জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৫ / সালেহা খাতুন

কালো শাড়িতে বন্ধু পলি 

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৫ / সালেহা খাতুন 

মনের গহীনে ডুব দিয়ে একের পর এক স্তর সরিয়ে দেখছি সেদিনের আমিকে। এ দেখায় বড়ো মায়া জড়িয়ে আছে। উনিশ কুড়ির আমিটাকে পরিবার পরিজনের থেকে বেশি করে ঘিরে আছে বন্ধু বান্ধব এবং স্যার ম্যাডামরা। একটি মেয়ে তো শুধু তার পরিবারের একার নয়, সে দেশেরও। মাঝে মাঝে সমাজ ও পরিবার যখন কঠোর হয়ে ওঠে সে মুক্তি খোঁজে, স্বতন্ত্র ব্যক্তিরূপে কল্পনায় তার জগত গড়ে নেয়, জ্ঞানের জগতের সন্ধানে রত্নভাণ্ডারে ডুব দেয়। আর এ রত্নভাণ্ডার সে একান্তভাবেই বইয়ের ভেতর পেয়ে যায়।

একানব্বইয়ের অশ্রু ঝরানো দিন বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে হলো বিলীন। প্রতিদিন ভোরে উঠে ছাদে গিয়ে সে প্রার্থনা করতো। আর তা ডায়েরিতে লিখে রাখতো। নিজেই মনোবিদ হয়ে নিজের মনের শুশ্রুষা করতো । অথচ তখন কোনোভাবেই সাইকোলজি চর্চা সে করেনি। সেই সময়ের আমিকে আজ বড়ো আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কী মিষ্টি মিষ্টি প্রার্থনা সে করতো!

“প্রভু হে, তুমি আমাকে সবুজ পাতার মতো করো। শুকনো পাতা করো না।”

“ তুমি আমাকে প্রভাতের মতো সুন্দর ও স্নিগ্ধ করো হে প্রভু।”

“ হে প্রভু তুমি আমাকে ভোরবেলাকার রাঙা আকাশের মতো করো। ভোরের ম্লান চাঁদের মতো করো না।”

“প্রভু হে আমাকে ভোরের পাখির মতো করো। তারা যেমন তাদের কলকাকলিতে ভোরকে ভরিয়ে রাখে, আমাকেও তেমনি করো।”

“ প্রভু হে তুমি আমাকে আজকের ভোরের মতো ধীর স্থির এবং স্থিত প্রতিজ্ঞ করো।” 
🍂
বিরানব্বইয়ের মে জুন এমনই আরো অনেক প্রার্থনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। আসলে তখনকার আমিটা বাঁচতে জানতো। সে সংসারের দোষ ধরতো না। সংসারটা যেমনই হোক, বাঁচাটাই তার কাছে আসল ছিল। নানান ধরনের গ্রন্থপাঠ আর তা থেকে জীবনের প্রকৃত পাঠ গ্রহণের চেষ্টা সে করতো। এখন জানি ঐ বয়সের মেয়েদের মন অকারণেই ভারী হয়। মনের ভার লাঘবের একটা সুন্দর উপায় সে বের করে, সুকান্ত সমগ্র পড়ে। সুকান্তের পত্রাবলীতে সুকান্তের যেমন ‘প্রিয় অরুণ’ ছিল সেও তেমনি তার ক্লাসের আর এক বন্ধু পলিকে চিঠি লিখতো “প্রিয় রাণী” সম্বোধন করে। কখনও কখনও তাকে সম্বোধন করতো “ দুঃখনিবারেসু রাণী” বলে। কখনো বা এ সম্বোধন বদলে যেতো “বিরক্তায়েসু” রূপে।

আর হ্যাঁ, সে লিখতো। প্রচুর লিখতো। তবে তা নিভৃতে। মেয়ে হিসেবে পদে পদে বাধা পেয়ে সে সময়ে সে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে লিখেছিল 
“ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার / কেন নাহি দিবে অধিকার / হে বিধাতা?” 

উনিশের সেই মেয়েটার অধিকার নিয়ে নিজের ভাবনাও প্রকাশ পেয়েছিল ডায়েরির পাতায়---

লিখেছিল, আমরা চাইলেই কোনো অধিকার পাই না। তাও আমরা কোনো অধিকার জোর করে কারোর থেকে ছিনিয়ে নিতে চাই না। আমাদের সমগ্রতা দিয়ে, সত্তা দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, অপরকে ভালোবাসা দিয়ে, কঠোর সংযম দিয়ে, দৃঢ় মানসিকতা দিয়ে আমরা আমাদের স্থান করে নিতে চাই এ পৃথিবীতে।

আমরা সব সময় শৃঙ্খলে বাধা। তবে আমি বিশৃঙ্খল জীবন চাই না। আমাদের জীবন ছন্দোবদ্ধ। ছন্দপতন ঘটলেই আমাদের বিনাশ। আমাদের এমনই জীবন শৈশব কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ থাকে না। সমাজের অনেক অনগ্রসর ব্যক্তি ভাবে আমরা বাইরে বেরোচ্ছি অর্থাৎ আমাদের চরিত্রের আর ভালো দিক নেই। কিন্তু নারীদের চরিত্র কি এতোই ঠুনকো ! তাদের মধ্যে স্নেহ মায়া মমতা প্রেম ইত্যাদি থাকলেই তাদের অপরাধ। তাহলে কি আমাদের হৃদয়ের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিতে হবে? আমাদের মনুষ্য জীবনের অস্তিত্ব তাহলে আর কোথায় রইলো? 
এমন ভোরেই মন ব্যাকুল হতো।

আমরা রাস্তাঘাটে বেরোলে কিছু মানুষের এমন শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ি যে মনে হয় হুমড়ি খেয়ে পড়ি আর কি ! মানুষ মানুষকে দেখবে এতে আর অস্বাভাবিকতার কী আছে? সেই দৃষ্টির সামনে একবার পড়ে দেখবেন বন্ধু। আর কত অশালীন অশোভন কথাবার্তা কাব্য কবিতার মধ্যে পড়ি তার কোনো ইয়ত্তা থাকে না। মাঝে মাঝে আমি এসব রোমান্টিক কবিদের নোবেল প্রাইজে ভূষিত করার কথা ভাবি। তাদের অশালীন আচার আচরণ মাঝে মাঝে খুবই ব্যথা দেয়। কিন্তু এর জন্য আমরা প্রত্যেকেই দায়ী। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। তারা কোনো ভালো উপদেশ গ্রহণ করতে চায় না। রাস্তাঘাটে বেরোলে নিরাপত্তার অভাব খুবই অনুভব করি। 

আমরা স্বচ্ছন্দ গতিতে জীবনকে চালিত করতে পারি না। কিছু নির্দেশ কিছু বাধা আমাদের প্রভাবিত করে। আমরা কোনো প্রতিজ্ঞায় অটল থাকতে পারি না। বাহ্যিক পরিবেশকে আমি মোটেই আমল দিতে চাই না। কিন্তু সেটাই ঘুরে ফিরে মনে আসে।

বিরানব্বইয়ের সেই টিন এজারের অনুভব এখনকার টিন এজারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। তার প্রগতিশীল ভাবনাকে এখনও রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে সমাজ পরিবারের স্বঘোষিত অভিভাবকরা।
(ক্রমশ )
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments