বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক যোগেশচন্দ্র বাগল
নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক যোগেশচন্দ্র বাগল ১৯০৩ এর ২৭ মে বাংলাদেশর বরিশাল জেলার কুমিরমারা গ্ৰামে পিতা জগবন্ধু বাগল ও মা তরঙ্গিনী দেবীর কোল আলো করে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। ইতিহাসবেত্তা ও মার্জিত রুচির ব্যক্তিত্ব সাহিত্যিক যোগেশচন্দ্র বাগল বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে আকর মৌলিকতার পরিচয় মুদ্রিত করে সারস্বত সমাজকে উজ্জীবিত করেছেন । পৈত্রিক নিবাসের জায়গায় বামাচরণ দে'র পাঠশালায় হাতে খড়ি।১৯২২ এ কদমতলা উচ্চ ইংরেজি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে বাগেরহাট কলেজ, বর্তমান সরকারী পি.সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সাফল্যের সঙ্গে ১৯২৪ সালে আই.এ পাশ আউট। স্বভাবতই উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা পাড়ি দেন।১৯২৬ এ সিটি কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হলেও আর্থিক দুর্বলতার জন্য ইনকমপ্লিট থেকে যায় ।
প্রাবন্ধিক যোগশচন্দ্র বাগল সাহিত্যিক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত "প্রবাসী" ও "মর্ডান রিভিউ" পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে যোগদান করেছিলেন।এই পর্বে সহকর্মী সজনীকান্ত দাস,এন.সি.চৌধুরী।১৯৩৫ এ আনন্দবাজার পত্রিকা পরিবারের "দেশ"পত্রিকায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।তবে 'দেশ' পত্রিকায় প্রাবন্ধিক গবেষক যোগেশচন্দ্র বাগল ইন্টারন্যাশান্যাল বিষয়টি লিখতেন।বর্তমানে এই সব পত্রিকা সারাবছর কয়েকজন মাত্র কবি সাহিত্যিক নিয়ে চলাফেরা করে।
🍂
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে যোগেশ চন্দ্রের গবেষণামূলক গ্রন্থ 'ভারতের মুক্তি সন্ধানী' প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক সমাজে সমাদৃত হন।১৯৭২ এর ৭ জানুয়ারি ব্যারাকপুর, পশ্চিমবঙ্গে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রাবন্ধিক যোগেশচন্দ্র বাগল এর প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি হল : 'মুক্তির সন্ধানে ভারত' (১৯৪০), ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা' (১৯৪১), 'রাধাকান্ত দেব' (১৯৪২), ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর' (১৯৪৩), ‘রাজনারায়ণ বসু' (১৯৪৫), 'জাতীয়তার নবমন্ত্র বা হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত' (১৯৪৫), ‘জাতিবৈর বা আমাদের দেশাত্মবোধ' (১৯৪৬), 'ভারতের মুক্তি সন্ধানী' (১৯৪৮), 'ভারতের স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ' ১ম খণ্ড (১৯৪৮), 'রামকমল সেন ও কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়' (১৯৪৮), বিদ্রোহ ও বৈরিতা' (১৯৪৯), 'বাংলার স্ত্রীশিক্ষা' (১৯৫০), ‘বাংলার উচ্চশিক্ষা' (১৯৫৪), 'জাতীয় আন্দোলনে বঙ্গনারী' (১৯৫৪), ‘আনন্দ চন্দ্র বেদান্তবাগীশ, অযোধ্যারাম পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন' (১৯৫৬), 'উইলিয়ম ইয়েট্স, জন ম্যাক, মধুসূদন গুপ্ত' (১৯৫৭), ‘কেশবচন্দ্র সেন’ (১৯৫৮), ‘বাংলার নব্যসংস্কৃতি' (১৯৫৮), 'কলিকাতার সংস্কৃতিকেন্দ্র' (১৯৫৯), ‘বিদ্যাসাগর পরিচয়' (১৯৫৯), ‘বরণীয়' (১৯৫৯), 