জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ১৭/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১৭
গৌতম বাড়ই


এরপর যা ঘটলো, তা যেমন বিস্ময়কর এবং তার কিয়দংশ যদি সত্যি ঘটে থাকে---------


যারা এগিয়ে আসছিলেন তারা হলেন স্থানীয় অধিবাসী। হতদরিদ্র চেহারা, মলিন জামাকাপড়ের বেশভূষায় তাদের দেখে এ বোঝাই যাচ্ছিল।  হাঁপাতে হাঁপাতে তারা নিকটে এসে যা বলল, তাতে বণিকদলের অন্যান্যদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চৈনিক বণিকেরা স্থানীয় মানুষজনের ভাব ভঙ্গিতে সমূহ এক বিপদের আঁচ করতে পারল। সবাই তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, এমন সময় ধুলোর ঝড় উঠিয়ে একদল মানুষের মতন হিংস্র পশুদের আগমন ঘটল। আর সামনে রয়েছে এক বিশাল দেহের সিংহাকৃতি দানব। তার হিংস্রতায়, হঠাৎ আক্রমণে মুহূর্তে বেশকিছু মানুষ গুরুতর জখম আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। বণিকেরা আর তার দলবলেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। মগধ নগরীর পথ ছেড়ে, প্রাণ বাঁচাতে যে যেখানে পারে পালিয়ে গেল। সুসীমা শুধু আড়াল নিল না, সুসীমা শুধু মরণ জেনেও তার দৃষ্টিপথ সোজাসুজি রাখল। সর্বনাশ যদি হয় তবে তার অভীষ্ট সন্মুখপথেই হোক। যে পথ সে ফেলে এসেছে, সে পথের প্রতি সে আর ফিরেও তাকাবে না আর। তার গন্তব্য অভিমুখ এখন সন্মুখে। তার অন্তরে তার সুপ্ত ইচ্ছে জড়ো হয়ে আছে। মানব শরীরে মৃত্যুর চেয়ে বড় ভয় নেই, সুসীমা সেই মৃত্যুকে জয় করেই পথে নেমেছে। সুসীমা স্বাধীনচেতা, নিজের জীবন একমাত্র নিজের এই বিশ্বাসে সে অবিচল, সমস্ত শাসন- বাঁধনের ওপর। সে তার সুস্থির রাজমহলের ভোগ- আরামবিলাসের জীবন ছেড়ে এই দূর্গম পাহাড়, বনাঞ্চল আর বাস্তুচ্যুত জীবন বেছে নিয়েছেন। নারী বলে তাকে দাবিয়ে, নিয়ন্ত্রণ করে রাখা যাবে না। সে একক দাঁড়িয়ে রইল। সমস্ত বণিকদল এই দূর্বৃত্ত ও আর তার দলবলের ঝটিকা আক্রমণে মুহূর্তে হাওয়া। এরাই তাকে বলেছিল, নিরাপত্তা দেবে। আজ তারাই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পলায়ন করেছে। 

যখন এই অতর্কিত আক্রমণে সবাই ছত্রভঙ্গ, তখন সুসীমা অপলক স্থির। অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে সেই তেজী বলবান সিংহের প্রবল বাহুবলী প্রতাপে সে মুগ্ধ হয়ে পড়ল, হয়ত তার মনের ভেতরে সুসীমা এক শক্তিশালী পুরুষের ভজনা করেন সবসময়। একা- একা তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সিংহ হুঙ্কার ছাড়ল। সুসীমা দৃঢ় প্রত্যয়ে সে হুঙ্কার অবজ্ঞা করে মুগ্ধ দৃষ্টি হেনে এক মিষ্টি যাদুহাসিতে সিংহের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সিংহ হাসিতে হাসিতে এ ত্রিভুবন কাঁপিয়ে দিল। রাজকুমারী সিংহের ভজনা  করতে করতেই তার প্রতি কামাতুরা হয়ে পড়ল। সিংহ কাছে এগিয়ে এসে বলল- " এ কোন সাহসিনী নারী তুমি? কোথায় তোমার বসত?  হয়ত তোমার জানা নেই, এ বনের একদম প্রাকৃতিক রাজা আমি, একচ্ছত্র অধিকার আমার এই অঞ্চলের।  আমায় দেখামাত্র গাছের পাখিরা দূরে উড়ে যায়, বনের পবন স্থির হয়ে যায়, বলহীন দূর্বল, সবল, সব সাধারণ মানুষ দৌড়ে পালিয়ে যায়, জঙ্গলের জন্তু- জানোয়ার ঘন জঙ্গলে লুকোয়, তাহলে তুমি কে এই অসম সাহসিনী সুদীপ্তা নারী? "

সুসীমা বলে- " আমি নারী, একজন নারী, এই আমার একমাত্র পরিচয়, আমি বলবান পুরুষকেও আমার এই শরীরের মায়াবী যাদুতে বশ করতে পারি। সৃষ্টির আদি থেকে, একদম অনন্তে আমার যাত্রা। ধ্বংসের শেষে গিয়েও আমি আবার নতুন করে সৃষ্টির খেলায় মেতে উঠি, হে সিংহরাজ! এই আমার নারী প্রকৃতির রহস্য।তুমি এই প্রকৃতির ভেতরেই ডুবে যাবে অবশেষে। অপূর্ব আনন্দ দানে তুমি জীবনের বেঁচে থাকবার সুখরসে যাপনের প্রহর পার করবে অনেক। আমি তোমার জীবন রসের যেমন ধারা, হয়ত একদিন ধ্বংসে তোমায় বিলীনও করতে পারি।এসো কাছে। আমি তোমায় দেখে ভয় পাচ্ছি না। একদম ভীত নই। "

সিংহরাজ সুসীমাকে একখন্ড তুলোর মতন নিজের কাঁধের ওপর চাপিয়ে নেয়। বাদবাকি সিংহ সদৃশ পুরুষেরা লুটতরাজের পর, বণিকদের সম্পদ যতটুকু পেরেছে নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে। আর সিংহের কাঁধে চেপে এক গুহার মধ্যে এসে পড়ল সুসীমা। সিংহমশাই বললেন তাকে- " আজ থেকে এই পাহাড়ি গুহাই হবে আমাদের বাসস্থান। আমরা এখানেই থাকব দুজনে। "

গুহার ভেতরে এক প্রাচীন অন্ধকারে ঠাসা। সিংহের আগমনে এক বিশালাকার অজগর গুহার ভেতর থেকে ধীর লয়ে বাইরে বেরিয়ে মিলিয়ে গেল জঙ্গলে। সিংহ তাকে কোতল করতে  উদ্যত হয়েছিল, সুসীমা নিষেধ করাতে ক্ষান্ত হল। এতে বঙ্গেশ্বরের রাজকন্যা যারপরনাই খুশি এবং চমৎকৃত হল। গুহার মুখে আলো, সেই আলোতে দুজনে মুখোমুখি বসল। সিংহরাজ আর পৃথিবীর অতীব সুন্দরী রাজকন্যা সুসীমা। তৃষ্ণার্ত এক হৃদয় যখন, আরও তৃষ্ণার্ত এক শরীরের কাছাকাছি অবস্থান করে, দুটো শরীরের মধ্যে কেমন করে যেন এক মেলবন্ধন ঘটে যায়। সেই দিনের আলোতেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রাঢ়ের বনাঞ্চল চঞ্চল হয়ে উঠল। গাছে- গাছে, শাখা-প্রশাখায়, পাতায়- পাতায় কানে কানে কত কী কথা! প্রাণীকুলের চরম উন্মাদনার তারা সাক্ষী হয়ে থাকল। বারংবার সুসীমা আর সিংহরাজের মিলনে এ গুহাআবাসে আজ মধুর সংগীতের মাঝে , বীরত্বের উপাসনা হল। 

