ভালো লাগে না। সে শব্দই হোক বা অন্যকিছু।
দ্বিতীয় হুগলি সেতু
রবীন্দ্রনাথের ‘পণরক্ষা’ পড়তে গিয়ে
দ্বিতীয় হুগলি সেতুর পেয়েছি প্রথম সংবাদ,
মিলনের হাত যখন সে দিয়েছে বাড়িয়ে
তখনই হয়েছে তাকে দেখার সাধ।
ইচ্ছা আমাদের হয়েছে পূরণ
আনন্দ নিকেতনের সংবাদ
এসব কাজের প্রধান প্রেরণা দাতা ছিলেন অধ্যাপক ড .শ্যামল সেনগুপ্ত। আসলে স্যার আমাদের ভেতরকার সমস্ত সুপ্ত বুদ্ধি, সৎ চিন্তা যেগুলো আবৃত ছিল তাকে অনাবৃত করে দেওয়ার কাজটাই করতেন। আমাদের আবরণ যত সরেছে জ্ঞান ততই বেড়েছে।
0 Comments