'বেথুন সোসাইটি' (১৯৬০), ‘জাগৃতি ও জাতীয়তা' (১৯৬০), 'বাংলার নবজাগরণের কথা' (১৯৬৩), ‘উমেশচন্দ্র দত্ত, মহেশচন্দ্র ঘোষ' (১৯৬৩), ‘সরলাদেবী চৌধুরানী, শরৎচন্দ্র রায় (১৯৬৪), ‘ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়' (১৯৬৪), প্যারীচাঁদ মিত্র' (১৯৬৪), 'বঙ্গসংস্কৃতির কথা’ (১৯৬৪), ‘রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়' (১৯৬৫), ‘ডিরোজিও' (১৯৭৫), 'মুদ্রনশিল্পের গোড়ার কথা' (১৯৮২)। এছাড়াও সাহিত্য সংসদ থেকে এক খন্ড ইংরেজি সহ মোট তিনটি খন্ডে বঙ্কিম রচনাবলী ও রমেশচন্দ্র রচনাবলী সম্পাদনা করেন। যোগেশচন্দ্র বাগল মহোদয়ের মহিলা শিক্ষাসংক্রান্ত বই "Women's Education in Eastern India"।
সাহিত্যিক যোগেশচন্দ্র বাগলের ১৯৬১ তে হঠাৎ দৃষ্টি শক্তি লোপ পেয়ে যায়। অথচ এই অন্ধত্ব নিয়ে "ইন্ডিয়ান আর্ট' কলেজের শতবার্ষিক স্মারকগ্ৰন্থ সম্পাদনা করেন। নিজের "হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত" সম্পাদনা করেন। "সাহিত্য সাধক চরিতমালা" ও "ভারতকোষ" এর কাজ করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,ইন্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন ও রিজিওনাল কমিশন (প.ব) সংযুক্ত ছিলেন।
যোগেশচন্দ্রের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'মুক্তির সন্ধানে ভারত' ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বের প্রায় শতাধিক বৎসরের ইতিহাস। প্রাবন্ধিকের ভাষায় --
"বিগত একশত বৎসরে শিক্ষায়, সাহিত্যে, রাষ্ট্র-ব্যবস্থায়, ধর্মে, লোকাচারে এককথায় জাতির সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গীতে যে একটা গুরুতর পরিবর্তন ঘটিয়াছে তাহা আজ কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না"।
"মুক্তির সন্ধানে ভারত" রামমোহন থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভারতের রাজনৈতিক ওঠাপড়ার ইতিহাস প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রথম খন্ডে কংগ্রেস পূর্বযুগ এবং দ্বিতীয় খন্ডে কংগ্রেস যুগের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা' গ্রন্থটিতে ঊনবিংশ শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বাঙালি সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন।
প্রাবন্ধিক যোগেশচন্দ্র বাগল মহোদয়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংক্রান্ত কাজ কর্মের জন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ "রামপ্রাণ গুপ্ত"পুরস্কার প্রদান করেছেন। "সরোজিনী বোস স্মৃতি স্বর্ণপদক",১৯৬২, "শিশিরকুমার পুরস্কার" লাভ করেন।
যোগেশচন্দ্র বাগল গবেষণাধর্মী কাজে সিদ্ধহস্ত। ১৯৫৮ সালে "বিদ্যাসাগর স্মৃতি বক্তৃতা" ও ১৯৬৮ এ তে "শরৎচন্দ্র স্মৃতি লেকচার" পেশ করে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন।বিভিন্ন দেশ বিদেশের পত্র-পত্রিকা, চিঠিপত্র, দিনপঞ্জী, আত্মবিবরণী সংগ্রহ করেছিলেন । এবং বাংলার বিভিন্ন মনীষীদের সম্পর্কে প্রামাণ্য তথ্য সহ যে সব গ্রন্থ রচনা করেছেন তার ঐতিহাসিক গুরুত চিরস্মরণীয়। তাই বাংলার সারস্বত সমাজে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার সাহিত্যিক হয়েও কালের অমোঘ আকর্ষণে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক যোগেশচন্দ্র বাগল।
0 Comments