সিংহরাজ এতকাল ধরে শুধু তার বাহুবল প্রয়োগে নারীদেরকে ভোগ করে এসেছে, সেখানে তার দানবিক পাশবিক  দখলদারি ছিল, আনন্দদান করেনি দেহের রক্তকোষে। এরকম আনন্দদান, সুখানুভূতি এই প্রথম। এ নারী, এ প্রকৃতি তাহলে তার মায়াবীযাদুতে তার মতন দানবকে বশ করে ফেলল। তবু যেন সে চায় এই মায়াবীযাদুতে আরও বশীভূত হতে। সুসীমা সিংহরাজের সাথে গোধূলির পড়ন্ত আলোয় সামনের শীর্ণতোয়া এক নদীতে নাইতে গেল। তার সারা গায়ে পশুরাজের পুরুষালি গন্ধ লেগে আছে। তার সেই গন্ধ একদমই খারাপ লাগছে না, অপূর্ব সেই গন্ধে মাতোয়ারা হচ্ছে সুসীমা। তবুও সারাদিনের শ্রান্তি আর ক্লান্তিতে এই অবসন্ন দেহ শীতল জলে তরতাজা হতে চাইল। 
🍂
গুহা আবাসে সুসীমার সংসার যাপন

সিংহরাজের সাথে সুসীমার রাঢ়ের জঙ্গলে,  সেই সংসার, সেই গুহা যাপন শুরু হল। গুহার অভ্যন্তরে এই বঙ্গেই পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক যুগের সেই সন্ধিক্ষণে হয়ত প্রথম এই দূর্দান্ত আর দূর্দ্ধর্ষ লিভ- ইন- টুগেদার শুরু হয়েছিল। সুসীমার সেই প্রথা বহির্ভূত ইতিহাস হয়ত বারেবারে তাই আলোচিত হয়নি। আনুষ্ঠানিক বিবাহকে আমরা আনন্দ সহকারে উদযাপন করি, যৌনতাকে যূথবদ্ধভাবে স্বীকৃতি দেই। আবার একজন নারী যখন স্বেচ্ছায় নিজের যৌনতা অবদমন করতে না পেরে নিজের পছন্দের পুরুষের সাথে যৌনতায় মিলিত হয়, আমরা তাকে পরকীয়া, স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরিণী বলে দেগে দেই। পুরুষদের এই যৌন স্বেচ্ছাচারিতা স্বাভাবিক বলেই দেখা হয় সব জায়গায়। সুসীমা তার আপন গতিবেগে এগিয়ে চলে। সে মনে প্রাণে নিয়ম কানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ এক নারী বলে ভাবতেই পারে না। সে প্রকৃতি। সে প্রকৃতির কিছু স্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমী নিয়মে চলে। সুসীমার এখন মধুচন্দ্রিমা চলছে। সে জানে কালের নিয়মে একদিন এই গতিবেগ ধীর হয়ে আসবে। তাদের এইসময়  আনন্দ উচ্ছ্বাস নিয়ে এ গুহা আবাসের দিনযাপনের সময়গুলো  খুব সুন্দর ভাবেই কেটে যাচ্ছিল। 

এরমধ্যে একদিন দূর পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে থেকে লাঙুলবাবার কাছ থেকে সিংহরাজের ডাক এলো। লাঙুলবাবার ডাক এই সিংহপ্রজাতির অর্দ্ধ মানুষ আর অর্দ্ধ পশুর চেহারার  এই সব মানুষেরা কখনও অবজ্ঞা করতে পারে না। লাঙুলবাবার ডাক অমান্য করা মানে, মৃত্যুকে নিজের কাছে ডেকে আনা। 

পরদিন সিংহরাজ ভোর থাকতেই উঠে সুসীমাকে নিজের কাঁধে তুলে ঐ দূর্গম পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হল। নিজের কষ্ট হয় হোক, সুসীমার যেন কোনও কষ্ট না হয়। সিংহরাজ নিজেও অবাক হচ্ছেন তার হিংস্র পাশবিক প্রবৃত্তি এই সুন্দরীর জন্য কী অনেকটা কমে যাচ্ছে। সুসীমা এখনও সিংহরাজকে জানায়নি তার আসল বংশ পরিচয়। সিংহরাজের বুকের গভীরে কী ভালোবাসা জন্মাচ্ছে?

সিংহরাজেরও আজ উদ্বেগ হচ্ছে, কেন লাঙুলবাবা তাকে ডেকে পাঠাল। সুসীমার নাম উল্লেখ করেননি , তবুও সুসীমাকে একলা ফেলে আসতে তার মন চাইছিল না। এইভাবে তো ডাকেন না লোকের মাধ্যমে! এই প্রথম। তাহলে-------

এগিয়ে চললেন সেই দূর্গম পাহাড় আর জঙ্গলের দিকে। 

ক্রমশ

সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments