জ্বলদর্চি

রামেশ্বর মিশ্র (বিডিও, রেডক্রশ সংগঠক, তমলুক)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭৬
রামেশ্বর মিশ্র (বিডিও, রেডক্রশ সংগঠক, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনিই মেদিনীপুরের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তিন তিনবার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সমাজসেবাকে ভালোবেসে জীবনের আরাম আয়েস ত্যাগ, মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ এবং নিজেকে সাধারণ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার কঠিন ব্রত ছিল তাঁর জীবনের পরতে পরতে। রেডক্রশ সোসাইটির মতো আন্তর্জাতিক সেবাসংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা পদে থেকে রামেশ্বর মিশ্র তাঁর জীবনের চালিকাশক্তিকে মজবুত করে তুলেছিলেন নিজের মতো করে। যা আজও অন্যদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে রয়ে গিয়েছে। 

আশির কোঠায় ঢুকেও তিনি ছিলেন সদাচঞ্চল এবং সহাস্যবদন। মেদিনীপুরের মানুষ যে কতটা পরিশ্রমী হতে পারে তা তাঁকে দেখেই বোঝা যায়। তাঁর কর্মচঞ্চলতা এবং কর্মপ্রবণতা যে কোনও তরুণ বয়সী যুবক যুবতী লজ্জিত হতে পারতো। 

১৯২৫ এর ১লা মে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামের কুলাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রামেশ্বর মিশ্র। তাঁর বাবা ছিলেন মন্মথনাথ মিশ্র এবং মায়ের নাম চারুবালা দেবী। কুলাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিকের পাঠ শেষ করে তিনি ভর্তি হন ভগবানপুর হাইস্কুলে। এই স্কুল থেকেই ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় পাশ করেন। একসময় বাড়ি থেকে ৮ কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হত স্কুলে যাওয়ার জন্য। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে বাগনান কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক হন। এরপরেই শুরু হয়ে যায় তাঁর কর্মতৎপর জীবন। 

১৯৪২ সালের অক্টোবরের ঝড় ও বন্যা এবং ১৯৪৩ সালে বন্যা পীড়িত দুর্গতদের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন নিজেকে উজাড় করে। ১৯৪৩ সালে কাঁথির পিছাবনীতে রিলিফ অফিসারের পদে আত্মনিয়োগের পর আর পিছু ফিরে তাকাননি। কাজের গুণে ১৯৬৫ তে উন্নীত হন পঞ্চায়েতের এক্সটেনশন অফিসার হিসেবে। সবশেষে তিনি অলঙ্কৃত করেন নন্দীগ্রাম-১ এর বি.ডি.ও পদ। ১৯৮৩ তে অবসর নিলেও তিনি আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন সমাজসেবামূলক কাজের সাথে।

স্বাধীনতা সংগ্রামী বিধুভূষণ মিশ্রের কন্যা সন্ধ্যারানী মিশ্রকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। যিনি ছিলেন রামেশ্বর মিশ্রের যাবতীয় কাজের অন্যতম প্রেরণাদাতা, উৎসাহদাতা এবং উদ্দীপনাদাতা। একমাত্র ছেলে ড. সোমনাথ মিশ্রও ছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক। ছিলেন হ্যামিল্টন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। একই পরিবারের বাবা ও ছেলে উভয়েই রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা বিরলের মধ্যে বিরলতম। 

অভিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় তিনি ছিলেন ভারতীয় রেডক্রশ সোসাইটির তমলুকের মহকুমা সম্পাদক। মেদিনীপুর জেলা ভাগের পর তিনি হন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা রেডক্রশের জেলা সম্পাদক। এই পদে তিনি কাজ করেছেন অক্লান্তভাবে। অসাধারণ এবং অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি সমাজসেবাকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের অন্যতম আদর্শ। মেদিনীপুরকে গৌরবান্বিত করেন নিজের কাজের মাধ্যমেমাধ্যমে ইণ্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির হাত ধরে। 

মানুষজনকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার কাজে যুক্ত থাকতেন তিনি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা রেড ক্রশের এক সময়ের সম্পাদক রামেশ্বর মিশ্র ছিলেন সমাজসেবামূলক কাজের অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর সক্রিয় উদ্যোগে রেডক্রশের রক্তদান, চক্ষু অপারেশন, মেয়েদের বন্ধ্যাকরণ, রিলিফ ক্যাম্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ক্যাম্প, শিশু প্রদর্শনী, প্রতিষেধক প্রোগ্রাম প্রভৃতি জনহিতকর কাজের আয়োজন করা হত নিয়মিত। তিনিই ছিলেন সবকিছুর নেপথ্য নায়ক। 

নিষ্ঠা ও সেবার জন্য তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ১৯৭১ এ প্রথমবারের জন্য পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার হিসেবে 'সেনসাস সিলভার মেডেল'। ত্যাগ নিষ্ঠা ও সেবাব্রতে দীক্ষিত আজীবন এই যোদ্ধা রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে লাইফ মেম্বার সার্টিফিকেটও পেয়েছেন। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের কাছ থেকে পেয়েছেন গোল্ড মেডেল। ১৯৮৪ তে তিনিই তমলুকে গড়ে তোলেন শিশু রক্ষা সমিতি। এর সম্পাদকও তিনিই ছিলেন। ১৯৮৫ তে তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তমলুকের বাণপুকুরের পাড়ে গড়ে ওঠে রেডক্রশ সোসাইটি। এটির উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন রাজ্যপাল সৈয়দ নুরুল হাসান। জেলা রেডক্রশ সম্পাদক থাকাকালীন রামেশ্বর মিশ্র জাতীয় সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন ২০১১ এর ২৭ শে সেপ্টেম্বর দিল্লীর বিজ্ঞান ভবনে। রেডক্রশ গোল্ড মেডেল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ভারত সরকার দিয়েছে ‘ইন্ডিয়ান রেড ক্রস মেরিট সার্টিফিকেট' সম্মান। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রামেশ্বর মিশ্রই একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে ওই পুরস্কার সেবছর পেয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের ৮ ই মে কলকাতার 'দ্যা হেমাটোলজি ফাউন্ডেশন' দুর্গত মানুষের সেবার জন্য পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভারতীয় রেডক্রশ সোসাইটিকে 'বেস্ট প্রাইজ' দিয়ে সম্মানিত করেছে। এই পুরস্কার প্রাপ্তি আসলে 'ওয়ান ম্যান আর্মি' রামেশ্বর মিশ্রর ডেডিকেশন, কাজের প্রতি নিবিড় নিষ্ঠা এবং অমানুষিক পরিশ্রমের পুরস্কার। 

খুব ভালো অভিনয় করতেন তিনি। তাঁর অভিনয় দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। তমলুকের আনন্দলোক ড্রামাটিক ক্লাব তাঁর অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতার জন্য দিয়েছে বিশেষ মানপত্র। পথের পাঁচালী, পথের শেষে, দুর্গেশনন্দিনী, দেবলা দেবী, শ্রীকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বিসর্জন', বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিষবৃক্ষ', তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কবি' প্রভৃতি নাটকে তাঁর অভিনয় দক্ষতা ছিল সাবলীল এবং নজরকাড়া। প্রতিটি নাটকেই তিনি ছিলেন নায়কের ভূমিকায়। ২০১৫ এর ১৭ ই ডিসেম্বর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন চির যুবক। সারা জেলায় হেঁটে বেড়াতেন অদম্য উৎসাহকে সঙ্গী করে। মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন দ্বিধাহীনভাবে। এহেন নিরহঙ্কারী, সদালাপি, কর্মতৎপর মানুষটি মেদিনীপুরের যথার্থ মানুষ রতন হিসেবে মেদিনীপুরের বুকে আলোকবর্তিকা হয়ে চিরভাস্বর থেকে গিয়েছেন সকলের মনে।
🍂

Post a Comment

0 Comments